আলী, শওকত
আলী, শওকত (১৯৩৭-২০২০) সামরিক কর্মকর্তা, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। ঐতিহাসিক আগতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ও মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শওকত আলী নবম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। শওকত আলী ১৯৩৭ সালের ২৭শে জানুয়ারি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার লোনসিংবাহের দীঘিরপার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মোবারক আলী এবং মাতার নাম মালেকা বেগম।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে পকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্ডিন্যান্স কোরে কমিশন প্রাপ্ত হন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি আইয়ুব সরকার কর্তৃক ১৯৬৮ সালে দায়েরকৃত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হন (২৬ নং আসামী)। এ মামলায় বর্তমান পাকিস্তানের মালির ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১০ই জানুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেন। একই বছর তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়।
শওকত আলী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টরে কমান্ডার ও প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া, মুজিবনগরস্থ সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে পাঠানো হয়। এ সময়ে তিনি কর্নেল পদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে অর্ডিন্যান্স সার্ভিসেসের পরিচালক ছিলেন।
সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর তিনি আইন পেশায় ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে সুপ্রীমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সদস্যপদ লাভ করেন এবং ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।
১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন শরীয়তপুর-১৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সংসদে তিনি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেনা শাসন আমলে তিনি প্রায় ১৬ মাস (মে ১৯৮২ হতে সেপ্টেম্বর ১৯৮৩) এবং চারদলীয় জোট শাসনামলে ২০০৩ সালে তিনি কারাবরণ করেন। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবরবর্তীতে পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদে শরীয়তপুর-২ আসন থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মোট ছয় বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটিতে সভাপতি ও সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পঞ্চম জাতীয় সংসদে তিনি বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটি ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া এ সংসদে পিটিশন কমিটি, সরকারি হিসাব কমিটি এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এবং বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত কমিটির সদস্য মনোনীত হন। নবম জাতীয় সংসদে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার (২৫শে জানুয়ারি ২০০৯ হতে ২৪শে জানুয়ারি ২০১৪) ও ভারপ্রাপ্ত স্পিকার (২২শে মার্চ ২০১৩ হতে ৩০শে এপ্রিল ২০১৩) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দশম জাতীয় সংসদে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।
কর্নেল শওকত আলী তাঁর জীবন-কর্ম ও রাজনীতি নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন। তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য বই হচ্ছেÑ সত্য মামলা আগরতলা, কারাগারের ডায়েরী, বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম ও আমার কিছু কথা, গণপরিষদ থেকে নবম সংসদ এবং ইংরেজি ভাষায় লিখিত আর্মড কোয়েস্ট ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স।
শওকত আলী ব্যক্তি জীবনে দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা। ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে ১৬ই নভেম্বর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে আজীবন স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে গেছেন। [শরীফ আহমদ চৌধুরী]