আলোকচিত্র

আলোকচিত্র দৃষ্টিমাধ্যম শিল্পকলার একটি বড় শাখা। কোনো মাধ্যমে ধারণ করার মতো ছবি সর্বপ্রথম তৈরি হয় ১৮১৪ সালে। অ্যারিস্টটলের সময়ে (৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) গ্রিসে কোনো ছোট জিনিসকে বড় করে দেখার কাজে ও সূর্যের আলো কোনো বিন্দুতে ফোকাস করে আগুন ধরানোর জন্য লেন্স ব্যবহূত হতো। অ্যারিস্টটল নিজেও সূর্যগ্রহণের সময় অর্ধচন্দ্রাকৃতি প্রতিবিম্ব তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন, যা আসলে পিনহোল ক্যামেরার মূলসূত্র। প্রায় একইসময় চীনে মো-তি নামে একজন গবেষক আলোর একই বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী সময়ে এইচ বোস গৃহীত আলোকচিত্র (১৯০৫)

খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে ইরাকি গবেষক ইবনে আল-হাইতাম (৯৬৫-১০৩৯ খ্রি.) কায়রোতে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় কিতাব আল মানাজির নামের ৭ খন্ডের একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি আলোর ধর্ম সম্পর্কে ধারণা দেন ও আলোক রশ্মির জ্যামিতিক আচরণ ব্যাখ্যা করেন। তার এই লেখাই অপটিক লেন্স-এর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করে। পাশাপাশি তিনি প্রথমবারের মতো ক্যামেরা অবসকিউরা যন্ত্রটি তৈরি করেন, যা পিনহোল ক্যামেরার পূর্বরূপ। ল্যাটিন ভাষায় ক্যামেরা অবসকিউরা শব্দটির অর্থ অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। ১৬০৪ সালে জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার প্রথম এই নামটি ব্যবহার করেন।

ক্যামেরা অবসকিউরার মূল গঠন হলো চারকোনা একটি বাক্স যার একপাশে খুব ছোট একটি ফুটো দিয়েই কেবল আলো প্রবেশ করতে পারে। ফলে অপর পাশের দেয়ালে বাইরের দৃশ্যের একটি উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি হয়। যে দেয়ালে প্রতিবিম্ব তৈরি হয়, সে দেয়ালটির পরিবর্তে একটি অর্ধস্বচ্ছ কাগজ বসিয়ে দিলে কাগজের অর্ধস্বচ্ছ স্বভাবের জন্যই বাইরে থেকে কাগজটির ওপর প্রাকৃতিক দৃশ্যের একটি উল্টো ছবি পাওয়া যায়। পরে কয়েক শতক ধরে ক্যামেরা অবসকিউরা বিষয়ে নানা গবেষক তাদের গবেষণা চালান। এক পর্যায়ে ১৮ শতকে এতে যোগ হয় প্রতিফলক। ফলে উল্টো পাশের দেয়ালে নয়, ক্যামেরা অবসকিউরার ছাদে তৈরি হয় প্রতিবিম্ব এবং সেটি উল্টানো নয়, বরং সোজা প্রতিবিম্ব আকারেই দেখা যায়। রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে ক্যামেরা অবসকিউরা ব্যবহূত হতে থাকে পেইন্টারদের সহায়ক যন্ত্র হিসেবে, প্রাকৃতিক দৃশ্যের হুবহু প্রতিরূপ অাঁকার ক্ষেত্রে।

ঢাকা ১৯৬৯: মিছিলের অগ্রভাগের এই শিশুটি উদ্দীপত কিছু সময় পরেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। আলোকচিত্র: রশীদ তালুকদার

ইউরোপে আলোকচিত্র স্ফুরণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভারতীয় উপমহাদেশে, তৎকালীন বৃটিশ ইন্ডিয়ায় ফটোগ্রাফির চর্চা শুরু হয়। ১৯ শতকের বিভিন্ন সময়ে তোলা প্রাচীন ছবিগুলোর অধিকাংশই ছিল পারিবারিক পোরট্রেইট, ল্যান্ডস্কেপ, বিভিন্ন সংস্কৃতির রেকর্ড ও স্থাপত্যবিষয়ক। ১৮৬৩ সালে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’ স্টুডিও। বৃটিশ ভারতের বিভিন্ন শহরে এবং বৃটিশ ভারতের বাইরে লন্ডন ও প্যারিসেও ‘বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড’-এর শাখা ছিল। বৃটিশ ইন্ডিয়ার প্রথমদিকে তোলা প্রামাণ্য আলোকচিত্রগুলোর অন্যতম হল  জন ফ্যালকনারের এ শিফটিং ফোকাস। বৃটিশ লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত এ সংকলনে ১৮৫০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বৃটিশ ভারতে তোলা অধিকাংশ আলোকচিত্র স্থান পেয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে যে-সময়ে আলোকচিত্রের চর্চা শুরু হয়, প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশেও এ প্রযুক্তি চলে আসে। বাংলাদেশে দলগতভাবে আলোকচিত্রের চর্চা শুরু করেন গোলাম কাশেম ড্যাডি (১৮৯৪-১৯৯৮)। ১৯১৮ সালে গ্লাস প্লেট নেগেটিভ-এ তাঁর তোলা ছবির দলিল পাওয়া যায়। ১৯৬২ সালে তিনি ‘ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব’ (সিআরসি) নামে বাংলাদেশে আলোকচিত্রগ্রাহকদের প্রথম সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর সম্পাদনায় আলোকচিত্রবিষয়ক প্রথম বই ক্যামেরা প্রকাশিত হয়। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সহজ আলোকচিত্রণ  গ্রন্থ।

মুক্তিযুদ্ধের দলিলগুলির মধ্যে সর্ব প্রধান আলোকচিত্র। সে সময়ে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কর্মরত ফটোসাংবাদিক ও অন্যান্য আলোকচিত্রশিল্পী যুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আলোকচিত্রকরদের মধ্যে রয়েছেন রশীদ তালুকদার, মোহাম্মদ আলম, হামিদ রায়হান, আনোয়ার হোসেন, রফিকুল ইসলাম ডেভিড বার্নেট, আববাস, কিশোর পারেখ, রঘু রাই প্রমুখ।

১৯৭১: অগ্রসরমান গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা আলোকচিত্র: মোহাম্মদ আলম

মনজুর আলম বেগের নেতৃত্বে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি’ (BPS)। তাঁর প্রচেষ্টায় বিপিএস ফটোগ্রাফিবিষয়ক আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংগঠন ‘ফিয়াপ’ (The International Federation of Photographic Art)-এর সদস্যপদ লাভ করে। বর্তমানে এর ১৬টি অঙ্গসংগঠন রয়েছে। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশের প্রথম আলোকচিত্রশিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ‘বেগার্ট ইনস্টিটিউট অফ ফটোগ্রাফি’ (১৯৬০)-র প্রতিষ্ঠাতা। বাংলাদেশে ফটোগ্রাফি চর্চার ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ফিয়াপের সর্বোচ্চ সম্মাননা ইএসফিয়াপ (Excellence for Services rendered FIAP) লাভ করেন। ২০০৭ সালে তাঁকে একুশে পদক (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।

তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ফটোগ্রাফী ফরমুলা, বেগার্ট সিরিজ-১ (১৯৭৪), রঙিন প্রিন্ট করা, বেগার্ট সিরিজ-২ (১৯৮৫), মাইক্রোফিল্ম কি ও কেন (১৯৯০), আলোকচিত্রণ সাদা কালো ও রঙিন (১৯৯৩), ডার্করুম সলিউশন (১৯৯৪)।

বাংলাদেশে প্রথম ‘ফটো এজেন্সি’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। ‘দৃক পিকচার লাইব্রেরি’ নামের এ সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম ও নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ। ১৯৯৩ সালে ‘ম্যাপ’ (Makin Agency  of Photography) প্রতিষ্ঠা করেন হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন। ১৯৯৫ সালে এটি বাংলাদেশে আলোকচিত্রশিল্পিদের মালিকানাধীন প্রথম এজেন্সি হিসেবে ‘ম্যাপ ফটো এজেন্সি’ (Map Photo Agency) নাম গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে আলোকচিত্র বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের প্রথম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ‘পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফটোগ্রাফি' প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দৃক পিকচার লাইব্রেরির’ উদ্যোগে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে মাল্টিমিডিয়া বিভাগ যুক্ত হয়ে নতুন নাম হয় ‘পাঠশালা-সাউথ এশিয়ান মিডিয়া অ্যাকাডেমি’।

বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক প্রথম সংবাদ ও ফটো এজেন্সি ‘বাংলাদেশ নিউজ ২৪ আওয়ার্স লিমিটেড’। ‘বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কম’ (BdNews24.com) নামে পরিচিত এ এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে।

এশিয়াতে আলোকচিত্রবিষয়ক প্রথম উৎসব ছবি মেলা শুরু হয় বাংলাদেশে ২০০০ সালে। এটি দ্বি-বার্ষিক আয়োজন।

'মারমইডস' (১৯৮০), মানিকগঞ্জ আলোকচিত্র: আনোয়ার হোসেন

২০১০ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় শতাধিক প্রথম পুরস্কার লাভ করেছেন বাংলাদেশের আলোকচিত্রকরগণ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আনোয়ার হোসেন, রশীদ-উন-নবী শুভ্র এবং জিএমবি আকাশ, মনজুর আলম বেগ, মাহমুদ, শোয়েব ফারুকী, সৈয়দ জাকির হোসেন, শহিদুল আলম, হাসান সাইফুদ্দিন চন্দন, শফিকুল আলম কিরণ, আবীর আবদুল্লাহ, শেহজাদ নূরানী, মনিরুল ইসলাম প্রমুখ।

আনোয়ার হোসেনের (১৯৪৮- ) উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ইউনেস্কো পুরস্কার ৯টি (১৯৭৭-১৯৮৯), কমনওয়েলথ অ্যাওয়ার্ড ৯টি (১৯৭৮-১৯৮৬), ইউএন/ফিয়াপ পুরস্কার ৬টি। ফটোগ্রাফার হিসেবে পুরস্কার জেতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশের ফটোগ্রাফারগণ। আনোয়ার হোসেন ১৯৮০ সালে সাইপ্রাসে আয়োজিত কমনওয়েলথ ফটো কনটেস্টে একক জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালে সিআরওইউএস ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ফটো কনটেস্টে তিনি অন্যতম বিচারক ছিলেন। বিশ্বে ফটোসাংবাদিকতার অন্যতম শীর্ষ প্রতিযোগিতা ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো কনটেস্ট’-এ শহিদুল আলম চারবার বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৩ সালের প্রতিযোগিতায় তিনি ছিলেন জুরি বোর্ডের প্রধান। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর ইতিহাসে তিনিই প্রথম জুরি বোর্ড প্রধান যিনি ইউরোপ ও আমেরিকার বাইরের কোনো দেশের ফটোগ্রাফার। পাশাপাশি তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি এবং ডকুমেন্টারি আলোকচিত্র জগতে অন্যতম সম্মানজনক স্বীকৃতি ইউজিন স্মিথ মেমরিয়াল ফান্ড-এর অন্যতম উপদেষ্টা। জিএমবি আকাশ বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন ২০০৭ সাল থেকে। নেদারল্যান্ডে আয়োজিত ফ্রেন্ডস অফ দি আর্থ ফটো কমপিটিশনে তিনি পরপর তিন বছর অন্যতম বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বৃটেনে ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফটোগ্রাফি গালা অ্যাওয়ার্ড এবং ২০১০ সালে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ফটো কনটেস্ট ফর ফুড সিকিউরিটি প্রতিযোগিতারও অন্যতম বিচারক ছিলেন তিনি।

'সংগ্রাম' আলোকচিত্র: নওয়াজেশ আহমদ

বাংলাদেশে মনজুর আলম বেগের আলোকচিত্রবিষয়ক প্রথম গ্রন্থ আধুনিক ফটোগ্রাফি  ১৯৭৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। আনোয়ার হোসেনের ছবির বই: দি বাংলাদেশ ইমেজ (১৯৮০), এ জার্নি থ্রো বাংলাদেশ (১৯৮৮), ওমেন (১৯৯১), ঢাকা পোরট্রেইট (১৯৯১), এ ভয়েজ থ্রো বাংলাদেশ (২০০০), এ ব্যালাড অফ বাংলাদেশ (২০০৪), বাংলার প্রেম (২০১০), সোনার বাংলা (২০১০); জিএমবি আকাশের ফার্স্ট লাইট (১৯৭৪), মাহমুদের এভরি ডে ইজ অ্যানাদের ডে (২০১০), আওয়ার  ওয়ার্ল্ড-বাংলাদেশি ওমেন, রিভার লাইফ: বাংলাদেশ, ২০টি গ্রাম কুড়িগ্রাম, সৈয়দ জাকির হোসেনের সোনারগাঁ, মস্ক আর্কিটেকচার অফ বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য।

সংবাদপত্রে আলোকচিত্রবিষয়ক নিয়মিত প্রথম প্রকাশনাটি শুরু হয় যায়যায়দিন পত্রিকায়। ২০০৫ সালে সপ্তাহিক যায়যায়দিনে ক্যামেরা নামে কলাম হিসেবে এটি শুরু হয়। পরে ২০০৬ সালে এ প্রকাশনাটি দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হলে আলোকচিত্রবিষয়ক ফিচার হিসেবে ক্যামেরা পাতাটি প্রকাশিত হতে থাকে। আলোকচিত্র বিষয়ে অ্যামেচার ও তরুণ ফটোগ্রাফারদের সহায়ক এ প্রকাশনার বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আলোকচিত্রবিষয়ক সংবাদ, ক্যামেরাবিষয়ক কারিগরি আলোচনা, ফটোগ্রাফিতে মননশীলতার ব্যাখ্যা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফারদের পরিচিতি। [হাসান বিপুল]