আকিজউদ্দীন, শেখ
আকিজউদ্দীন, শেখ (১৯২৯-২০০৬) শিল্পপতি, শিল্পোদ্যোক্তা, সমাজসেবক। শেখ আকিজউদ্দীন ১৯২৯ সালে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মাতার নাম মতিনা বেগম। পিতা শেখ মফিজউদ্দীন ধান, চাল, নারিকেল এবং নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের আড়তদারি ব্যবসা করতেন। শেখ আকিজউদ্দীন বাবা-মার একমাত্র সন্তান ছিলেন। পিতা শেখ মফিজউদ্দীনও ছিলেন তাঁর পিতামাতার একমাত্র সন্তান। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের পরিবর্তে বাবার স্বাধীন ব্যবসায়ী চেতনা আয়ত্ব করেছিলেন শেখ আকিজউদ্দীন।
১৯৪২-৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় বাড়ি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে কলকাতা আসেন। আত্মীয় পরিজনহীন বিশাল কলকাতা শহরে আকিজউদ্দীনের একমাত্র আশ্রয়স্থল হলো শিয়ালদহ রেলস্টেশন। পাইকারি দরে কমলালেবু কিনে হাওড়া ব্রিজে ফেরি করে তাঁর স্বাধীন ব্যবসাজীবন শুরু হয়। এই জন্য পুলিশকে দুই টাকা ঘুষও দিতে হয় তাঁকে। সারাদিন কমলা বিক্রি করে রাতে ক্লান্ত হয়ে শিয়ালদহ স্টেশনে বালিশ ছাড়া খবরের কাগজ বিছিয়ে ঘুমাতেন তিনি। সারাদিনের একমাত্র খাদ্য ৬ পয়সার ছাতু। একদিন স্থানীয় জাকারিয়া হোটেলের মালিকের নজরে পড়েন তিনি। তাঁর সদয় বিবেচনায় সেই হোটেলের এক পাশে আশ্রয় জোটে তাঁর। এর মধ্যে রাস্তার পাশে ভ্যান গাড়িতে মুদি দোকান দেন। দোকানের নাম ‘নিলামওয়ালা ছ’আনা’। দোকানের প্রতিটি জিনিসের দর ছিল ছ’আনা। আকিজউদ্দীন হিন্দি ভাষা রপ্ত করে হিন্দি ছড়া কেটে জিনিস বিক্রি করতেন। একদিন আকিজউদ্দীনকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। সেখানে তিন দিনের জেল ও পাঁচ টাকা জরিমানা হয় তাঁর। আকিজউদ্দীন জেল থেকে বের হয়ে পুরো দোকানটি বিক্রি করে দেন। একদিন কলকাতাতে পরিচয় হয় এক পেশোয়ারী ব্যবসায়ীর সাথে। তাঁর সঙ্গে আকিজউদ্দীন পাড়ি জমালেন পেশোয়ারে। জমানো টাকা দিয়ে নতুন করে শুরু করলেন ফলের ব্যবসা। সেই সাথে শিখে নিলেন পশতু ভাষা। এভাবে সেখানে কেটে গেলো দুই বছর। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকাল। অবশেষে দশ হাজার টাকার নগদ মুনাফা নিয়ে শেখ আকিজউদ্দীন ফিরে এলেন নিজের বাড়িতে।
১৯৫২ সালে শেখ আকিজউদ্দীন প্রথম বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসাটির ধারণা তিনি পেয়েছিলেন নিতাই চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তির নিকট থেকে। সেই সময়ের বিখ্যাত ‘বিধু’ বিড়ির মালিক বিধুভূষণ ছিলেন তাঁরই এক বন্ধুর বাবা। বিধুভূষণের অনুপ্রেরণাতেই আকিজউদ্দীন বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। তাঁর নিজ এলাকায় বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে একটি মুদি দোকান প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ১৯৫৪-৫৫ সালে এই দোকানে তাঁর মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ষাট হাজার টাকা। এক রাতে তাঁর পুরো দোকানটি পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু অচিরেই তিনি গড়ে তোলেন নতুন দোকান। এবার তাঁর মুলধনের পরিমাণ দাঁড়ায় এক লাখ টাকা। এরই পাশাপাশি আকিজউদ্দীন শুরু করেন ধান, পাট, চাল, ডাল ও গুড়ের খুচরা ব্যবসা।
ষাটের দশকে শেখ আকিজউদ্দীন চলে আসেন যশোরের সীমান্তবর্তী থানার নাভারন পুরাতন বাজারে। এখানে তিনি গড়ে তোলেন দেশের সর্ববৃহৎ আকিজ বিড়ি ফ্যাক্টরি। এরপর ধাপে ধাপে তিনি গড়ে তোলেন এস এ এফ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (১৯৬০), ঢাকা টোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (১৯৬৬), আকিজ প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (১৯৭৪), আকিজ ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি লিমিটেড (১৯৮০), নাভারন প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (১৯৮০), জেস ফার্মাসিউটিক্যালস্ লিমিটেড (১৯৮৬), আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরি লিমিটেড (১৯৯২), আকিজ জুট মিল্স লিমিটেড (১৯৯৪), আকিজ সিমেন্ট কোম্পানী লিমিটেড (১৯৯৫), আকিজ টেক্সটাইল মিল্স লিমিটেড (১৯৯৫), আকিজ পার্টিক্যাল বোর্ড মিল্স লিমিটেড (১৯৯৬), আকিজ হাউজিং লিমিটেড (১৯৯৭), সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (১৯৯৮), আকিজ ফুডস এন্ড বেভারেজ লিমিটেড (২০০০), আকিজ অনলাইন লিমিটেড (২০০০), নেবুলা ইঙ্ক লিমিটেড (২০০০), আকিজ কর্পোরেশন লিমিটেড (২০০১), আকিজ কম্পিউটার লিমিটেড (২০০১), আকিজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি লিমিটেড (২০০১), আফিল এ্যাগ্রো লিমিটেড (২০০৪) ও আফিল পেপার মিল্স লিমিটেড (২০০৫)। প্রায় বত্রিশ হাজার কর্মী তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।
শেখ আকিজউদ্দীন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি একজন সমাজসেবক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ শরীফ হোসেনের সহায়তায় ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আদ্-দ্বীন। বর্তমানে এই সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠান আদ্-দ্বীন মহিলা ও শিশু এবং চক্ষু হাসপাতাল সারাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। তাঁর অর্থায়নে পরিচালিত আকিজ কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই যশোর শিক্ষা বোর্ডের সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম বহন করে আসছে। এছাড়া একটি এতিমখানা, একটি বালিকা বিদ্যালয় ও ফোরকানিয়া প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
শেখ আকিজউদ্দীনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলনা। তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং তাঁর সকল শিল্প ইউনিটের এক একজন কর্ণধার। শেখ আকিজউদ্দীন ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। [মোহাম্মদ আবদুল মজিদ]