আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল
আমিন, বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল (১৯৩৫-১৯৭১) ১৯৩৫ সালের জুন মাসে ফেনী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাঘচাপড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারি এবং মাতা জোলেখা খাতুন। ছোটবেলায় তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় পাড়ার মক্তবে, পরে বাঘচাপড়া প্রাইমারি স্কুল এবং আমিষা পাড়া হাইস্কুলে। ১৯৫৩ সালে তিনি নৌবাহিনীতে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণের জন্য করাচির অদূরে মানোরা দ্বীপে পিএনএস কারসাজ-এ (নৌবাহিনীর কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পেশাগত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন এবং ১৯৬৫ সালে মেকানিক্যাল কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। সফলভাবে কোর্স সমাপ্তির পর তিনি ইঞ্জিন রুম আর্টিফিশার নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি চট্রগ্রামে পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে বদলি হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রুহুল আমিন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন এবং এপ্রিল মাসে ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২নং সেক্টরে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত তিনি বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে সকল সেক্টর থেকে প্রাক্তন নৌ-সেনাদের আগরতলায় সংগঠিত করে নৌবাহিনীর প্রাথমিক কাঠামো গঠন করা হয়। পরে তাদের কলকাতায় আনা হয়। সেখানে সবার সাথে রুহুল আমিনও ছিলেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দুটি টাগবোট উপহার দেয়। এগুলোকে কলকাতার গার্ডেন রীচ নৌ-ওয়ার্কশপে দুটি বাফার গান ও মাইন-পড জুড়ে গানবোটে রূপান্তর করা হয়। গানবোট দুটির নামকরণ হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। রুহুল আমিন নিয়োগ পান পলাশের ইঞ্জিন রুম আর্টিফিশার হিসেবে।
৬ ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌঘাটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে ‘পদ্মা’, ‘পলাশ’ ও মিত্র বাহিনীর গানবোট ‘পানভেল’ ভারতের হলদিয়া নৌঘাঁটি থেকে রওনা হয়। ৮ ডিসেম্বর সুন্দরবনের আড়াই বানকিতে বিএসএফের পেট্রোল ক্রাফট ‘চিত্রাঙ্গদা’ তাদের বহরে যোগ দেয়। ৯ ডিসেম্বর কোনো বাধা ছাড়াই তারা হিরণ পয়েন্টে প্রবেশ করেন।
পরদিন ১০ ডিসেম্বর ভোর ৪টায় তারা মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হন। সকাল ৭টায় কোনো বাধা ছাড়াই তারা মংলায় পৌঁছান। পেট্রোল ক্রাফট চিত্রাঙ্গদা মংলাতেই অবস্থান নেয় এবং পানভেল, পদ্মা ও পলাশ সামনে অগ্রসর হতে থাকে। দুপুর ১২টায় তারা খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি পৌঁছান। এসময় আকাশে তিনটি জঙ্গি বিমান দেখা যায়। পদ্মা ও পলাশ থেকে বিমানের উপর গুলিবর্ষণ করার অনুমতি চাইলে বহরের কমান্ডার বিমানগুলো ভারতীয় বলে জানান। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে বিমানগুলি পদ্মা ও পলাশের ওপর গুলি ও বোমা বর্ষণ শুরু করে। পলাশের কমান্ডার সবাইকে গানবোট ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু রুহুল আমিন পলাশেই অবস্থান নেন এবং আপ্রাণ চেষ্টা চালান গানবোটকে সচল রাখতে। হঠাৎ শত্রুর একটি গোলা পলাশের ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে এবং তা ধ্বংস হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে রুহুল আমিন নদীতে লাফিয়ে পড়েন এবং আহত অবস্থায় কোনক্রমে তীরে উঠতে সক্ষম হন। দুর্ভাগ্যক্রমে তীরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
মুক্তিযুদ্ধে রুহুল আমিনের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে। [কাজী সাজ্জাদ আলী জহির]