আনন্দমার্গ
আনন্দমার্গ হিন্দুধর্মের একটি সংস্কার আন্দোলন। ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি ভারতের বিহার প্রদেশের জামালপুর শহরে আনন্দমার্গ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রবক্তা প্রভাতরঞ্জন সরকার। জীবের মধ্যে রয়েছে অনন্তের তৃষ্ণা; ব্রহ্ম অনন্ত সত্তা; তাই ব্রহ্মভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেই জীবের সর্বতৃষ্ণার নিবৃত্তি হয়। যে মার্গ মানুষকে এ অনন্ত ব্রহ্মের দিকে অগ্রসর হতে প্রেরণা জোগায় তা-ই আনন্দমার্গ। দার্শনিক বিচারে আনন্দমার্গ বেদান্তে এবং সাধনাগত বিচারে যোগদর্শনে বিশ্বাসী। বাংলাদেশে আনন্দমার্গের অনেক অনুসারী আছে এবং ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এর মন্দির রয়েছে।
আনন্দমার্গ মনুষ্যসৃষ্ট সর্বপ্রকার ভেদনীতির বিরোধী। জীবমাত্রই বিশ্বপিতার সন্তান। জাতি-উপজাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই এক মনুষ্যজাতি; সকল মানুষের ধর্ম এক বিশ্বপিতাকে ভালোবাসা। গুরুবাদ, অবতারবাদ ও পুরোহিততন্ত্রে আনন্দমার্গের আস্থা নেই। দেবতার নামে পশুবলি, নিরীহ প্রাণীর ওপর অত্যাচার, পৌত্তলিকতা ও ধর্মক্ষেত্রে জাতিগত অধিকারভেদ আনন্দমার্গের মতে ধর্মীয় কুসংস্কার মাত্র। বিধবাবিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, আন্তঃপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক বিবাহকে আনন্দমার্গ সমর্থন করে। ভূত-প্রেতে বিশ্বাস, প্ল্যাঞ্চেট, দেবতার ভর ইত্যাদি মার্গের বিচারে মানসিক কুসংস্কার। আনন্দমার্গের মূল নীতি হলো যুগপৎ আত্মোন্নতি ও জনসেবা। আত্মোন্নতির জন্য রয়েছে সুবিন্যস্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিধিবিধান, আর জনসেবার জন্য রয়েছে Education Relief And Welfare Section (ERAWS)।
শিক্ষা সম্পর্কে আনন্দমার্গের নিজস্ব অভিমত রয়েছে। আনন্দমার্গের মতে, মানুষকে সর্বপ্রকার শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বন্ধন থেকে মুক্ত করাই হলো প্রকৃত শিক্ষা। তাই আনন্দমার্গ নিজস্ব শিক্ষাবিভাগের মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন, যুগোপযোগী পাঠক্রম তৈরি এবং মনস্তত্ত্বসম্মত পরীক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে আদর্শ শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্তনের পক্ষপাতি। ভারতে ও বহির্ভারতে বহুসংখ্যক প্রাইমারি, হাইস্কুল ও কলেজ মার্গের শিক্ষাব্যবস্থা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। মার্গের প্রধান কার্যালয় ভারতের পূর্ণিয়ার আনন্দনগরে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্ত্ততি চলছে।
মার্গের আদর্শ ও জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র পৃথিবীকে ৯টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে: দিল্লি, হংকং, ম্যানিলা, সিডনি, নিউইয়র্ক, জর্জটাউন, বার্লিন, কায়রো ও নাইরোবি। প্রত্যেক সেক্টরকে কতগুলি রিজিয়নে, রিজিয়নকে ডায়োসিসে, ডায়োসিসকে ডিস্ট্রিক্টে এবং ডিস্ট্রিক্টকে ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে এক বা একাধিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী রয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০০টি দেশে এভাবে আনন্দমার্গের কাজ চলছে।
আন্দমার্গের আর্তত্রাণ শাখার নাম Ananda Marga Universal Relief Team (AMURT)। পৃথিবীর যে-কোন দেশেই বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ে এমার্টের কর্মীরা দুঃস্থ মানুষদের সাহায্যার্থে এগিয়ে যায়। এ ছাড়াও রয়েছে বহুসংখ্যক স্থায়ী হোমস, যেমন: চিল্ড্রেনস হোম, স্টুডেন্টস হোম, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল, মূক-বধির-বিকলাঙ্গ আশ্রম, অক্ষম পুরুষ ও অক্ষম মহিলা নিবাস ইত্যাদি। মার্গের ত্যাগব্রতী কর্মী ও গৃহী সদস্যরা স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় এ কেন্দ্রগুলি পরিচালনা করে। ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, জাম্বিয়া ও ঘানাসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এমার্টের জনসেবায় সন্তুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রসংঘ এমার্টকে এনজিও হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
আনন্দমার্গের মতে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। এ আদর্শের ভিত্তিতে ১৯৬৫ সালে মার্গের নারীকল্যাণ শাখা স্থাপিত হয়। তখন থেকেই এ বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত বহু স্কুল, হোম ও নারী অভ্যুদয় কেন্দ্রের মাধ্যমে নারীসমাজ উপকৃত হচ্ছে। আনন্দমার্গের আচার্যরা বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্যও করে থাকেন। Renaissance Universal (RU) ও Renaissance Artists and Writers Association (RAWA)-এর মাধ্যমে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আনন্দমার্গ নিজস্ব চিন্তাভাবনা বাস্তবায়ন করছে। আনন্দমার্গের মতে, সাহিত্য ও শিল্পের উদ্দেশ্য মানুষের সেবা ও কল্যাণ বিধান করা। এ উদ্দেশ্যেই প্রভাতরঞ্জন রচনা করেছেন প্রায় পাঁচ হাজার গান, যা ‘প্রভাতসঙ্গীত’ নামে পরিচিত। গানগুলির সুরকার তিনি নিজেই। এভাবে সংস্কৃতির বিকাশের লক্ষ্যে আনন্দমার্গ একাধিক RAWA Academy ও RU Club স্থাপন করে খ্যাতিমান কণ্ঠশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতিসচেতন ব্যক্তিদের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও রয়েছে Prevention of Cruelty to Animals and Plants (PCAP), Society Building ইত্যাদি শাখা। বাংলাদেশে আনন্দমার্গের উপর্যুক্ত সব ধরনের কর্মকান্ডই পরিচালিত হচ্ছে।
মার্গগুরু প্রদর্শিত নব্যমানবতাবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ যাতে মনুষ্যজগৎ, প্রাণিজগৎ, এমনকি জড়জগতের সেবায়ও নিজেকে নিয়োজিত করে সেদিকে লক্ষ্য রাখাই এ বিভাগগুলির উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে আনন্দমার্গ চায় এক সর্বাত্মক নবজাগৃতি এবং বর্তমানের ক্ষয়িষ্ণু ও গতিহীন সমাজে ভাবচেতনার বিকাশ ঘটাতে। পাশ্চাত্যের মতো শুধু বৌদ্ধিক স্তরেই নয়, জীবনের সর্বস্তরেই নবজাগরণ আনা আনন্দমার্গের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। [বিজয়ানন্দ অবধূত]