আদিনা মসজিদ
আদিনা মসজিদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হযরত পান্ডুয়া বা ফিরুজাবাদে অবস্থিত। এটি কেবল বাংলায়ই নয়, গোটা উপমহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম মসজিদ। এর পেছনের দেয়ালে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি অনুসারে এটি ১৩৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ কর্তৃক নির্মিত। সিকান্দর শাহের মতো সুলতানের পক্ষে, যিনি ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে আরব ও পারস্যের সুলতানদের মধ্যে যোগ্যতম এবং পরে ‘বিশ্বাসীদের খলিফা’ বলে ঘোষণা করেছিলেন, এ ধরনের একটি মসজিদ নির্মাণ ছিল তাঁর সম্পদ ও প্রতিপত্তির স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, একজন সুলতান যিনি নিজেকে দামেস্ক, বাগদাদ, কর্ডোভা অথবা কায়রোর খলিফাদের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি ওই সকল রাজধানী শহরের মসজিদগুলির আকার ও আড়ম্বরের সঙ্গে তুলনীয় একটি মসজিদই নির্মাণ করবেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এ যে, শুধু আকার-আয়তনেই আদিনা মসজিদ ওই নগরীসমূহের মসজিদগুলির সঙ্গে তুলনীয় নয়, নকশা ও গুণগত দিকেও এটি বিশ্বের সেরা মসজিদগুলির সমকক্ষ। ‘আদর্শ’ মসজিদ পরিকল্পনায় থাকে তিনদিকে খিলান দ্বারা আচ্ছাদিত পথ এবং কিবলামুখী বিশাল প্রার্থনা কক্ষের মাঝখানে মুক্ত প্রাঙ্গন। এ বৈশিষ্ট্যগুলি আদিনা মসজিদে রয়েছে, তাই এটি একটি ‘আদর্শ’ মসজিদ।
মসজিদটির দেয়ালগুলির নিচের অংশ পাথর বাঁধানো ইট ও অন্য অংশগুলি কেবল ইটের। এর আয়তন এখনও যথার্থভাবে লিপিবদ্ধ হয় নি, তবে কোণের পলকাটা স্তম্ভসমূহসহ বাইরের দিকে প্রায় ১৫৫ মি × ৮৭ মি এবং ভেতরের দিকে খিলান আচ্ছাদিত পথসহ ১২২ মি × ৪৬ মি বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। উন্মুক্ত প্রাঙ্গনের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বদিকে ১২ মিটার প্রশস্ত খিলানপথে তিনটি ‘আইল’ এবং ২৪ মিটার প্রশস্ত প্রার্থনাকক্ষে পাঁচটি ‘আইল’ আছে, প্রার্থনা কক্ষকে বিভক্ত করেছে একটি প্রশস্ত খিলানছাদ দ্বারা আচ্ছাদিত কেন্দ্রীয় ‘নেভ’।
এর আয়তন ২১১০ মিটার এবং এক সময় উচ্চতা প্রায় ১৮ মিটার, বর্তমানে এটি পতিত। এর বিস্তারিত সমীক্ষার অনুপস্থিতিতে, প্রস্তর স্তম্ভসমূহের দ্বারা গঠিত বর্গক্ষেত্রগুলির উপর নির্মিত মসজিদের গম্বুজের সংখ্যা ৩০৬ এবং ৩৭০ বলে অনেকের ধারণা। ক্রো-এর মতানুসারে, এ সংখ্যা ২৬০। স্তম্ভগুলি ভিত্তিমূলে বর্গাকার, মধ্যস্থলে গোলাকার এবং উপরে শীর্ষস্থানের দিকে বাঁকা। প্রার্থনা কক্ষের উত্তরে খিলান দ্বারা আচ্ছাদিত পথের উপরের কয়েকটি ছাড়া গম্বুজগুলি ত্রিকোণবিশিষ্ট পেন্ডেন্টিভের উপর সংস্থাপিত। বর্তমানে পতিত গম্বুজগুলি, উল্টানো পানপাত্র আকারের ছিল যা সুলতানি আমলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কেন্দ্রীয় ‘নেভ’ খিলান দ্বারা আচ্ছাদিত পথ অপেক্ষা অনেক উঁচু এবং পিপাকৃতি ‘ভল্ট’ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল, যা এর উচ্চতার জন্য গোটা কাঠামোর উপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিল এবং অনেক দূর থেকে দেখা যেত। ‘ভল্ট’-এর সম্মুখভাগ নিয়ে অনেক মতামত রয়েছে; হয়ত এটা পারস্যদেশীয় ‘আইওয়ান’ (lwan)-এর মতো আয়তাকার কাঠামো ছিল, অথবা এর শীর্ষদেশ উন্মুক্ত বা আচ্ছাদিত ছিল। পার্শ্বস্থ অবলম্বনসমূহ ও কার্নিশসহ খিলান আচ্ছাদিত পথের খিলানগুলির নকশা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, খিলান-ছাদে অবশ্যই একটি ঈওয়ান-দ্বারপথ ছিল যা নন্দনতাত্ত্বিক দিক থেকে সম্মুখভাগের নকশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতো, এবং সে সৌন্দর্য ও গাম্ভীর্য অব্যাহত রাখতে উপরে একটি উন্মুক্ত খিলানেরও প্রয়োজন ছিল। এরকম একটি উন্মুক্ত ও উচ্চ খিলান আর্দ্র আবহাওয়ার দেশে নিশ্চয়ই উপযোগী ছিলনা, তবুও স্থাপত্য শিল্পের নিয়মনীতি অব্যাহত রাখতে গিয়ে স্থপতি অন্যরকম কিছু করতে পারেন নি। এ অসুবিধা স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করে স্থপতিগণ পরবর্তী কাজকর্মে, গৌড়-লখ্নৌতির গুণমন্ত মসজিদ (পনেরো শতকের শেষার্ধ), পুরাতন মালদা জামে মসজিদ (১৫৯৫-৯৬ খ্রিস্টাব্দ) এবং এর সমকালীন রাজমহলের জামে মসজিদের ‘ভল্টের’ খিলানের উপর পর্দা সৃষ্টির চেষ্টা করে কেবল স্থাপত্য শৈলীকেই ধ্বংস করেছেন।
কিবলা দেয়ালের সন্নিকটে কেন্দ্রীয় ‘নেভ’-এর উত্তর পাশে তিন ‘আইল’ জুড়ে একটি এলাকা এক সারিতে সাতটি মজবুত স্তম্ভের উপর পাথরের প্লাটফরম (মাকছুরা) সুলতান ও তার সঙ্গীদের প্রার্থনার স্থান হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে। প্লাটফরমটির পশ্চিম দেয়ালের উত্তর পাশে সুলতান ও তার সঙ্গী-সাথীদের প্রবেশের জন্য দুটি দেউড়ি রয়েছে। গ্যালারির প্লাটফরমটির অবশ্যই পর্দা-পাঁচিল ছিল, যা বর্তমানে বিলুপ্ত। গ্যালারিটির বর্তমান সৌন্দর্য অভ্যন্তরস্থ দশটি পলকাটা স্তম্ভ এবং সামনের দিকে খোদাইকর্ম অলঙ্কৃত, টাইলস ও ‘সুলস’ রীতির হস্তলিখন পদ্ধতিতে শিলালেখ দ্বারা সজ্জিত তিনটি মিহরাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন নকশায় বিভাজিত চিকন স্তম্ভসমূহের উপর মিহরাবগুলির খিলানসমূহ মসজিদের নিচতলার মিহরাবগুলির মতো পলকাটা। প্লাটফরমটি মসজিদের একটি উপর তলা হওয়ায় এ অংশের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে, গ্যালারির উপর নির্মিত গম্বুজগুলির উচ্চতা বাইরে থেকে দৃষ্টিগোচর হয়।
কেন্দ্রীয় ‘নেভ‘-এর উত্তর পশ্চিম কোণ এবং প্রধান মিহরাবের ডানদিকে রয়েছে এক অনিন্দ্য নিদর্শন চাঁদোয়া শোভিত মিম্বর। ধাপগুলির মধ্যে প্রায় আটটি বর্তমানে বিলুপ্ত, কিন্তু চাঁদোয়া-আচ্ছাদিত অংশের ছোট মিহরাবসহ এর পার্শ্ব দেয়ালে স্বল্পোৎকীর্ণ বিমূর্ত বৈচিত্র্য সৃষ্টিকারী নকশাসমূহ শিল্পীদের দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। পববর্তী কিছু কাজেও এ মিম্বরের প্রভাব দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, লখ্নৌতির দরসবাড়ি মসজিদ এবং ছোট পান্ডুয়ার বরী মসজিদ (স্থাপত্য আদর্শের ভিত্তিতে নির্ণীত সময়কাল পনেরো শতকের শেষার্ধ)।
আদিনা মসজিদের একটি বহুল আলোচিত অনুষঙ্গ হচ্ছে মসজিদের পেছনে সিকান্দর শাহ-এর তথাকথিত সমাধি কক্ষ। সম্ভবত পরবর্তী সময়ের একটি পাথরের শবাধার সমাধি কক্ষের মেঝেতে আবিষ্কৃত হওয়ায় বিশ শতকের গোড়ার দিকে এ কাহিনী গড়ে ওঠে। কিন্তু এ শবাধার সিকান্দার শাহ-এর সমাধি প্রস্তর হতে পারে না। এর সহজ যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ হলো প্রকোষ্ঠের মধ্য দিয়ে বিরাট প্রস্তর স্তম্ভের অবস্থান এবং শবাধারটির অবস্থান প্রকোষ্ঠের মধ্যবর্তী স্থানে নয়, মেঝের পশ্চিম প্রান্তে। বাদশাহদের কবর সাধারণত এক গম্বুজ বিশিষ্ট দালানে হয়ে থাকে এবং শাসকের দেহটি থাকে প্রকোষ্ঠের মাঝখানে এবং গম্বুজটি তার উপরে স্বর্গীয় খিলান ছাদের (vault) নিদর্শন। বর্তমান ক্ষেত্রে মধ্যস্থানে একটি গম্বুজের পরিবর্তে দালানটির উপর নয়টি সম-আকারের গম্বুজ ছিল। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো রাজকীয় গ্যালারির একই উচ্চতায় দালানটির স্তম্ভগুলির উপর একটি প্ল্যাটফরম রয়েছে এবং এতে প্রবেশের জন্য দুটি প্রবেশপথ রয়েছে। প্লাটফরমটির উত্তরপাশের পশ্চিম দিক হতে একটি সংযোগ-স্থাপক ঢালু পথ উপরে এসে মিলেছে। নিশ্চিতভাবে এটা ছিল প্রার্থনার জন্য গ্যালারিতে প্রবেশের পূর্বে রাজকীয় সহচরদের বিশ্রামস্থান। সুতরাং তথাকথিত সমাধি প্রকোষ্ঠটি মসজিদের রাজকীয় গ্যালারির একটি ‘অ্যান্টি চেম্বার’ বা দেউড়ি ব্যতীত অন্য কিছু নয়। পরবর্তীকালের মসজিদগুলিতে এ ধরনের বিস্তীর্ণ কক্ষ দেখা না গেলেও, গ্যালারিতে উঠার সিড়ির ধাপসমূহে ছোট ছোট প্লাটফরম দেখা যায়। বর্তমান ক্ষেত্রে ভূ-সমতলে বেষ্টনকৃত পেছনের দরজা দুটি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সুলতানের জন্য নয়, মসজিদের নিচতলায় অবস্থান গ্রহণকারী রক্ষীদল বা সাধারণ অনুচরদের জন্য করা হয়েছিল। পশ্চিমদিকে গম্বুজাকৃতি প্লাটফরমের কাঠামো এবং এতে আরোহণের জন্য সংযোগ-স্থাপক ঢালু পথ ও এর নিকটস্থ একটি মিনার মসজিদের এদিকটিকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে পূর্বদিকে আকর্ষক প্রবেশপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব প্রদান করা হয় নি।
মসজিদটি বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। কালের চাপ উপেক্ষা করে খিলান ছাদযুক্ত প্রবেশদ্বারসহ পশ্চিম দেয়ালের অংশবিশেষ মাত্র টিকে আছে। মসজিদটির অলঙ্করণ সম্পর্কিত বিষয়াবলি, স্তম্ভসমূহের কাঠামোগত নকশা, পেন্ডেন্টিভ, মিহরাব, সম্মুখ ভাগের টেরাকোটা, টালির অলঙ্করণ এবং হস্তলেখ শিল্পসমৃদ্ধ শিলালেখসমূহের ভগ্নাবশেষ এখনও পরিদৃষ্ট হয়। উপরিভাগের অন্যান্য অ-লেখ অলংকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থানীয় উদ্ভিজ নকশা, গোলাপ সদৃশ ফুলের নকশা, বিমূর্ত ‘অ্যারাবেক্স’ নকশা, জ্যামিতিক নকশা, বর্ণনাতীত জটিল নকশাসমূহ। এক্ষেত্রে একটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। যদিও অবস্থান ও নকশাগত দিক থেকে আলঙ্কারিক বিষয়বস্ত্তর কিছুটা সামঞ্জস্য রয়েছে, তবে কোনো একটি বিষয়ই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অপর একটির সদৃশ নয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সৃজনশীলতা। মসজিদ অলংকরণের ক্ষেত্রে কাঠামোগত এবং বহির্ভাগ, উভয় দিক হতেই, আদিনা মসজিদ একটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছে, যার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা থেকে পরবর্তীকালে সুলতানি আমলের বাংলার স্থাপত্যশিল্পে বেশ কিছু অনন্য সাধারণ ইমারত নির্মিত হয়েছে। [এ.বি.এম হোসাইন]
গ্রন্থপঞ্জি Abid Ali and HE Stapleton, Memoirs of Gaur and Pandua, Calcutta, 1931; AH Dani, Muslim Architecture in Bengal, Dhaka, 1961; George Michell ed, The Islamic Heritage of Bengal, Paris, 1984.