অভ্যন্তরীণ জল সম্পদ
অভ্যন্তরীণ জল সম্পদ (Inland Water Resources) বাংলাদেশ এশিয়ার কয়েকটি বড় নদনদী, যথা ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও মেঘনা নদীর মিলনস্থল। এই নদীগুলি বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এদের অববাহিকাগুলি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্য, উত্তর ও পূর্ব অংশ এবং হিমালয় পর্বতমালাকে নিয়ে পরষ্পরের পাশাপাশি অবস্থিত। এই অববাহিকাগুলির মোট আয়তন ১০,৮৭,০০০ বর্গ কিলোমিটার। গঙ্গা নদীর উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার দক্ষিণ ঢাল থেকে, তবে এর উপনদীগুলি হিমালয় পর্বতমালা এবং মধ্য ভারতের উচ্চভূমি থেকেও উৎপন্ন হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎপত্তি হিমালয় পর্বতমালার উত্তর ঢাল থেকে, চিনের তিববতে। এর উপনদীগুলি কৈলাস পর্বত, তিববত মালভূমি, হিমালয় পর্বতমালা, নাগা পাহাড়, লুসাই পাহাড় এবং গারো ও জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। মেঘনা নদীর উপনদীগুলি এসেছে নাগা, লুসাই, গারো এবং জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ নদী গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার উপনদী অথবা শাখা নদী। একটি কাল্পনিক রেখা ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উত্তর বঙ্গের ভেতর দিয়ে গারো পাহাড়কে সংযুক্ত করে বাংলার সমভূমিকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারে, একটি উজানের একটি ভাটির। উত্তর পশ্চিম ও উত্তর দিকে উজানের অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সকল উপনদীসমূহের অবস্থান। দক্ষিণ দিকের ভাটির অংশে এই দু’টি নদীর শাখানদীসমূহের অবস্থান। তবে এই সমভূমির পুর্বের অংশে মেঘনা নদীর উপনদীগুলির অবস্থান। বাংলার সমভুমিতে কিছু স্বয়ংসম্পূর্ণ নদী পশ্চিমে ছোটনাগপুর থেকে উৎপন্ন হয়ে এবং পূর্বে লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে সরাসরি সাগরে গিয়ে মিশেছে।
বাংলার সমভূমি প্রধান দু’টি দেশে বিভক্ত, ভারত ও বাংলাদেশ, এবং এর অংশত ভূটান ও নেপাল এর এলাকা। এই ভাগাভাগি কোনো প্রাকৃতিক কারণে হয়নি, বরং রাজনৈতিক কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই আমরা দেখি ধরলা নদী ভূটান থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে। মেচী নদী নেপাল থেকে উৎপন্ন হয়ে মহানন্দা নদীতে পড়েছে। মহানন্দা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে গঙ্গা নদীতে পড়েছে। কয়েকটি নদী যথা- মহানন্দা, পুনর্ভবা বাংলাদেশে উৎপন্ন হয়ে ভারতে ঢুকে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এভাবে বাংলাদেশে সৃজিত জলসম্পদের অনেকটাই এইসকল দেশের সাথে পরষ্পর নির্ভরশীল।
ভূপরিস্থ জল বাংলাদেশের ভূপরিস্থ জল সম্পদ বলতে এই দেশের উপর পতিত বৃষ্টিপাত এবং বহির্দেশ থেকে আগত জলপ্রবাহ বলতে বুঝায়। বাংলাদেশের উপর বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২৩০০ মিলিমিটার, যা’ প্রায় ২৭৬ মিলিয়ন একর ফিট জলসম্পদ সৃষ্টি করে। সীমান্তের ওপার থেকে আসা জলপ্রবাহের মাধ্যমে সৃষ্ট জলসম্পদের পরিমাণ ৮১৮ মিলিয়ন একর ফিট। এভাবে সারাবছর বাংলাদেশে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন একর ফিট বা ১৩৫০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল সম্পদ সৃষ্টি হয় (তথ্য সূত্র- বাংলাদেশ ওয়াটার ভিশন ২০২৫, বাংলাদেশ ওয়াটার পার্টনারশীপ)। তবে এই বিশাল জলসম্পদের অনেকটাই বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়, যা’ নদীসমূহের মোহনায় মিষ্টি ও লবনাক্ত জল মিশ্রিত ঘোলাজল প্রতিবেশ সৃষ্টি করে। এই জল প্রবাহ বছরে প্রায় ১৪০০ মিলিয়ন টন পলি নিয়ে আসে যা’ নদী সমূহের প্লাবন ভূমি ও সাগরে জমা হয়। বাংলাদেশের ভূপরিস্থ জল সম্পদ এই দেশের মানুষ, ভূপরিস্থ জীব ও উদ্ভিদ, এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবন যাপনের জন্যে, এবং নৌ চলাচল ও কৃষি ইত্যাদির জন্যে অপরিহার্য। এই জল সম্পদ সারা বছর বদ্বীপ এলাকার শাখানদী সমূহের প্রবাহ অব্যাহত রাখা এবং সমুদ্র তীরবর্তী মোহনার জীব প্রতিবেশকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যও অপরিহার্য। বাংলাদেশের পৃষ্ঠ থেকে বাৎসরিক গড় খোলাজল বাষ্পীভবনের পরিমাণ ১২৫০ মিলিমিটার।
ভূপরিস্থ জলের ওঠানামা পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০ এই বোর্ডকে সমগ্র দেশের জল সম্পদের পর্যবেক্ষণ করা ও রেকর্ড রাখার পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজটি তার পানি বিজ্ঞান অধিদপ্তরের মাধ্যমে করে থাকে। এই অধিদপ্তরের অধীনে ৩৪৩ টি নদী জল সমতা পরিমাপ খুঁটি আছে। এই খুঁটিগুলি থেকে ঘন্টাপ্রতি সারা বছর নদীর জল সমতা পরিমাপ করা হয়। এই অধিদপ্তরের অধীনে ১১০ টি নদী জল প্রবাহ পরিমাপ স্থান আছে। এই স্থানগুলি থেকে সপ্তাহ অথবা দুই সপ্তাহ প্রতি সারা বছর নদীর প্রবাহ পরিমাপ করা হয়। এছাড়াও এই অধিদপ্তরের অধীনে ২৬৯ টি বৃষ্টিপাত এবং ৩৯টি খোলাজল বাষ্পীভবন পরিমাপ কেন্দ্র আছে।
বাংলাদেশের ভূপরিস্থ জলের ওঠানামা নদীগুলিতে প্রায়ই লক্ষ করা যায়। এই ওঠানামা ঋতুভিত্তিক বৃষ্টিপাতের তারতম্যের কারণে এবং উজান থেকে আসা জলপ্রবাহের তারতম্যের কারণে পরিলক্ষিত হয়। বৃষ্টিপাত শীত, বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে খুবই কম হয়, যখন সেচের জন্যে জলের প্রয়োজন অনেক বেশী থাকে। কিন্তু সীমান্তের ওপারে ভারত সকল আন্তর্দেশীয় নদীগুলির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে ও পানি সরিয়ে নেয়। বাংলাদেশে সেচের জন্যে নদীগুলির বাকী প্রবাহ এবং ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেয়ায় অনেক নদী শুকিয়ে যায় এবং জলাভূমিগুলির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। ভূপরিস্থ জলের পর্যবেক্ষণ তাই পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে অতি জরুরী। এপর্যন্ত ৫৪টি নদী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তর্দেশীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই দুই দেশের মধ্যে একটি যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) আছে যা’ এই নদীগুলির প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে এই নদীগুলির উপর কোনরকম অবৈধ হস্তক্ষেপ হচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখে। জেআরসি আন্তর্দেশীয় জলসম্পদের ব্যবহার নিয়ে এই দুই দেশের বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্যেও কাজ করে। এরই একটা গুরুত্বপূর্ণ ফল গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি ১৯৯৬।
ভূপরিস্থ জলের আধার বাংলাদেশের নদী ও জলাভূমিগুলি এই দেশের বিশাল জল সম্পদের ক্ষেত্র এবং আধার। জলাভূমিগুলিকে বিল ও হাওর বলা হয়, যা’ নদীসমূহের প্রবাহপথের পরিবর্তন, বিভিন্ন সময়ের ভূ-আন্দোলন এবং ভূমির বসে যাওয়ার কারণে নিম্নভূমি হিসেবে পরিণত। মুক্ত জলের ক্ষেত্রগুলি শুকনা মৌসুমে জলের আধার হিসেবে থাকে এবং এদের থেকে নিষ্কাশিত প্রবাহ ভাটির নদীগুলির তলানি প্রবাহে যোগান দেয়। অনেক নদীর প্রবাহপথে ডাঙ্গায় তাদের প্লাবন ভূমি থাকে, যে এলাকা বর্ষা ও শরৎকালে ডুবে যায়। এইসকল জলের আধারগুলি তাদের সংযোগকারী নদীগুলির জল সমতার ওঠা নামার তারতম্যের কারণে কম বেশী হতে থাকে।
বদ্ধ জলের আধারগুলির মধ্যে বাওড় সমূহের অবস্থান বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে। এগুলি হ্রদের মতো নদীর মৃত অংশের অশ্ব খুরাকৃতি বাঁক। তবে বাংলাদেশের ভূপরিস্থ জলের ঐতিহ্যবাহী আধার হচ্ছে সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এর পুকুরসমূহ। গ্রামের লোকজন তাদের জীবনের দৈনন্দিন জল চাহিদা মেটানোর জন্যে এই পুকুরগুলি খনন করে। সমুদ্র তটবর্তী লবনাক্ত অঞ্চলে বেড়ী বাঁধের ভেতরে বৃষ্টির পানি আটকে রেখে ফসল ও ও লোকজনের চাহিদা মেটানো হয়। এই বদ্ধজলগুলির আধার ভূগর্ভস্থ জল স্তরের ওঠানামার উপর কম বেশী হতে থাকে। বাংলাদেশে কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাইতে ড্যাম দিয়ে একটি কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টি করা হয়েছে যার ধারন ক্ষমতা ৮.২৫ মিলিযন একর ফিট। এই ড্যাম জল বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এবং কর্ণফুলী নদীর অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে। ফেনী নদীর উপর সোনাগাজীতে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করায় এর উজানে মিষ্টি পানির একটি জলাধার সৃষ্টি হয়েছে, যার ধারন ক্ষমতা ১.২ মিলিয়ন একর ফিট।
ভূপরিস্থ জলের প্রত্যাহার ভারত কর্তৃক তিনটি আন্তর্দেশীয় নদীর প্রবাহ প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের ভূপরিস্থ জল সম্পদ প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গঙ্গা নদীর প্রবাহ ফারাক্কার নিকট একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে বাধা দেয়া হয়েছে এবং এই নদীর জলপ্রবাহের একটা বড় অংশ প্রত্যাহার করে সংযোগ খালের মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গের ভাগিরথী নদীতে চালান করা হচ্ছে। একইভাবে তিস্তা নদীর প্রবাহ গজলডোবার কাছে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে বাধা দেয়া হয়েছে, এবং এই নদীর পানি সেচখালের মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারে চালান করা হচ্ছে। ভারত এভাবে আরও অনেক ছোট ছোট আন্তর্দেশীয় নদীর জল প্রবাহ প্রত্যাহার করে নেয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি হয়েছে এবং তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা চলছে। ভারত পশ্চিম বঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় আত্রাই ও পুনর্ভবা নদীর পানি বাঁধ দিয়ে প্রত্যাহার করে, এবং এভাবে নদীয়ায় ভৈরব নদীর পানি, এবং উত্তর চবিবশ পরগণায় বেতনা ও কোদলা নদীর পানি প্রত্যাহার করে। ভারত ফেনী, গোমতি, বিজনী, খোয়াই, মনু এবং বরাক নদের কিছু উপনদীর পানি জলকাঠামো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যাহার করে। এই কারণে সকল আন্তর্দেশীয় নদীর জল বন্টন করার বিষয়টি বাংলাদেশের তরফ থেকে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে নিয়মিতভাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের ভেতরে সেচের জন্যে জল প্রত্যাহার ও জলাধার তৈরির জন্যে বেশ কয়েকটি ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। উত্তর বাংলাদেশের তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্যে তিস্তা নদীর উপর একটি ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে যার জল প্রত্যাহার ক্ষমতা ১০,০০০ কিউসেক। উত্তর পূর্ব বাংলাদেশের মনু নদীর উপর একই ধরনের একটি ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। মনু সেচ প্রকল্পের জন্যে নির্মিত এর প্রত্যাহার ক্ষমতা ৫৩০ কিউসেক। ঠাকুরগাঁও জেলায় টাঙ্গণ নদীর উপর এবং নীলফামারী জেলায় বুড়ি তিস্তা নদীর উপর জলাধার তৈরী ও সেচের জন্যে ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। গঙ্গা নদীর ডান তীরে ভেড়ামারার নিকট একটি পাম্প হাউজ আছে, যা’ ৪৪০০ কিউসেক পানি উত্তোলন করে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ এবং মাগুরা জেলায় বিস্তৃত জিকে সেচ প্রকল্পের এলাকায় জল সরবরাহ করতে পারে।
বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রত্যাহারের জন্যে এবং নৌ চলাচলের জন্যে ঐতিহাসিকভাবে অনেক খাল কাটা হয়েছিলো। এইসকল খাল নদীর গতিপথ ভিন্ন পথে প্রবাহিত করে দেয়। উত্তর বাংলাদেশে কাটা খাল করতোয়া নদীর মূল প্রবাহ বাঙ্গালী নদীতে ঘুরিয়ে দেয়। দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের মাথাভাঙ্গা নদী হচ্ছে একটি কাটা খাল যা’ মৃতপ্রায় ভৈরব নদীকে বাঁচানোর জন্যে কুমার/নবগঙ্গা নদী থেকে সংযোগ দেয়া হয়েছিলো। এই খাল নবগঙ্গা নদীকে মেরে দেয়। গজনবী কাট নামের একটি কাটা খাল নবগঙ্গা নদীর প্রবাহমুখ উন্মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। দক্ষিণে খুলনা শহরের দিকে নৌ চলাচলের জন্য কাটা হ্যালিফ্যাক্স কাট মধূমতি নদীর ৮০% প্রবাহ নবগঙ্গা নদীর দিকে ঘুরিয়ে দেয়। নৌ চলাচলের জন্যে কাটা খাল মাদারীপুর বিল রূট কুমার নদী প্রবাহের প্রায় সবটা মধুমতি নদীর দিকে ঘুরিয়ে দেয়। নবাবগঞ্জের বররাহ নৌ চলাচল খালটি ইছামতি নদীর সমস্ত প্রবাহ ভাঙ্গাভিটা নদীতে চালান করে দিয়েছে। টোক থেকে বর্মী বাজারে যোগাযোগকারী নৌ খালটি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর মূল প্রবাহ বানার নদীর দিকে ঘুরিয়ে দেয়।
ভূপরিস্থ জলের যোগান সাম্প্রতিক কালে নদী সমুহের গতিপথ পরিবর্তন ভূপরিস্থ জলের প্রচুর ক্ষতি করেছে, বিশেষ করে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশে এটি ঘটেছে। চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলায় চিত্রা নদী, যশোর জেলায় কপোতাক্ষ ও বেতনা নদী, খুলনা জেলায় হরিহর, ভদ্রা এবং মুক্তেশ্বরী নদী, এবং সাতক্ষীরা জেলায় মরিচাপ নদ ভৈরব নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মরে গেছে। এর ফলে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশে ক্ষরা হয়েছে ও লবনাক্ততা গভীর উজানে ঢুকে পড়েছে। কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ধলেশ্বরী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে মাণিকগঞ্জ ও ঢাকা জেলায় এর অনেক পুরাতন খাড়ি শুকিয়ে গেছে। বিগত শতাব্দীর ষাটের ও সত্তুরের দশকে মৃত নদীগুলিকে পুনঃখনন করা ও সেগুলিকে কোনো বছরব্যাপী সচল নদীর সাথে সংযুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রকল্প অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ চেষ্টাই পরিস্থিতি আরও খারাপ করেছে। এসব চেষ্টা অববাহিকায় অতি নিষ্কাশন করেছে, ভূতলস্থ প্রবাহকে উন্মুক্ত করেছে এবং খোলাজল বাষ্পীভবন বাড়িয়েছে।
সেচ কাজের জনপ্রিয়তার সাথে নদীগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার দ্বিতীয় পর্যায়ের চেষ্টা শুরু হয়। সত্তুরের দশকের শেষ ও আশির দশকে সারা দেশে ব্যাপক খাল খনন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। বছরব্যাপী সচল নদী থেকে পানি তুলে কাটা খালে প্রবাহ করা হলো, এবং সেখান থেকে দ্বিতীয়বার তুলে মাঠে দেয়া হলো। যদিও, অতি উত্তোলনের ফলে বহু নদী ও খাল শুকিয়ে গেলো, খোলাজল বাষ্পীভবন বাড়লো এবং বালি মাটির জমিতে যত্রতত্র সরবরাহকৃত পানি গভীরে চুইয়ে নষ্ট হলো।
ধারনা করা হয় ভারত কর্তৃক নদীগুলির উজানে বিশেষ করে গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের নদীগুলির প্রবাহ কমে গেছে। এবং এটাও ধারনা করা হয় যে, যদি আরও উজানে নেপালে জলাধার করে পানি ধরে রাখা যায়, তা শুকনার সময় ভাটিতে যোগান দিতে পারবে। যদিও, বাংলাদেশের এই ধারনা একই অববাহিকার শক্তিশালী দেশ ভারত গ্রহণ করে না। ভারত অপরপক্ষে ব্রহ্মপুত্র, সংকোশ, দুধকুমার ও ধরলা নদীর পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের ভূমির উপর দিয়ে খাল কেটে ফারাক্কা পয়েন্টে যোগান দেবার কথা বলে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে উত্তরের প্রচুর পরিমাণ চাষযোগ্য জমি চলে যাবে, তাই বাংলাদেশ তা’ মানেনি। ভারত এখন নদী সংযোগ পরিকল্পনার নামে একটি নতুন প্রস্তাব এনেছে। এই প্রস্তাবে ভারত তার পশ্চিম ও দক্ষিণের শুকনো অঞ্চলগুলি উত্তর পূর্বের বৃষ্টিবহুল এলাকার সাথে খাল কেটে সংযোগ দিতে চায়। বাংলাদেশ ভারতের এই প্রস্তাবকে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করে, কারণ এর ফলে বাংলাদেশের হাজার হাজার বছরের পানি নির্ভর প্রকৃতি ও প্রতিবেশ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের একমাত্র অভ্যন্তরীণ জলাধার আছে কর্ণফুলী নদীর উপর কাপ্তাইয়ে। এই জলাধারের পানি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার হয়, তাই ভাটিতে জল সম্পদ যোগানের কাজে ব্যবহার সম্ভব নয়। উত্তরে তিস্তা ও টাঙ্গণ নদী, উত্তর পূর্বে মনু নদী এবং দক্ষিণ পশ্চিমে নবগঙ্গা নদীর উপর নির্মিত ব্যারেজগুলি অল্প ধারন ক্ষমতার হওয়ায় ভাটিতে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। সম্প্রতি মাতামুহুরী, ভোগাই কংস এবং অন্য কিছু ছোট নদীর উপর রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়েছে। এইসকল ড্যামের জল সেচের জন্যে ব্যবহার হয়, ভাটিতে যোগান দেবার জন্যে নয়।
উপকূলীয় জল বাংলাদেশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর শত শত শাখানদী আছে, যারা সাগরের পথে অজস্র ছোট বড় খাড়ি তৈরী করেছে। এই খাড়িগুলির একেকটিতে লবনাক্ততার মাত্রা একেক রকম যা’ উজান থেকে মিষ্টি পানি সরবরাহের উপর নির্ভর করে। এগুলি খোলাজল ক্ষেত্র যা’ প্রায় ৫০০,০০০ হেক্টর এলাকা। খাড়িগুলির জল সম্পদের গুণাগুণ লবনাক্ততা এবং পলির মিশ্রণের উপর নির্ভর করে তাই তা’ বছরের নানা সময়ে একেকটি খাড়িতে একেক রকম থাকে। বর্ষা ও শরৎকালে লবনাক্ততা সাগরের কাছাকাছি থাকে, কিন্তু খাড়িগুলির পানি কম বেশী পলিপূর্ণ থাকে যা’ উজান থেকে আসে। হেমন্ত ও শীতকালে পানি পলিমুক্ত হয়ে যায়; কিন্তু মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবনাক্ততা উজানের দিকে ধেয়ে যায় ও মিষ্টি পানির ফসলে ক্ষতি করে। সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায় এই সময় উজান থেকে কোনো মিষ্টি পানির প্রবাহ আসে না। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে জোয়ার ভাটার অত্যধিক উঠানামার কারণে খাড়িগুলির তলদেশ ও পাড় ভেঙ্গে খাড়ির পানি ঘোলা করে দেয়।
বাংলাদেশের খাড়িসমূহের উপকূলীয় জলে সারা বছর প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। প্রধান খাড়িগুলি ইলিশ মাছের ডিম ছাড়ার স্থান, যা স্বাদের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে লবনাক্ত জলের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গড়ান বন, সুন্দরবন এর অবস্থান। এই সুন্দরবনের এলাকায় কিছু মাছ পাওয়া যায়, যা’ কেবলমাত্র এখানেই পাওয়া যায়। উপকূলীয় পোল্ডারগুলির ভেতরে অবস্থিত নিম্নভূমিগুলি মিষ্টি জলের প্রধান ক্ষেত্র, যার চারপাশে জন সাধারণ বাস করে ও চাষাবাদ করে। এই ভূমিগুলি গড় সমুদ্র তল থেকে ১ থেকে ২ মিটার উঁচু, যা’ জোয়ার কিংবা জলোচ্ছাসে ডুবে যেতে পারে। তাই উপকূলীয় বাঁধগুলি এসকল বসতি এলাকার জন্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যা লোনা জল বা জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপকে বাধা দেয়। এই বাঁধগুলির বিভিন্ন স্থানে ফ্লাসিং স্লুইসের মাধ্যমে বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করে দেয়া হয়। জনগণ পোল্ডারের ভেতরে পুকুর কাটে, যেখানে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রেখে সারাবছর খাওয়া ও বেuঁচ থাকার অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে। এভাবে উপকূলীয় এলাকায় দুটি ভিন্ন ধরনের প্রকৃতি ও প্রতিবেশ কাজ করে, যার একটি বাঁধের বাইরে নদীর ভেতরে লবনাক্ত জলের বাতাবরণে এবং অন্যটি বাঁধের ভেতরে পোল্ডার এলাকাগুলিতে মিষ্টি পানির বাতাবরণে। [ম. ইনামুল হক]