আনসার ও গ্রামরক্ষী বাহিনী
আনসার ও গ্রামরক্ষী বাহিনী গ্রামাঞ্চলে নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষায় সহায়তা দান এবং দেশের আর্থসামাজিক পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে গঠিত সরকার স্বীকৃত একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর নতুন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশাস্তরণের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এমতাবস্থায় পূর্ববঙ্গ সরকার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তদনুসারে পূর্ববঙ্গ আইনসভায় আনসার আইন ১৯৪৮ পাস হয়। এর পরই আনসার বিধিমালা (১৯৪৮) নামে প্রয়োজনীয় বিধি জারি করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আনসারদের এ সংগঠনটি জাতীয় সার্ভিস বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৭৩ সালে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (আনসার) নামে একটি পৃথক ক্যাডার গঠন করা হয়।
১৯৪৮ সাল থেকে আনসাররা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ স্থানীয় অবকাঠোমো নির্মাণে সম্পদ সংগ্রহের কাজেও সহায়তা করছে। পাকিস্তান আমলের প্রথমদিকে থানা ও পুলিশের সংখ্যা সীমিত হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আনসারদের মোতায়েন করা হতো। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে সীমান্ত এলাকা পাহারার জন্য সীমান্ত চৌকিতেও আনসার মোতায়েন করা হয়।
১৯৭১ সালে বিপুলসংখ্যক আনসার ও অফিসার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেন। ফলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক এ বাহিনীকে বেআইনি ঘোষণা করে। যেসকল আনসার ও অফিসার যথাসময়ে সরে যেতে পারেন নি তাদের অনেককে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারপ্রধানকে ১২ জন আনসার ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে। মোট ৯ জন অফিসার ও ৬৩৫ জন আনসার মু&&ক্তযুদ্ধে শহীদ হন বলে জানা যায়। যুদ্ধে অসম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য তাদের দুজন ‘বীরবিক্রম’ ও ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত হন।
আনসার বাহিনী ছাড়াও ১৯৭৬ সালে আনসার ও গ্রামরক্ষী বাহিনীর (ভিডিপি) অংশ হিসেবে আনসার ব্যাটালিয়ান গঠন করা হয়। বর্তমানে গোটা দেশে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে ৩৪টি আনসার ব্যাটালিয়ান নিয়োজিত রয়েছে। প্রতিটি গ্রামে ৩২ জন পুরুষ ও ৩২ জন মহিলাসহ মোট ৬৪ সদস্য সমন্বয়ে গ্রামরক্ষী বাহিনী গঠিত। পরবর্তীকালে শহরাঞ্চলের জন্যও শহররক্ষী বাহিনী (টিডিপি) গঠিত হয় (১৯৮০)।
১৯৯৫ সালে আনসার ও ভিডিপির তিনটি প্রধান অঙ্গসংগঠনকে আইনগত স্বীকৃতি দানের উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদ আইন পাস করে। আইনগুলো হচ্ছে আনসার বাহিনী আইন (১৯৯৫), ব্যাটালিয়ান আনসার আইন (১৯৯৫) ও গ্রামরক্ষী বাহিনী আইন (১৯৯৫)। এসব আইনের আওতায় আনসার বাহিনী ও ব্যাটালিয়ান আনসারদের সংবিধানের ১৫২ ধারাবলে সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আনসার বাহিনীর দায়িত্ব হলো সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো সংস্থাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে সহায়তা দান; দেশের আর্থসামাজিক যেকোন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং সরকারি নির্দেশ মোতাবেক অপর কোনো বাহিনীকে সহায়তা দান। আনসার ব্যাটালিয়ানের দায়িত্ব হলো দুর্যোগ মোকাবিলা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ এবং সরকারের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট আইন মোতাবেক আনসার বাহিনীর ওপর অর্পিত দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে অন্যান্য বাহিনীকে সহায়তা দান। গ্রামরক্ষী বাহিনীর কর্তব্য হলো দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকান্ডে সহায়তা, আইন-শৃঙ্খলা ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক অর্পিত অন্য যেকোন দায়িত্ব পালন।
বর্তমানে আনসার ও ভিডিপিতে ২৬১৩ জন নিয়মিত কর্মকর্তা ও কর্মচারী, প্রায় ১৪,০০০ ব্যাটালিয়ান আনসার, ১৮,০০০ অঙ্গীভূত আনসার, ৩ লক্ষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবী আনসার এবং প্রায় ৪৩ লক্ষ ভিডিপি সদস্য রয়েছে। এ সংগঠনের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত। গাজীপুর জেলার সফিপুরে একটি প্রশিক্ষণ একাডেমি, রাজধানী ঢাকার নিকটে দুটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। তদুপরি মাঠ পর্যায়ে আছে ৬টি রেঞ্জ অফিস, ৬৪টি জেলা অফিস ও ৩৪টি ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার। প্রতিটি থানায় রয়েছে একটি করে থানা অফিস এবং প্রত্যেক ইউনিয়নে ২ জন ভিডিপি ইউনিয়ন নেতা (একজন পুরুষ ও একজন মহিলা)। প্রত্যেক থানায় ১০০ আনসারের একটি করে কোম্পানি এবং প্রত্যেক ইউনিয়নে ৩২ জন স্বেচ্ছাসেবক আনসারের একটি করে প্লাটুন রয়েছে। প্রত্যেক গ্রাম/ওয়ার্ডে আছে ২ প্লাটুন ভিডিপি সদস্য, একটি পুরুষ ও একটি মহিলা প্লাটুন।
আনসার ও ভিডিপি হলো দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং দরিদ্র জনসাধারণের সহায়তার ওপর গুরুত্ব প্রদানসহ গ্রামীণ আর্থসামাজিক পরিবেশের উন্নয়ন সাধনে নিয়োজিত সর্ববৃহৎ সরকারি সংগঠন। জাতীয় নির্বাচনকালে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে আনসার-ভিডিপি সদস্যদের নিয়োগ করা হয়। ব্যাটালিয়ান আনসাররা প্রধানত জাতীয় সংহতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে থাকে। ১৯৭৬ সাল থেকে এ ব্যাটালিয়ান পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ছিল। পুলিশের সঙ্গে তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, যৌথ চিরুনি-অভিযান ও সন্ত্রাসী তৎপরতা নির্মূল কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে। আনসার বাহিনীর (অঙ্গীভূত আনসারদের) প্রধান দায়িত্ব হলো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলপথ, সেতু, বাস, লঞ্চ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে প্রহরা দেওয়া।
আনসার ও ভিডিপি সারা বছর ধরে ৪০ ধরনের বৃত্তিমূলক ও আত্মকর্মসংস্থান প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করে। এ সংগঠন সামরিক, নিরাপত্তা, সামাজিক অগ্রগতি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও গ্রহণ করে। প্রতি বছর ৩ লক্ষ নারী-পুরুষ সদস্যকে মৌলিক ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ সংগঠনের ওপর কিছু উন্নয়ন কর্মসূচি/প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বও অর্পিত আছে, যেমন ক. ডিপো হোল্ডার প্রজেক্ট (পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে), খ. বাংলাদেশ সমন্বিত পুষ্টি কর্মসূচি, গ. গ্রামীণ স্বাস্থ্যবিধান কর্মসূচি (ইউনিসেফ ও ডিপিএইচই-এর সঙ্গে যৌথভাবে), ঘ. গণশিক্ষা, ঙ. উন্নত চুল্লি প্রকল্প (বিসিএসআইআর-এর সঙ্গে যৌথভাবে), চ. প্রজনন স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ বৈষম্যবিরোধী প্রচারণা প্রকল্প (ইউএনএফপিএ-র অর্থায়নে)।
১৯৯৫ সালে প্রণীত এক আইনবলে আনসার ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। আনসার-ভিডিপি সদস্যরা এ ব্যাংকের অংশীদার। এ ব্যাংক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার-ভিডিপি সদস্যদের গ্রুপভিত্তিক ঋণ প্রদান করে।
আনসার-ভিডিপি নারীপুরুষ স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের সমান সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। আনসার-ভিডিপি পরিচালিত সকল কর্মসূচিতে মহিলা সদস্যরা পুরুষের সঙ্গে সমভাবে কাজ করছে। সংগঠনের মোট ৪৬ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী সদস্যের মধ্যে ২৩ লক্ষ হলো মহিলা। এ সংগঠন নিয়মিত দেশের সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে আনসার ও ভিডিপিকে ‘জাতীয় পতাকা’ প্রদান করা হয়। [খন্দকার মো. নূর-উন-নবী]