পান

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:৫১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পান পিপুল পরিবারভুক্ত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের একপ্রকার গুল্মজাতীয় গাছের পাতা। আর্য এবং আরবগণ পানকে তাম্বুল নামে অভিহিত করত। নিশ্বাসকে সুরভিত করা এবং ঠোঁট ও জিহবাকে লাল করার জন্য মানুষ পান খায়। অবশ্য পানে কিছুটা মাদকতার আনন্দও বিদ্যমান। প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশসমূহ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মানুষ পান খায়। কেবল স্বভাব হিসেবেই নয়, বাংলাদেশে ঐতিহ্যগতভাবে সামাজিক রীতি, ভদ্রতা এবং আচার-আচরণের অংশ হিসেবেই পানের ব্যবহার চলে আসছে। অনুষ্ঠানাদিতে পান পরিবেশন দ্বারা প্রস্থানের সময় ইঙ্গিত করা হয়। এক সময় উৎসব, পূজা ও পুণ্যাহে পান ছিল অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন অভিজাত জনগোষ্ঠীর মাঝে পান তৈরি এবং তা সুন্দরভাবে পানদানিতে সাজানো লোকজ শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেত।

পানের বরজ

পান চাষাবাদ অতীতে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলেই পানচাষ করা হতো, যদিও পান উৎপাদনের ক্ষেত্রে দিনাজপুর, রংপুর, মেদিনীপুর (পশ্চিমবঙ্গে), চট্টগ্রাম ইত্যাদি জেলা ছিল বিখ্যাত। পানচাষের জন্য যেমন বিশেষ ধরনের জমির প্রয়োজন তেমনি প্রচুর যত্নেরও দরকার হয়। পানচাষের জন্য নির্বাচিত জমি সাধারণত একটু উঁচু, মাটির ধরন শক্ত এবং জলাশয় ও পুকুর ইত্যাদির ধারেকাছে হওয়া বাঞ্ছনীয়। পানের বাগানকে বলা হয় বরজ এবং একটি বরজের আয়তন সাধারণত বারো থেকে কুড়ি শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকে। পানের বরজ তৈরির জন্য পাশের কোন জমি থেকে মাটি কেটে বরজের স্থানে ফেলে জায়গাটিকে উঁচু করে নিতে হয়। প্রথাগতভাবে বরজে সরিষার খৈল ও গোবরকে সার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে প্রচলিত জৈবসারের সাথে রাসায়নিক সারও ব্যবহূত হচ্ছে। চাষের উপযোগী করে জমিকে তৈরি করার পর মে ও জুন মাসে পানের লতা রোপণ করা হয়। মাঝখানে দুই ফুট দূরত্ব রেখে চারাগুলি সমান্তরাল লাইনে রোপণ করা হয় এবং পরে বাঁশের শলা বা খুঁটি পুঁতে তার সাথে পানের লতাগুলি জড়িয়ে দেওয়া হয়।

রোদ এবং গরু-ছাগলের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বরজের চারদিকে ৫/৬ ফুট উঁচু করে বাঁশের শলা ও খুঁটি দিয়ে বেড়া এবং একই সামগ্রী দিয়ে উপরে মাচান তৈরি করা হয়। শুকনা মৌসুমে পান গাছে নিয়মিত পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। চারা রোপণের এক বছর পর পান আহরণের উপযোগী হয় এবং বরজ তৈরির পর কয়েক বছর পর্যন্ত তা থেকে উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

সাধারণত বছরে পানের তিনটি ফলন হয় এবং যে মাসে পান আহরণ করা হয়, স্থানীয়ভাবে সে মাসের নামানুসারে এসব মৌসুমের নামকরণ হয়ে থাকে। তবে সাধারণত কার্তিক, ফাল্গুন এবং আষাঢ় মাসে পান আহরণ করা হয়। পানসেবীদের বিচারে কার্তিকের পান আষাঢ়ের পানের চেয়ে সুস্বাদু। পান গাছে কমপক্ষে ষোলটি পান রেখে বাকি পান পাতা আহরণের নিয়ম। পাতার আকার, কোমলতা, ঝাঁজ, সুগন্ধ ইত্যাদির বিচারে বহু ধরনের পান রয়েছে। যেমন- তামাক (তামবুকা) পান যা তামাক ও মসলা বা জর্দা যুক্ত, সুপারি (সাদা) পান, মিষ্টি (মিঠা) পান, সাঁচি পান প্রভৃতি। প্রত্যেক জেলার অন্তত এক ধরনের পানের সাথে পানসেবীরা পরিচিত। আগের দিনে নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও এলাকায় কর্পূরের গন্ধবিশিষ্ট কাফুরি নামের একপ্রকার অতি উন্নতমানের পান উৎপাদিত হতো। তখন এই পান কলকাতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে রপ্তানি করা হতো। বর্তমানে আরও বেশি লাভজনক জাতের পানচাষ শুরু হওয়ার কারণে এই জাতের পান এখন বিলুপ্তির পথে। মানের দিক থেকে এর পরেই পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত সাঁচি পানের স্থান। সাঁচি পান সাধারণত বাঙালিররা কম খায়। এ পান পাকিস্তানে (করাচিতে) রপ্তানি করা হয়। বাংলা পানকে অনেকে মিঠা পান, ঝাল পা, রাজশাহীর পান বলেও অভিহিত করা হয়। এছাড়া, সাধারণ জাতের পানের মধ্যে রয়েছে বাংলা, ভাটিয়াল, ঢাল-ডোগা এবং ঘাস পান ইত্যাদি। সাধারণত পানের সাথে চুন এবং সুপারি মিলিয়ে খাওয়া হয়। অনেকে আবার পানের সাথে ধনিয়া, এলাচি, দারুচিনি এবং অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্য মেশায়।

সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভোগ্যপণ্য পানের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের ওপর ভিত্তি করে বারুই নামে একটি পেশাজীবী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছে। পান উৎপাদনের জন্য যারা বরজ তৈরি করে তারা কালক্রমে বারুই নামের একটি পেশাজীবী শ্রেণির সৃষ্টি করেছে। যেহেতু বরজ তৈরি মুসলমানদের আগমনের পূর্বের পেশা, সে কারণে মূলত সকল বারুই ছিল হিন্দু এবং সমাজে তাদের স্থান শ্রেণিবিন্যাসে বেশ উপরেই ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অনেক বারুই জমিদারি ও তালুকদারির মালিক হয়। মুসলমান শাসনামলে কৃষকদের মাঝে বারুই শ্রেণি ছিল সবচেয়ে বেশি ধনী। ১৮৭২ এবং ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায় যে, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পান উৎপাদনকারী বারুই বসবাস করত বর্ধমান, মেদিনীপুর, যশোর এবং ঢাকা জেলায়। ১৯৪৭ সাল থেকে বহু পানের বরজই আসল বারুইদের হাতছাড়া হয়ে যায় অথবা তারা বিক্রয় করে দেয় এবং এগুলি মুসলমান বিনিয়োগকারীরা কিনে নেয়। বর্তমানে পান উৎপাদনের সিংহভাগই হচ্ছে মুসলমান কৃষকদের হাতে। তবে উৎপাদন কৌশল অপরিবর্তিত রয়েছে। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসী/অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির মধ্যে খাসি-রাই একমাত্র আদিবাসী যাদের প্রধান পেশা পান চাষ। তারা পানচাষ কে পানজুম বলেন। এদের উৎপাদিত পান অধিক সুস্বাদু ও ঝাঁঝ হওয়ায় এই পান সমগ্র সিলেট অঞ্চলে এমনকি সিলেটের বাইরেও জনপ্রিয়।

বাংলাদেশ থেকে পান রপ্তানি করা হয় পাকিস্তান, ভারত, সৌদিআরব, আরব-আমিরাত, ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি সহ এশিয়া-ইউরোপের আরও অনেক দেশে। বিদেশে রপ্তানীযোগ্য পান আনা হয় বাংলাদেশের নাটোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, চুয়াডাঙ্গা প্রভৃতি জেলা হতে। তবে ঢাকার অদুরে শ্যামবাজারে প্রচুর পানের আড়ত রয়েছে যা রপ্তানির জন্য বেশি উৎকৃষ্ট নয়। বাংলাদেশ ১৯৭৪-৭৫ সাল থেকে ইউরোপে পান পাঠানো শুরু হয়। সৌদি আরবে পান পাঠানো হয় ১৯৯১ সাল হতে। মূলত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের লোকজনই বিদেশে বাংলাদেশের পান কিনে খায়।

বাংলাদেশে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের পান খেয়ে থাকে। তন্মধ্যে ঢাকাই খিলিপান বাংলাদেশ ও উপমহাদেশে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। হিন্দুদের পূজায়ও পান ব্যবহূত হয়। তাছারা বয়োবৃদ্ধ মহিলাগণ পানদানিতে পান রেখে তাদের বন্দুবান্ধব ও আত্মিয়স্বজনের সাথে অবকাশ যাপন করে থাকেন।

পানের উৎপাদনে অধিক পুঁজি বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে এতে আয়ও যথেষ্ট। পানে এক ধরনের সুগন্ধ থাকার কারণে পানের বরজ ক্ষতিকর প্রাণি বা কীটপতঙ্গ দ্বারা কখনও আক্রান্ত হয় না। সুতরাং পান বরজের আয় নিশ্চিত। একসময় পানের বরজ থেকে আয় এতই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতো যে, বাংলার সুবাদার আজিম-উস-শান পানচাষকে ‘সাউদিয়া খাস’ নামে একচেটিয়া রাজকীয় ব্যবসায় পরিণত করেন। ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভ দেওয়ানি লাভের পর তিনিও ১৭৬৭ সালে পান চাষকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়ে পরিণত করেন। বর্তমানে পানের বিশ্বব্যাপী বাজার রয়েছে। এই বাজার প্রসারে দুটো বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার পানসেবীদের বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া; দ্বিতীয়ত, পানের ভেষজ গুণাগুণের বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি। বিশ্ববাজারে ভারতের সাথে প্রতিযোগী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বাজারের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র দখল করতে পেরেছে। পানচাষের জমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, কারণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যান্য ফসলের চাষ এখন বেশি লাভজনক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। [এ.এস.এম এনায়েত করিম]