অভেদানন্দ, স্বামী
অভেদানন্দ, স্বামী (১৮৬৬-১৯৩৯) হিন্দুধর্মের একজন প্রবক্তা। ১৮৬৬ সালের ২ অক্টোবর কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম কালীপ্রসাদ চন্দ। কলকাতার সংস্কৃত বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবনের যাত্রা শুরু; পরে তিনি এন্ট্রান্স পাস করেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারি থেকে।
বাল্যকাল থেকেই অভেদানন্দের ধর্মের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল; প্রথম যৌবনে হিন্দুশাস্ত্রাদি অধ্যয়নে সে অনুরাগ আরও বৃদ্ধি পায়। ওই সময় রেভা. ম্যাকডোরেন্ড, রেভা. কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের সান্নিধ্যের ফলে খ্রিস্টধর্মের প্রতিও তিনি অনুরাগী হয়ে পড়েন। পাশাপাশি কেশবচন্দ্র সেন, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ ব্রাহ্মনেতার বক্তৃতা এবং বিশিষ্ট দার্শনিক শশধর তর্কচূড়ামণির ষড়দর্শনের আলোচনা শুনে হিন্দুদর্শনের প্রতিও তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন। পন্ডিত কালীবর বেদান্তবাগীশের নিকট পতঞ্জলির যোগসূত্র অধ্যয়ন করে তিনি হঠযোগ ও রাজযোগ চর্চা করেন। এ সময় (১৮৮৪) তিনি দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৮৮৬ সালে পরমহংসদেবের তিরোধান ঘটলে অভেদানন্দ সন্ন্যাস অবলম্বনপূর্বক হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত সব তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করেন। এতে হিন্দুধর্মের আচার-আচরণ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায়।
স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন অভেদানন্দের সতীর্থ। তাঁরই আহবানে ১৮৯৬ সালে তিনি ইংল্যান্ড গেলে সেখানে তাঁর পরিচয় ঘটে পল ডয়সন, ম্যাক্সমুলার প্রমুখ মনীষীর সঙ্গে। ইংল্যান্ডে তিনি রাজযোগ, জ্ঞানযোগ ও বেদান্ত সম্পর্কে নিয়মিত বক্তৃতা দেন। সেখান থেকে ১৮৯৭ সালে আমেরিকা গিয়ে তিনি নিউইয়র্কের বেদান্ত আশ্রমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ সালে সেখানে তাঁর পরিচয় হয় প্রখ্যাত দার্শনিক উইলিয়ম জেমসের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে তিনি ‘বহুত্বের মধ্যে একত্ব’ বিষয়ে আলোচনা করেন। ১৯০৬ সালে একবার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে পুনরায় তিনি হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় দর্শন প্রচারের উদ্দেশ্যে আমেরিকা, কানাডা, মেক্সিকো, জাপান, হংকং প্রভৃতি দেশ ভ্রমণ করেন। ১৯২১ সালে হনলুলুতে প্যান-প্যাসিফিক শিক্ষা সম্মেলনে যোগদানের পর তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯২২ সালে কাশ্মীর হয়ে তিববত যাওয়ার পথে লাকাদের বৌদ্ধ মন্দির হেমিসগুম্ফায় তিনি যিশুখ্রিস্টের অজ্ঞাত জীবনীর কিছু অংশ উদ্ধার করেন। এটি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পরে তাঁর এ মূল্যবান আবিষ্কার তাঁর কাশ্মীর ও তিববতে গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে কলকাতায় ফিরে তিনি ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত সোসাইটি’ এবং ১৯২৪ সালে দার্জিলিঙে ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বামী অভেদানন্দ হিন্দুধর্ম সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলির মধ্যে: Gospel of Ramakrishna, Reincarnation, How to be a Yogi, India and her People, আত্মবিকাশ, বেদান্তবাণী, হিন্দুধর্মে নারীর স্থান, মনের বিচিত্র রূপ প্রভৃতি উল্লেখযেগ্য। তিনি বিশ্ববাণী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, যা ১৯২৭-১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এর এক বছর পর ১৯৩৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দার্জিলিঙের বেদান্ত আশ্রমে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। [দুলাল ভৌমিক]