আইন কমিশন
আইন কমিশন বাংলাদেশে প্রচলিত আইন পুনর্নিরীক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ পেশ করার উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদে প্রণীত আইনবলে গঠিত একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এটি আইন পরামর্শক বা খসড়া প্রণয়ন সেল হিসেবে কাজ করার নিমিত্তে সরকারের কোনো শাখা নয়; এর প্রধান কাজ হচ্ছে সকল আইন সর্বদা বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা।
১৮৩৩ সালের চার্টার আইনের অধীনে ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ১৮৩৪ সালে টমাস ব্যাবিংটন মেকলের সভাপতিত্বে আইন কমিশন গঠিত হয়েছিল। অতঃপর ১৮৫৩, ১৮৬১ ও ১৮৭৯ সালে পর্যায়ক্রমে তিনটি আইন কমিশন গঠিত হয়। প্রথম আইন কমিশন ১৮৬০ সালের ভারতীয় দন্ডবিধি, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইন সূত্রবদ্ধকরণের সুপারিশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সুপারিশমালা প্রণয়ন করেন। পরবর্তী তিনটি আইন কমিশন যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলা অঞ্চলসহ ভারতবর্ষের আইনশাস্ত্রকে সমৃদ্ধ করেন। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি আইন, ১৮৯৮ সালের সাক্ষ্য আইন এবং ১৮৭২ সালের চুক্তি আইন ও সম্পত্তি হস্তান্তর আইনসহ বাংলাদেশে বলবৎ অনেক আইন উক্ত প্রথম চারটি আইন কমিশনের প্রচেষ্টার ফসল।
পাকিস্তান আমলে দুটি আইন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। এর একটি বিচারপতি এস.এ রহমানের সভাপতিত্বে ১৯৫৮ সালে গঠিত এবং অন্যটি বিচারপতি হামুদুর রহমানের সভাপতিত্বে ১৯৬৭ সালে গঠিত আইন সংস্কার কমিশন। এস.এ রহমান আইন সংস্কার কমিশন দীউয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমায় বিলম্বের কারণসমূহ পরীক্ষা করেন এবং সংশ্লিষ্ট আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর সুপারিশ করেন। হামুদুর রহমান কমিশন দীউয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমার দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে একটি সার্বিক প্রতিবেদন পেশ করেন।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেনের সভাপতিত্বে আইন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় আইন সংস্কার কমিশন গঠিত হয় বিচারপতি আলতাফ হোসেনের সভাপতিত্বে। উক্ত কমিশন অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দীউয়ানি ও ফৌজদারি আইনের পদ্ধতি পরীক্ষা করে দীউয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমায় দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কতিপয় সংশোধনী সুপারিশ করেন। ১৯৯০ সালে ব্যারিস্টার আসরারুল হোসেনের সভাপতিত্বে অপর একটি আইন কমিশন গঠিত হয়। এ কমিশন ছিল স্বল্পমেয়াদি এবং এটি ১৯০৮ সালের দীউয়ানি কার্যবিধি আইন সম্পর্কে কতিপয় সুপারিশ প্রণয়ন করে।
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার অপর একটি আইন সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেও কার্যত ১৯৯৬ সালের মে মাসের পূর্ব পর্যন্ত কোনো কমিশন গঠিত হয় নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পূর্বোক্ত প্রস্তাব মতে ১৯৯৬ সালের ২৫ মে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নইমুদ্দিন আহমেদকে সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিযুক্ত করে আইন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ৪ আগস্ট বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ফজলে কাদেরী মোহাম্মদ আবদুল মুনিম নবগঠিত আইন সংস্কার কমিশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। স্থায়ী আইন কমিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ওই বছর ৯ সেপ্টেম্বর আইন কমিশন বিল ১৯৯৬ জাতীয় সংসদে পাশ হয়। ১৯৯৬ সালের আইন কমিশন আইনের বিধান অনুসারে আইন সংস্কার কমিশনকে আইন কমিশনে রূপান্তর করা হয়। আইনটি পাশ হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আমিন-উর-রহমান খান ২২ সেপ্টেম্বর কমিশনের অপর সদস্যরূপে নিয়োগ লাভ করেন।
আইন কমিশন আইনে চেয়ারম্যানসহ অন্যূন তিন জন সদস্য সমন্বয়ে কমিশন গঠনের বিধান রয়েছে। তারা সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ নিযুক্তি লাভের তারিখ হতে তিন বছর। গুরুতর অসদাচরণ, শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণ ব্যতীত তাদের অপসারণ করা যায় না। তাদের এক বা একাধিক মেয়াদের জন্য পুনঃনিয়োগ দান করা যায়। তাদের আনুতোষিকসহ চাকুরির অন্যান্য শর্ত ও সুবিধাদি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হয়। বর্তমানে আইন কমিশন একজন চেয়ারম্যান ও দুজন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত।
১৯৯৬ সালের আইন কমিশন আইনে নির্ধারিত আইন কমিশনের উদ্দেশ্য ও কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে ১. নির্ধারিত আইনসমূহ পরীক্ষা ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করা এবং এদের সময়োপযোগী করার লক্ষে সংশোধন বা প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করা; ২. বিচার পদ্ধতির আধুনিকায়নের জন্য সংস্কারের সুপারিশ করা; ৩. বিচারক, আইনজীবী ও আইন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন; ৪. আইনের প্রয়োগহীনতা ও অপপ্রয়োগ প্রতিরোধ সম্পর্কিত বিধানের সুপারিশ করা; ৫. ফৌজদারি মোকদ্দমার দ্রুত ও দক্ষ তদন্ত নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থাদি সুপারিশ করা; ৬. আদালত প্রশাসন দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা বিষয়ে ব্যবস্থাদির সুপারিশ করা; ৭. নির্বাচনী আইন সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন; ৮. বাণিজ্যিক আইনসমূহ যেমন, কপিরাইট, ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট, আরবিট্রেশন, চুক্তি, রেজিস্ট্রেশন এবং অনুরূপ অন্যান্য আইনের সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন; ৯. নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধসহ তাদের অধিকার সুরক্ষায় উপযুক্ত আইনের সুপারিশ করা; ১০. আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে বিস্তৃততর ও কার্যকর করার লক্ষ্যে উপযুক্ত বিধানের সুপারিশ করা; ১১. অসঙ্গতিপূর্ণ, পরস্পরবিরোধী এবং কাল-অনুপযোগী আইনসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং তা বাতিলের জন্য সুপারিশ প্রণয়ন; ১২. মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ আইনসমূহ চিহ্নিত করা এবং তা রদের সুপারিশ করা; ১৩. সরকার কর্তৃক সাংবিধানিক বা আইনগত বিষয়ে প্রেরিত রেফারেন্স সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়ন এবং ১৪. আইনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণাকার্য পরিচালনা।
কোনো আইন সংশোধন বা নতুন আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত বিষয়াবলি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কমিশনের নিকট আসে। এভাবেই রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণের উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব, গণহত্যা সম্পর্কিত অপরাধ নিরোধ ও শাস্তিপ্রদান সম্পর্কিত আইন এবং ১৯৮০ সালের ন্যায়পাল আইন সরকার কর্তৃক আইন কমিশনের নিকট প্রেরিত হয়। অন্যদিকে ট্রেড মার্ক্স অ্যাক্ট, মার্চেন্ডাইস মার্ক্স অ্যাক্ট, কপিরাইট অ্যাক্ট, অ্যাডমিরালটি অ্যাক্ট, পেটেন্ট ও ডিজাইন অ্যাক্ট, ইত্যাদি পুনর্বিবেচনা ও সংশোধনের জন্য কমিশন তার দায়িত্বের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।
আইন কমিশন প্রতি বছরের শেষে পরবর্তী বছরে সংশোধন ও পর্যালোচনার জন্য গৃহীত হবে এরূপ আইনসমূহের একটি তালিকা প্রণয়ন করে। আইন কমিশন কোনো বিশেষ আইন পুনর্বিবেচনার জন্য গ্রহণ করার পর একজন সদস্যের তত্ত্বাবধানে ও এক বা একাধিক গবেষণা কর্মকর্তার সহযোগিতায় ওই বিষয়ে একটি কর্মপত্র প্রণয়ন করে। প্রণীত কর্মপত্রে আইনটির বিশ্লেষণ, কমিশনের দৃষ্টিতে আইনটির অপূর্ণতা বা অপ্রতুলতা এবং তা দূরীকরণের বা এদের প্রতিস্থাপন বা নতুন আইন প্রণয়নের বিষয়ে কমিশনের সাময়িক সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত থাকে। বিবেচ্য আইনটির সাথে সম্পর্কযুক্ত বা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণির জনগণের মধ্যে কর্মপত্রটি ব্যাপকভাবে প্রচার করে মন্তব্য ও মতামত আহবান করা হয়। কমিশন উক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ করে তাদের পরামর্শও গ্রহণ করে। প্রাপ্ত সকল মৌখিক ও লিখিত মন্তব্য বিবেচনায় এনে কমিশন চূড়ান্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। অতঃপর চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে কিনা তা সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।
১৯৯৯ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত আইন কমিশন নিম্নোক্ত আইনে বিদ্যমান বিধানাবলির পরিবর্তে নতুন আইন প্রণয়নের সুপারিশ সম্বলিত চূড়ান্ত প্রতিবেদন (প্রস্তাবিত নতুন আইনের খসড়া বিলসহ) সরকারের নিকট পেশ করে: মার্চেন্ডাইস মার্ক্স অ্যাক্ট, ১৮৮৯; কোর্টস অব অ্যাডমিরালটি অ্যাক্ট, ১৮৯১; কপিরাইট আইন, ১৯১৪; আরবিট্রেশন (প্রটোকল অ্যান্ড কনভেনশন) অ্যাক্ট, ১৯৩৭; ট্রেড মার্কস অ্যাক্ট, ১৯৪০; আরবিট্রেশন অ্যাক্ট, ১৯৪০; অর্থঋণ আদালত আইন, ১৯৯০। এগুলি ছাড়াও উপরিউক্ত সময়ে অন্যান্য যে সকল বিষয়ে আইন কমিশন মতামত ও সুপারিশ সরকারের নিকট দাখিল করে সেগুলি হচ্ছে: ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বিল, ১৯৯৬; সংবিধান (সংশোধন) বিল, ১৯৯৬ (বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বিষয়ে); প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, ১৯৮২ সংশোধন বিল; গণহত্যা অপরাধ নিরোধ ও শাস্তিদান বিষয়ক কনভেনশনের আলোকে গণহত্যা বিষয়ক আইন প্রণয়ন সম্পর্কিত প্রতিবেদন; নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেল সম্পর্কিত মতামত; ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি; ১৯০৮ সালের বিস্ফোরক দ্রব্য আইন; ১৮৭৮ সালের অস্ত্র আইন; ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ এবং ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ আইন) আইন; নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ কনভেনশন বিষয়ে মতামত; শিশু অধিকার কনভেনশন বিষয়ে মতামত; অধস্তন আদালতসমূহে মোকদ্দমার দ্রুত বিচার নিশ্চিতকরণে আশু করণীয় বিষয়ে প্রণীত প্রতিবেদন; দন্ডবিধির ‘দস্যুতা’ ও ‘ডাকাতি’ সংক্রান্ত অপরাধ বিষয়ে মতামত; ১৯০৭ সালের হেগ কনভেনশন বিষয়ে মতামত; ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ধারা ১০(১) ও ১২(১) বিষয়ে প্রতিবেদন; প্রত্যেক আইনের ইংরেজি পাঠ; ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে নতুন ধারা ১১৪-ক যুক্তকরণ বিষয়ে প্রতিবেদন; চোরাচালান দমন (গৌণ অপরাধ) আইন, ১৯৯৯ বিষয়ে মতামত; এবং ১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইন সংশোধন বিষয়ে মতামত। [নইমুদ্দিন আহমেদ]