আহমদ, নাজীর
আহমদ, নাজীর (১৯২৫-১৯৯০) অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, বেতারকর্মী, লেখক। ১৯২৫ সালে ঢাকার ইসলামপুরের আশেক লেনে বিখ্যাত মীর্জা পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা মীর্জা ফকির মোহাম্মদ ছিলেন একজন ব্যবসায়ী; তবে অবসর সময়ে তিনি সাহিত্য ও সঙ্গীতচর্চা করতেন। ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের স্থপতি শিল্পী হামিদুর রহমান ছিলেন তাঁর অনুজ।
নাজীর আহমদ প্রথমে ঢাকার হাম্মাদিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে এন্ট্রান্স (১৯৩৮), জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি (১৯৪২) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাস করেন।
ছাত্রাবস্থায়ই নাজীর আহমদ মহল্লা, স্কুল ও কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে, বিশেষ করে নাট্যাভিনয়ে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৩৯ সালে ঢাকায় বেতার কেন্দ্র চালু হলে শিল্পী হিসেবে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে প্রথম মুসলমান ঘোষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে ঢাকায় ফিরে তিনি বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রযোজনা, গ্রন্থনা ও পরিবেশনার দায়িত্ব পালন করেন এবং নাটক, জীবন্তিকা, গান ও কবিতা রচনা করেন। তাঁর রচিত একটি গান ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ পাকিস্তানের বিকল্প জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলে রাত বারোটার পর তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস, ঢাকা’। দেশভাগের ফলে তখন বেতারে যে নানামুখী শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণের ক্ষেত্রে নাজীর আহমদের অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ববঙ্গ সফর উপলক্ষে প্রথম প্রামাণ্য চিত্র ইন আওয়ার মিডস্ট তিনিই তৈরি করেন।
নাজীর আহমদ ১৯৪৯ সালে লন্ডনে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে (বিবিসি) যোগ দেন এবং বাংলাভাষীদের জন্য প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান ‘আঞ্জুমান’ চালু করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকায় ফিরে তিনি পূর্ববঙ্গ জনসংযোগ বিভাগের অধীনে চলচ্চিত্র বিভাগের প্রধান হিসেবে ফিল্ম স্টুডিও ল্যাবরেটরি তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে তাঁর নির্মিত সালামত প্রামাণ্য চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
১৯৫৫ সালে নাজীর আহমদের উদ্যোগে ঢাকায় প্রথম ফিল্ম ল্যাবরেটরি ও স্টুডিও প্রবর্তিত হয় এবং তিনি চাকা, কর্ণফুলি, পূর্ব পাকিস্তানের প্রবেশপথ সহ কয়েকটি প্রামাণ্য চিত্র প্রযোজনা করেন। ১৯৫৭ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন। ফতেহ লোহানীর আসিয়া (১৯৬০) চলচ্চিত্রের কাহিনীকার, নবারুণ (১৯৬০) প্রামাণ্য চিত্র ও নতুন দিগন্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন নাজীর আহমদ। ১৯৬২ সালে ঢাকা ছেড়ে তিনি কয়েক বছর জার্মানি, করাচি ও লন্ডনে বসবাস করেন। ১৯৬৫-৬৭ সময়ে পুনরায় দুবছর বিবিসিতে কাজ করার পর তিনি লন্ডনে প্রকাশনা ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক: চন্দ্রগুপ্ত, সাজাহান, সিরাজুদ্দৌলা, তটিনীর বিচার, নার্সিংহোম, টিপু সুলতান প্রভৃতি এবং বেতারনাটক: আলীবাবা, বেদের মেয়ে, চেঙ্গিস খাঁ, অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেটরা, ইডিপাস রেক্স, এন্টিগোনি, টেম্পেস্ট প্রভৃতি। উল্লেখ্য যে, চেঙ্গিস খাঁ নাটকটি তাঁরই রচনা। তিনি ১৯৮৩ সালে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর সম্মানে বিএফডিসি-র সাউন্ড কমপ্লেক্সের নামকরণ করা হয়।
[অনুপম হায়াৎ]