আশুতোষ মিউজিয়াম
আশুতোষ মিউজিয়াম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গবেষণা জাদুঘর। এটি কলেজ স্ট্রীটে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরসমূহের মধ্যে এটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘরটি ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সর্বজনীন জাদুঘর হিসেবেও প্রশংসিত। এর নামকরণ করা হয় উপমহাদেশের আধুনিক শিক্ষার মহান প্রচারক আশুতোষ মুখার্জীর নামানুসারে। আশুতোষ মুখার্জি ১৯০৬ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত চার বার এবং ১৯২১-১৯২৩ পর্যন্ত আর একবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলা শিল্পকলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে ভারতীয় শিল্পকলার বিভিন্ন স্তরের নিদর্শনসমূহ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আশুতোষ মিউজিয়ামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
আশুতোষ মিউজিয়াম প্রধানত বাংলা ও বিহার থেকে শিল্পকর্ম ও প্রত্নতত্ত্বের সামগ্রীর মাঝারি ধরনের সংগ্রহ নিয়ে যাত্রা শুরু করে শীঘ্রই সমৃদ্ধ সংগ্রহশালায় পরিণত হয়। এ জাদুঘরে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহীত ৩০,০০০-এরও অধিক প্রত্নতাত্ত্বিক হাতিয়ার, টেরাকোটা, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ব্রোঞ্জ শিল্পকর্ম, মুদ্রা, কাঠখোদাই কাজ, বস্ত্রশিল্প ও লোকশিল্পসমূহের নিদর্শনাদি সংরক্ষিত আছে এবং প্রদর্শিত হচ্ছে। জাদুঘরটি লোক ও গ্রামীণ শিল্প, যুগ পরিক্রমায় বাংলার পোড়ামাটি শিল্প, ভাস্কর্য ও ব্রোঞ্জ শিল্পের পূর্বভারতীয় রীতির কয়েকটি অপূর্ব সৃষ্টির চমৎকার সংগ্রহের জন্য বিশেষভাবে গর্ব করতে পারে।
পাহাড়পুর মঠ থেকে প্রাপ্ত পুরানিদর্শনসমূহ জাদুঘরের অতি মূল্যবান সংগ্রহ। পাহাড়পুর মঠটি ধর্মপাল (আনু. ৭৭০-৮১০ খ্রি.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সোমপুর মহাবিহার হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির তৎকালীন কারমাইকেল প্রফেসর ড. ভান্ডারকারের নেতৃত্বে একটি দল ১৯২২-২৩ সালে বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরের উঁচু ঢিবিতে খননকার্য শুরু করে। মঠ চত্বর থেকে উদ্ধারকৃত নানা ধরনের খোদাই করা ইট এবং পোড়ামাটির ফলকসমূহ দক্ষিণ এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতির ছাত্রদের নিকট বিশেষ আগ্রহের বিষয় হিসেবে বিবেচিত।
১৯৩৭ সালে মিউজিয়াম উত্তর দিনাজপুর জেলার বাণগড় (প্রাচীন কোটীবর্ষ) প্রত্নস্থলে নিয়মিত খননকার্যের প্রকল্প হাতে নেয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের শিক্ষক কে.জি. গোস্বামী ১৯৩৮-৪১ সালে রাজবাড়ী ঢিবির নির্ধারিত প্রত্নস্থলে খননকার্য পরিচালনা করেন। ঢিবি থেকে আবিষ্কৃত ধূসর, লাল ও মসৃণ কালো রঙের সূক্ষ্ম কারিগরিপূর্ণ জিনিসপত্র জাদুঘরে অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য জিনিসের মধ্যে ছিল রূপার ছাপাঙ্কিত ও তামার ছাঁচে ঢালা মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর ও সিল করার উপাদান, নানা পদার্থের গুটিকা এবং অলঙ্কৃত ইটসমূহ।
জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে কে.জি. গোস্বামী ১৯৪৬ সালে বীরভূম জেলার নানূরে চন্ডিদাস ঢিবিতে খননকার্য পরিচালনা করেন। এ ঢিবিতে লাল ও কালো মাটির পাত্রাদির ভাঙ্গা টুকরাসমূহ, আদি ঐতিহাসিক যুগের পোড়ামাটির ফলক ও মধ্যযুগের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। কে.জি. গোস্বামী ১৯৫৪-৫৫ সালে মেদিনীপুরের টিলডায় চাঁদপুর ঢিবিতেও পরীক্ষামূলক খননকার্য চালান। এখানে প্রাপ্ত আদি ঐতিহাসিক যুগের পোড়ামাটি ও মৃন্ময় পাত্রাদির কিছু নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৯৫৬ সালে আশুতোষ জাদুঘর উত্তর চবিবশ পরগনার অন্তর্গত বেরাচম্পার চন্দ্রকেতুগড়-এ ১৯৬৭-৬৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপক খননকার্য চালায়। প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত সমৃদ্ধ নিদর্শনগুলির মধ্যে অন্যান্য জিনিসের সাথে রয়েছে রূপার ছাপাঙ্কিত ও তামার ছাঁচে ঢালা প্রচুর মুদ্রা, মৌর্য-সুঙ্গ-কুষাণ যুগের পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর ও সিল করার উপকরণাদি এবং উত্তরাঞ্চলীয় মসৃণ কালো রঙের পণ্যসামগ্রীসহ মৃৎপাত্রাদি ও রুলেট সামগ্রী।
খননকার্য ছাড়াও মিউজিয়াম প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আবিষ্কারের লক্ষ্যে মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও পান্না এবং চবিবশ পরগনা জেলার হরিনারায়ণপুর, বোরাল, আটঘর, মাহিনগর এবং হরিরামপুরসহ ভাগীরথীর ব-দ্বীপের অনেক আদি ঐতিহাসিক স্থানসমূহ মাঝে মাঝে পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করে। এ প্রত্নস্থলগুলির প্রত্যেকটিতে তামার ছাঁচে ঢালা মুদ্রা, পোড়ামাটির ক্ষুদ্রমূর্তি, মাটির পাত্রাদির ভাঙ্গা টুকরা এবং রুলেট সামগ্রীসহ সমৃদ্ধ অনেক প্রাচীন সামগ্রী ও নিদর্শনসমূহ পাওয়া গেছে।
আশুতোষ মিউজিয়ামটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পাথরের ভাস্কর্য ও ব্রোঞ্জ নির্মিত শিল্প সমাহারের জন্য প্রসিদ্ধ। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক হতে বারো শতক পর্যন্ত সময়কালের পাথরের ভাস্কর্য এ জাদুঘরে রয়েছে। সমচাইতে পুরানো নমুনা হলো ক. দাঁড়ানো পুরুষমূর্তিসহ একটি পাথরের গরাদ এবং খ. ভারি প্যাঁচানো পাগড়িসহ দ্বাররক্ষীর মাথা। এ দুটি ভগ্ন মূর্তিই সংগৃহীত হয়েছে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরের কাছে উদয়গিরি হতে এবং এগুলি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের। উত্তর চবিবশ পরগনার চন্দ্রকেতুগড় হতে সংগৃহীত বহুবর্ণে চিত্রিত লাল বেলে পাথরের (আনুমানিক দ্বিতীয় শতক) মস্তক ও হস্তপদাদিবিহীন বুদ্ধের ক্ষুদ্র মূর্তিটি বাংলায় প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন মূর্তি। বগুড়ার মহাস্থানগড় হতে আবিষ্কৃত বেলে পাথরের কার্তিকের মস্তক বিহীন মূর্তি ও পাখির (মোরগ?) মূর্তিটি দ্বিতীয় শতকের বলে মনে হয়। শিল্প শৈলীর বিচারেই এ সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে। দক্ষিণ চবিবশ পরগনার কাশীপুরে প্রাপ্ত সূর্যের কালো পাথরের মূর্তি ছয় শতকের বলে বলা হয়; যা নন্দনতত্ত্বের নিরিখে এবং ভাস্কর্য-রীতির বিচারে গুপ্ত যুগের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল। আশুতোষ মিউজিয়ামের পাথর ও ধাতুনির্মিত বেশির ভাগ ভাস্কর্যই ছিল পাল ও সেন রাজত্বকালের সময়কার। বিহার ও বাংলা থেকে সংগৃহীত এ সকল মূর্তি আনুমানিক আট শতক থেকে বারো শতকের মধ্যে এ অঞ্চলের পাথুরে শিল্পের বিবর্তনের প্রক্রিয়া প্রদর্শন করে।
মধ্যযুগীয় সমৃদ্ধ চিত্রকলা সংগ্রহের দিক থেকে আশুতোষ মিউজিয়াম সুপরিচিত। ১১০৫ খ্রিস্টাব্দের পঞ্চরক্ষা চিত্রলিপিতে বুদ্ধের জীবনের আটটি চিত্র রয়েছে যা সমকালীন পূর্বভারতীয় চিত্রকলার ঐতিহ্যের উন্নত মানের বর্ণনা দেয়। মিউজিয়ামে আরও রয়েছে পশ্চিম ভারত থেকে সংগৃহীত বিখ্যাত জৈন চিত্রকলাসমূহ এবং সতেরো, আঠারো ও উনিশ শতকের রাজস্থান ও হিমালয়ের রাজ্যগুলির যুবরাজদের পৃষ্ঠপোষকতায় অঙ্কিত চিত্রসমূহ। এগুলি নিয়েও মিউজিয়াম গর্ব করতে পারে। এ সময়কার বাংলার আঞ্চলিক ও গ্রামীণ চিত্রকলার ঐতিহ্য নানা ধরনের চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ চিত্রাঙ্কনগুলির মধ্যে রয়েছে রঙিন মূর্তি দ্বারা পরিশোভিত গ্রন্থের মলাট, কালীঘাট পটচিত্র ও রঞ্জিত কাগজ। [নিরঞ্জন গোস্বামী]