অ্যানেস্থেশিয়া
অ্যানেস্থেশিয়া (Anesthesia) মূলত এক প্রকার নিয়ন্ত্রিত ও অস্থায়ী চেতনানাশক প্রয়োগ পদ্ধতি যা রোগীদের ব্যথা, পেশি শিথিলতা, স্মৃতিভ্রংশ হওয়া ইত্যাদি প্রতিকূল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিতে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক কোনো চিকিৎসা যন্ত্রণাহীন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করা সম্ভব। সার্বিকভাবে, তিন ধরনের অ্যানেস্থেশিয়ার প্রয়োগ হয়ে থাকে।
(ক) সাধারণ অ্যানেস্থেশিয়া এটি এক প্রকারের নিয়ন্ত্রিত চেতনানাশক প্রয়োগ পদ্ধতি যেখানে ইনজেকশন কিংবা নিঃশ্বাস-এর মাধ্যমে ওষুধ দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানোর দ্বারা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্ষমতা হ্রাস করা হয়, যার ফলে চিকিৎসাধীন ব্যক্তি চেতনা হারান। এই ধরনের অ্যানেস্থেশিয়া সাধারণত কোনো বড় ধরনের অপারেশনে (যেমন- হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, ব্রেইন বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রত্যঙ্গ) ব্যবহৃত হয়।
(খ) লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া এক্ষেত্রে শুধু চিকিৎসাধীন প্রত্যঙ্গ অসংবেদনশীল করার মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। রোগী সম্পূর্ণরূপে সজাগ থাকা সত্ত্বেও অপারেশনের সময় কোনো প্রকার ব্যথা অনুভব করেন না। এই জাতীয় চেতনানাশক স্প্রে, ড্রপ, অয়েনমেন্ট বা ইনজেকশন আকারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। দাঁত ও চোখের চিকিৎসায় এই ধরনের অ্যানেস্থেশিয়া পদ্ধতি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।
(গ) সিডেশন এই প্রক্রিয়ায় রোগীকে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় চিকিৎসা করা হয়। সংজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও রোগী কোনো প্রকার উৎকণ্ঠা অনুভবে এবং দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি ধারণে অক্ষম অবস্থায় থাকেন। কারণ চেতনানাশকের প্রয়োগের ফলে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্ষমতা কিছু পরিমাণে হ্রাস পায়।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে চিকিৎসক রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী কাক্সিক্ষত অবচেতন অবস্থা অর্জনের জন্য এক বা একাধিক ওষুধ বেছে নেন। ব্যবহৃত ওষুধগুলির মধ্যে রয়েছে সাধারণ অ্যানাস্থেটিক্স, স্থানীয় অ্যানাস্থেটিক্স, হিপনোটিক্স, ঘুমের ওষুধ, নিউরোমাসকুলার ব্লকিং ড্রাগ, অ্যানালজেসিক ইত্যাদি।
চিকিৎসা পূর্ববর্তী শারীরিক অবস্থা, যেমন- জীবন-যাপন পদ্ধতি, জিনগত রোগ, কোনোও সহবিদ্যমান রোগ বিশেষত হৃদযন্ত্র ও শ্বাসযন্ত্রের রোগ ইত্যাদি অ্যানাস্থেটিককে প্রভাবিত করতে পারে। উপরন্তু, সার্জারি সম্পর্কিত সূক্ষ্ম বিষয়গুলোও অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের জন্য বিবেচনা করা দরকার; যেমন- প্রসবের সময় অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগে অবশ্যই মা এবং শিশুর কথা বিবেচনায় রাখতে হবে।
অ্যানেস্থেশিয়া সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং জটিলতাসমূহ হলো- অসুস্থতা বা মৃত্যু, অস্ত্রোপচারের পূর্বে রোগীর শারীরিক অবস্থা, অস্ত্রোপচার পদ্ধতির জটিলতা এবং রোগীর বয়স। বমি বমি ভাব হওয়া এবং বমির মতো জটিলতার ঝুঁকি রয়েছে, বায়ুপথ সহায়তার প্রয়োজন, মূত্রনালী ধরে রাখা এবং হাইপোটেশন।
অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের পর কিছু সময় পর্যন্ত রোগীকে গুরত্বের সাথে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন কারণ তখন বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া, শ্বাসপ্রশ্বাসে জটিলতা, প্রস্রাব আটকে যাওয়া এবং নিম্নরক্তচাপের মতো জটিলতার ঝুঁকি রয়েছে। এমনকি অপারেশন শেষে পেশি নড়াচড়া করার সময় অপর্যাপ্ত তাপ উৎপাদনেও অ্যানেস্থেশিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রয়া হিসেবে দেখা দিতে পারে, যা পরবর্তীতে হাইপোথার্মিয়া, কাঁপুনি, এবং বিভ্রান্তির মতো জটিলতা তৈরি করতে পারে।
অ্যানেস্থেশিয়া প্রয়োগের পর পুনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া শুধুমাত্র ব্যক্তির শরীর হতে চেতনানাশক অপসারিত হওয়ার ফলাফল নয়, বরং মস্তিষ্কের নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বয়ংক্রিয় প্রচেষ্টা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। [মামুন রশিদ চৌধুরী]