ভূমি আইন

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:২২, ১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভূমি আইন আদি সম্প্রদায়ের প্রচলিত প্রথাসমূহকে বাংলাদেশের প্রাচীনতম ভূমি আইনের উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। এই আইনসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল জমিতে উৎপাদিত ফসলের হিস্যা গোত্রপ্রধানকে প্রদান, পরিবার কর্তৃক স্বীয় দখলে থাকা জমি চাষের অধিকার, কোন সম্প্রদায়ের জমি পরিবারের মধ্যে বিতরণ, জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদ মীমাংসায় পঞ্চায়েত প্রধানের ক্ষমতা ইত্যাদি। যদিও সময়ের বিবর্তনে গোত্র ব্যবস্থার সমাজ প্রশাসন রাজতন্ত্রের জন্ম দিলেও, ফসলের হিস্যা রাজা বা তার প্রতিনিধিকে প্রদান এবং চাষিদের বিদ্যমান দখলিস্বত্বে হস্তক্ষেপ না করে রাজা কর্তৃক অব্যবহূত জমির বিলিবণ্টন ছাড়া, জমি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের খুব বেশি একটা পরিবর্তন হয় নি। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে এবং আর্যদের আইনকর্তা মনু তাঁর শাস্ত্রে বলেছেন, যে ব্যক্তি জঙ্গল কেটে ভূমি আবাদযোগ্য করবে, সে রাজাকে কর প্রদান সাপেক্ষে জমির মালিক হবে। মনু যদিও বলেছেন রাজা ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ বা এক-অষ্টমাংশ অথবা বার ভাগের একভাগ পাবেন, তবে অন্যান্য ধর্ম সূত্রকারগণ যথা: বৌধায়ন, যাজ্ঞবল্ক্য, অপাস্তম্ভ, বশিষ্ঠ, বিষ্ণু প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, চাষিদের নিরাপত্তার বিনিময়ে রাজা তার অধীনস্থ জমিতে উৎপাদিত ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ নেবেন। অন্যদিকে কৌটিল্যের মতে, সেচ সুবিধার ওপর ভিত্তি করে জমির খাজনা ফসলের এক-তৃতীয়াংশ বা এক-চতুর্থাংশ নির্ধারণ করা হবে। তবে যেখানে সেচ ব্যবস্থা নেই সেখানে জমির খাজনা হবে ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ।

জমি ছিল সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের এবং গ্রামে বসবাসকারী চাষিদের সাধারণ সম্পত্তি। পর্যায়ক্রমে এই জমি তারা পরিবারের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দিত। বংশানুক্রমিক চাষিরা রাজস্ব পরিশোধপূর্বক জমি চাষ করলে তাদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা যেত না। সময়ের বিবর্তনে, পরিবারের এজমালি জমিতে আইল দিয়ে জমির বিভাজন স্বীকৃতি লাভ করে। স্থায়ী বসতকারী বা তাদের উত্তরাধিকারীর অনুমোদন ব্যতীত কোন পরিবার তার জমি বাইরের কারো কাছে বিক্রয় করতে পারত না। এদেশের অনার্য বা আদিবাসীদের পরাস্ত করার পর, আর্যরা তাদের জমি বেদখল করে নেয় এবং যারা আত্মসমর্পণ করে তাদেরকে দাস বা শূদ্র হিসেবে গৃহকর্মে অথবা কৃষিকাজে নিয়োজিত করে। কালক্রমে শূদ্রদের জমি চাষের অধিকার মালিকানা দেওয়া হয় এবং তারা বর্গা পদ্ধতিতে উচ্চ বর্ণের লোকদের জমি চাষের অনুমতি পায়। জমিতে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তারা পেত এবং বাকি অর্ধেক পেত জমির মালিক।

তুর্কি-মুগল আমল ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে বখতিয়ার খলজী বঙ্গ জয় করার পর জমির খাজনা উৎপাদিত ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ থেকে পাঁচ ভাগের একভাগে বা চার ভাগের একভাগে পরিবর্তিত হয়। এই রাজস্ব নগদ অর্থ অথবা দ্রব্যের আকারে প্রদান করতে হতো। যে সকল প্রজা জমির খাজনা নগদ প্রদান করত তাদের ইচ্ছানুযায়ী জমি হস্তান্তরে বাধা ছিল না। তবে যারা খাজনা হিসেবে ফসলের হিস্যার বিনিময়ে জমি চাষ করত তাদের এ ধরনের জমি হস্তান্তরের কোন অধিকার ছিল না। এই জমি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রজাদের সন্তানরা পেত এবং তারা তাদের পূর্বপুরুষের মতো শর্তাধীনে এসব জমি চাষ করতে পারত। যারা জমির খাজনা নগদে পরিশোধ করত তাদেরকে নিজ দায়িত্বেই তা করতে হতো। পাওনা আদায়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যেত এবং অনাদায়ি খাজনার জন্য জমি থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করা যেত। রাজকীয় কর্মকর্তাদের বেতন হিসেবে এবং ধর্মীয় ও পন্ডিত ব্যক্তিদের জীবনযাপনের জন্য কেবল পতিত জমি জায়গির বা আয়েমা হিসেবে দান করা হতো। কোন পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় এনে নির্ধারিত খাজনা প্রদানের বিনিময়ে ঐ জমির মালিক হওয়া যেত। পতিত জমি ছিল সরকারের খাস জমি এবং বাদবাকি চাষকৃত জমিতে সরকারি কর পরিশোধের মাধ্যমে মালিকানা লাভ করা যেত। কালক্রমে, গ্রামপ্রধানদের ক্ষমতা অনেকাংশে খর্ব করা হলে অনেকেই স্থানীয় তালুকদার হিসেবে রূপান্তরিত হয়। তারা চাষিদের কাছ থেকে সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত রাজস্ব আদায় করে উপরস্থ ভূস্বামী জমিদারকে প্রদান করত। বিনিময়ে তারা সম্মানী হিসেবে আদায়কৃত অর্থের একটা অংশ পেত। নির্ধারিত রাজস্বের বিনিময়ে সরকার খাসজমি অন্যকে ইজারা দিতে পারত এবং ইজারাদাররা এ ধরনের জমি নিজে অথবা বর্গাদারের মাধ্যমে চাষ করত। বর্গাদারদের ফসলের অর্ধেকের হিস্যা ছাড়া জমির ওপর কোন অধিকার ছিল না। সরকারি ইজারাদার যেমন জায়গিরদার এবং আয়েমাদারগণ তাদের জমি অন্যের নিকট খাজনার বিনিময়ে ইজারা দিতে পারত।

মুগল শাসনামলে গোটা দেশের জমির খাজনা ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ ধার্যের মাধ্যমে ভূমি কর ব্যবস্থা আরও অধিকতর নিয়মবদ্ধ ও সুসঙ্গত করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা আমিন কর নির্ধারণ করত এবং তারা জমিজমা সংক্রান্ত বিবাদও মীমাংসা করত। কানুনগো, কারকুন, চৌধুরী, মুকাদ্দাম বা গ্রামপ্রধান পাটোয়ারি এবং অন্যান্য জরিপ কর্মকর্তাদের সহায়তায় আমিন প্রতিটি প্লটের বিগত ১০ বছরের গড় উৎপাদন ও উৎপাদিত পণ্যের বাজার মূল্য যাচাই-পূর্বক রাজস্ব নির্ধারণ করত। কানুনগোরা জমি সম্পর্কিত প্রথা ও আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিল, চৌধুরীরা প্রতিনিধিত্ব করত পরগনা বা মহালবাসীর, মুকাদ্দাম বা গ্রামপ্রধান প্রতিনিধিত্ব করত গ্রামবাসীদের আর পাটোয়ারিরা ছিল গ্রামের হিসাবরক্ষক। চাষিদের বলা হতো রায়ত। তারা নগদ অথবা দ্রব্যের আকারে কর পরিশোধ করত, তবে নগদ পরিশোধ অগ্রাধিকার পেত। জমিদার, জায়গিরদার বা সরকারি খাজনা আদায়কারী যেমন আমিন, শিকদার, আমলগুজার অথবা ক্রোড়ি রায়তদের নিকট থেকে আবওয়াব বা নির্ধারিত করের অতিরিক্ত আদায় নিষিদ্ধ ছিল। এসব ব্যক্তি এবং জায়গিরদার ও আয়েমাদারগণ যেমন রায়তদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত না তেমনি তাদের জমি খাসজমি হিসেবে দখলেও নিতে পারত না। যখন কোন রায়ত নিজ জমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেত অথবা জমি চাষ করার মতো পরিবারে কোন পুরুষ সদস্য থাকত না, কেবল সেক্ষেত্রে অন্যের কাছে তার জমি বন্দোবস্ত দেওয়া যেত। জমিদার, জায়গিরদার বা আয়েমাদাররা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জমির মালিক ছিল না। তারা শুধু সরকার নির্ধারিত রাজস্ব রায়তদের নিকট থেকে আদায় করতে পারত। যদি জমিদারির অধিকার বংশানুক্রমিক হতো তাহলেই কেবল তা হস্তান্তরযোগ্য ছিল। কিন্তু ইজারাদারি, জায়গিরদারি বা আয়েমাদারি বংশানুক্রমিক বা হস্তান্তরযোগ্য ছিল না। পরবর্তীকালে আয়েমাদারি হস্তান্তরযোগ্য করা হয়। জমিদার বা ইজারাদারগণ আদায় খরচ ও আদায় সম্মানী হিসেবে ভূমিকরের একটা অংশ পেত।

গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা, যারা নিজেরাই বা অন্যের মাধ্যমে, নিজ গ্রামে জমি চাষ করত তাদেরকে বলা হতো খুদকাশ্ত রায়ত। তাদেরকে পরগনা বা নিরিখের জন্য প্রথানুযায়ী অথবা তাদের অনুকূলে সম্পাদিত ইজারা দলিলে বা পাট্টাতে উল্লিখিত হারে রাজস্ব প্রদান করতে হতো। যদি তারা নিয়মিত কর পরিশোধ করত তাহলে তাদেরকে জমি থেকে উচেছদ করা যেত না এবং তারা বংশপরম্পরায় এই জমির মালিকানা ভোগ করত। তাদের খুশিমতো তারা জমি পরিত্যাগও করতে পারত না। ভিন্ন গ্রামের মানুষ যারা জমি চাষ করত তাদের বলা হতো পাইকাশ্ত রায়ত। তারা চুক্তিভিত্তিতে খাজনা পরিশোধ করতে পারত। কিন্তু জমি দখলে রাখার কোন অধিকার তাদের ছিল না। তারা আসলে ছিল উচ্ছেদযোগ্য চাষি এবং ফসল কাটার পর যে কোন সময় তাদেরকে বিতাড়ন করা যেত। তারাও ইচ্ছেমতো এ ধরনের জমি পরিত্যাগ করতে পারত। জমিদার জায়গিরদার, চৌধুরী, তালুকদাররা তাদের দখলীকৃত খাসজমি বর্গাদারদের দ্বারা অথবা কৃষিশ্রমিকের সাহায্যে চাষাবাদ করতে পারত। এক্ষেত্রে বর্গাদার বা শ্রমিকদের ফসলের হিস্যা বা মজুরি পাওনা ছাড়া জমির ওপর তাদের কোন অধিকার ছিল না।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমল  ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুগল সম্রাট শাহ আলমের নিকট থেকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানি লাভ করে। শুরুতে কোম্পানি বিদ্যমান কর আদায় ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ না করলেও পরবর্তীকালে পাঁচসনা, বাৎসরিক বা দশসনা বন্দোবস্তের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ডাককারীকে কর আদায়ের অধিকার দেওয়া শুরু করে। এর ফলে পুরানো জমিদার বা ইজারাদারদের জন্য শুধু উচ্চ হারে কর আদায়ের কাজটি অবশিষ্ট থাকে। ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ কোম্পানির গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস দশসনা স্থায়ী বন্দোবস্ত ঘোষণা করে জমিদার ও তালুকদারদের তাদের দখলীকৃত জমির মালিকানা স্বত্ব প্রদান করেন। এর ফলে সরকারের কর আদায়কারীরা রাতারাতি ভূস্বামীতে পরিণত হয়। সরকারকে নিয়মিত কর প্রদান সাপেক্ষে ভূস্বামীরা তাদের জমির মালিকানা ভোগ করতে পারত। কর বাকি পড়লে তাদের জমিজমা নিলামে বিক্রয়ের অধিকার ছিল। জমির ওপর তাদের অধিকার বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য করা হয়। রায়তদের কর বৃদ্ধি না করার ব্যাপারে ভূস্বামীদের নিরস্ত করার কোন পদক্ষেপ এই ব্যবস্থায় ছিল না এবং এমনকি এতে প্রচলিত পরগনা-হারে কর গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ১৭৯৩-এর ৮ নম্বর আইন লঙ্ঘন করে রায়তদের নিকট থেকে উচ্চ হারে কর দাবি করা হতে থাকে। যদিও এই আইনে বলা হয়, জমিদাররা ১২ বছরের মধ্যে কর বৃদ্ধি করতে পারবে না এবং অন্যান্য প্রজাদের পরগনা-হারে পাট্টা অনুমোদন দিতে হবে। অতিরিক্ত কর প্রদানে ব্যর্থ হলে রায়তদের উঠতি ফসলসহ সকল অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করে ১৭৯৩-এর ১৭ নম্বর ধারায় ভূস্বামীদের প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপও খর্ব করা হয়। করমুক্ত জমিকে বলা হতো লাখেরাজ। ১৭৯৩ সালের বাদশাহি ও অবাদশাহি লাখেরাজ আইনের আওতায় এসব জমির অংশবিশেষ স্বীকৃতি লাভ করে। সরকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বাইরেও জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার অধিকার রাখত এবং এ ধরনের জমিকে বলা হতো খাস মহাল।

রায়তদের খাজনা বা কর প্রদানে অস্বীকৃতি এবং ক্রোকের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ সরকারকে ১৭৯৯-এর ৭ নম্বর আইন পাশ করতে বাধ্য করে। এই আইনে ভূস্বামীকে অবাধ্য রায়তকে আটক এবং তার সম্পত্তি ক্রোক ও বিক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয়। এই কালো আইন ১৮১২-এর ৫ নম্বর আইন পাশের মাধ্যমে সংশোধন করা হয় এবং ভূস্বামী কর্তৃক রায়তদের আটকের অধিকার বিলোপ করা হয়। গ্রামীণ পাটোয়ারি এবং পরগনা কানুনগোদের নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি আইন তৈরি করা হয়। কানুনগোরা ছিল বেতনভোগী। পূর্বে বেতনের পরিবর্তে তারা যে খাজনাবিহীন জমি ভোগ করত সেগুলির খাজনা ধার্য করা হয়। অন্যদিকে, পাটোয়ারিদের খাজনামুক্ত জমি অথবা ভাতা দেওয়া হতো। এ পর্যন্ত ভূস্বামীর জমিদারি অধিকার নিলামে ক্রয়ের মাধ্যমে নিলাম ক্রেতা খুদকাশ্ত রায়তদের উচ্ছেদ করতে পারত এবং অন্যের নিকট উচচ রাজস্বে ইজারা দিতে পারত। কিন্তু ১৮২২-এর ১১ নম্বর আইন পাশের মাধ্যমে এ ধরনের নিলাম ক্রেতাকে খুদকাশ্ত বা কায়েমি (স্থায়ী) রায়তদের উচ্ছেদ করার অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়। এতে অন্যান্য প্রকারের রায়তদের উচেছদের অধিকার অব্যাহত থাকে।

১৭৯৩-এর ১৪ নম্বর আইনের বিধানানুযায়ী খেলাপি জমিদারকে আটক করে জেলে অন্তরীণ করা যেত এবং তাদের জমিদারির খাজনা আদায়ের জন্য আমিন নিয়োগ করা যেত। কিন্তু ১৭৯৪-এর ৩ নম্বর বিধান তৈরির মাধ্যমে এ ধরনের আটক ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয় এবং সুদসহ বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য জমিদারি নিলামে বিক্রয়ের বিধান করা হয়। ১৭৯৬-এর ৫ নম্বর বিধানানুসারে, বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য জমিদারির অংশবিশেষ বিক্রয়ের আইন করা হয়। ১৮১২ সালের ৫ নম্বর বিধানবলে রাজস্ব বোর্ডকে গোটা জমিদারি বিক্রয়ের অনুমতি প্রদানের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। ১৮২২-এর ১১ নম্বর ধারা বোর্ডকে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণে বা অনিয়মের জন্য কোন জমিদারি নিলামে বিক্রয়ের আদেশ স্থগিত রাখার অধিকার দেয়। ১৮৪১-এর ১২ নম্বর বিধানে নিলাম বিক্রয় ঘোষণার নির্ধারিত দিনের পূর্বদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে জমিদার যদি বকেয়া রাজস্ব প্রদানে ব্যর্থ হয় তাহলে বোর্ডকে সেই জমিদারি বিক্রয়ের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। নিলাম ক্রেতাদেরও কয়েক ধরনের রায়ত, যেমন যাদের জমির ওপর স্থায়ী অধিকার আছে, তাদেরকে উচেছদ ও রাজস্ব বৃদ্ধি করা থেকে বিরত রাখা হয়। ১৮৪১ সালের ১২ নম্বর সূর্যাস্ত আইনসহ উপরিল্লিখিত বিধানসমূহ সংশোধন করে ১৮৪৫-এর ১ নম্বর বিধান প্রণয়ন করা হয়।

ব্রিটিশ আমল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রায়তদের স্বার্থ রক্ষায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয় নি। ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনের ক্ষমতা গ্রহণ করে সর্বপ্রথম রায়তদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য খাজনা আইন ১৮৫৯ (অ্যাক্ট ১০, ১৮৫৯) পাস করে। এই আইনে খুদকাশ্ত ও পাইকাশ্ত রায়তের মধ্যে ভেদাভেদ তুলে দেওয়া হয়। এতে কোন রায়ত যদি একটানা ১২ বছর কোন জমি ভোগদখল করে তবে তাকে তার দখলিস্বত্ব দেওয়া হয় এবং বলা হয়, রায়ত যদি সেই জমির খাজনা নিয়মিত পরিশোধ করে থাকে তাহলে তাকে সে জমি থেকে উচেছদ করা যাবে না। তবে যারা বাৎসরিক বা ঠিকাভিত্তিতে জমিদার, তালুকদার বা দখলি রায়তদের খাসজমি চাষ করত তাদের ক্ষেত্রে এ ধারা প্রযোজ্য ছিল না। এই ধারার আওতায় নির্ধারিত খাজনার বিনিময়ে রায়তরা যে জমি ভোগ করত তার রাজস্ব বৃদ্ধি করা যেত না। তবে অন্যান্য শ্রেণীর রায়তদের রাজস্ব বৃদ্ধিতে কোন বাধা ছিল না। এই আইনের আওতায় ভূস্বামী ও প্রজাদের মধ্যকার সকল প্রকার মামলা নিষ্পত্তির ক্ষমতা ছিল কালেক্টরদের ওপর। উপরন্তু, এই বিধান অন্যান্য বিধানের বিপরীতে জমিদারদের প্রজাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার অধিকার দেয়। এর ফলে অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ ধারাগুলি অকার্যকর হয়ে যায় এবং অন্যান্য জমিদারদের তাদের অধীনস্থ রায়তদের স্বার্থের বিরুদ্ধে খাজনা বৃদ্ধি ও জমির স্বত্ব পরিত্যাগে চুক্তিবদ্ধ হতে রায়তদের বাধ্য করতে উৎসাহিত করে। রাজস্ব আইন ১৮৬২ অনুসারে ভূস্বামী যদি আপসে রাজস্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে প্রজাদের সরাসরি কালেক্টরের নিকট খাজনা পরিশোধের অধিকার দেওয়া হয় এবং কালেক্টরকে প্রজা বা ভূস্বামী উভয়ের যে কেউ কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতিরেকে খাজনা প্রদান বা গ্রহণে ব্যর্থতার জন্য দায়ী হোক না কেন তার ওপর মামলার খরচ ও দাবির শতকরা ২৫ ভাগ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ ডিক্রি জারির ক্ষমতা দেওয়া হয়। এছাড়া, এই আইনে ভূস্বামীকে প্রজাদের জমি জরিপ করা ও মাপার অধিকার দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে খাজনা আইন ১৮৫৯-এর প্রায় সকল ধারা অনুকরণে খাজনা আইন ১৮৬৯ প্রণয়ন করা হয় এবং প্রথমবারের মতো প্রথাগত দখলি প্রজাদের জমি হস্তান্তরের অধিকার দেওয়া হয়। এছাড়া, কালেক্টরের পরিবর্তে দেওয়ানি আদালতকে ভূস্বামী ও প্রজাদের মধ্যকার সকল মামলা মোকদ্দমার নিষ্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়।

জরিপ আইন ১৮৭৫ প্রণয়ন করা হয় গ্রামের সীমানা নির্ধারণ, প্রতিটি জমির খন্ড, তার পরিমাণ দেখিয়ে মৌজা বা গ্রামের মানচিত্র প্রণয়ন, প্রজাদের নাম ও উপরস্থ ভূস্বামীর নাম এবং প্রজার ধরন, হিস্যা, জমির দখল ও তার খাজনা বা কর ইত্যাদি রেকর্ড করার জন্য। খাজনা নির্ধারণ আইন ১৮৭৯ রাজস্ব কর্মকর্তাদের জরিপকালে কতগুলি ক্ষেত্রে দখলি ও অধীনস্থ রায়তদের খাজনা বৃদ্ধির কর্তৃত্ব প্রদান করে এবং রায়তদের এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার অধিকার প্রদান করা হয়। জমিদার কর্তৃক রায়তদের রাজস্ব বৃদ্ধির উদ্যোগের বিরুদ্ধে পাবনায় কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিলে ১৮৭৯ সালের এপ্রিল মাসে খাজনা আইন কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। এই কমিশন ১৮৮০ সালের মে মাসে প্রতিবেদন দাখিল করে। এই রিপোর্ট পর্যালোচনার পর ১৮৮৩ সালের ২ মার্চ আইনসভায় বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাসের জন্য বিল পেশ করা হয়। পরিষদ সংশোধনিসহ বিলটি পাস করে এবং গভর্নর জেনারেল কর্তৃক সম্মতি লাভের পর ১৮৮৫ সালের ১৪ মার্চ এটি আইনে পরিণত হয় এবং একইবছর ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এই আইনের আওতায় জমিদার, তালুকদার, রাজস্ব গ্রহণকারী ও মোকারারি রায়ত, দখলি রায়ত, বন্দোবস্ত রায়ত, অদখলি রায়ত এবং অধীনস্থ রায়ত-এর পদবি, অধিকার ও দায়দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত নিয়মকানুন তৈরি করা হয়। শুরুতে এই আইন স্থানীয়ভাবে প্রচলিত প্রথা দ্বারা স্বীকৃত না হলে কায়েমি বা স্থায়ী তালুকদার ও মোকারারি রায়ত ছাড়া অন্যের নিকট জমি হস্তান্তরের স্বীকৃতি দেয় নি। এছাড়া, বকেয়া আদায়ের জন্য মালামাল ক্রোক, উঠতি ফসল বিক্রয়ের বিধানসমূহ বাতিল না করে এতে সেগুলিকে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে এই আইনে রাজস্ব কর্মকর্তাদের সরেজমিনে জরিপের মাধ্যমে জমির অধিকার অর্থাৎ খতিয়ান রেকর্ড প্রস্ত্ততের সময় ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক কর নির্ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়। তদুপরি, ভূস্বামীরা ভূমি উন্নয়ন ও জমির পরিমাণ বৃদ্ধি ইত্যাদির মতো কিছু কারণ ছাড়া কর বৃদ্ধি করতে পারত না। একইভাবে, জমির পরিমাণ হ্রাস বা ভূস্বামী কর্তৃক সেচ সুবিধা প্রদানে ব্যর্থতার জন্য প্রজাদের কর হ্রাসের অধিকার দেওয়া হয়। একবার খাজনা বৃদ্ধি করা হলে পরবর্তী ১৫ বছরের মধ্যে আর তা বৃদ্ধি করা যেত না। কায়েমি তালুকদার, মোকারারি রায়ত, দখলি রায়তকে বকেয়া খাজনার জন্য তাদের জমি থেকে উচেছদ করা যেত না। তবে দেওয়ানি আদালত থেকে বকেয়ার জন্য ডিক্রি আদায় সাপেক্ষে উচ্ছেদ করা যেত। বেকায়েমি তালুকদার, অদখলি রায়ত এবং অধীনস্থ রায়তগণ যদি নির্ধারিত সময়ে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হতো তাহলে তাদেরকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যেত।

১৮৯৪ সালে উল্লিখিত আইনে একই বছরের অ্যাক্ট নম্বর ১ দ্বারা সংশোধনী আনা হয়। এতে খতিয়ান তৈরির বিধানের স্থলে জরিপ কার্যক্রম ও রাজস্ব নির্ধারণ বিধি স্থাপন করা হয়। এরপর ১৮৯৮ সালে অ্যাক্ট নম্বর ৩-এর মাধ্যমে খাজনা বৃদ্ধি, খতিয়ান তৈরি ও রাজস্ব নির্ধারণের বিধানসমূহে যথেষ্ট পরিবর্তন করা হয়। ১৯০৭-এর অ্যাক্ট নম্বর ১ ও ১৯০৮-এর অ্যাক্ট নম্বর ১ দ্বারা উপরিল্লিখিত আইনের আরও সংশোধনী আনা হয়। এতে চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত খতিয়ানকে সঠিক ধরা হবে যদি না কোন অসঙ্গতি প্রমাণিত হয়। বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য দাবি প্রমাণের ক্ষেত্রে কোন মামলায় আদালতে খতিয়ান দাখিল করা যাবে। খতিয়ানে উল্লিখিত পরিমাণের বেশি কর ধার্য করলে তা হ্রাসের অধিকার রাজস্ব কর্মকর্তাকে দেওয়া হয় এবং ভূস্বামী কর্তৃক বকেয়া রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে স্থানীয় রাজস্ব অফিসারের নিকট সার্টিফিকেট মামলা দাখিলের বিধান এই আইনে দেওয়া হয়।

১৯২৮ সালের অ্যাক্ট নম্বর ৪-এর মাধ্যমে উল্লিখিত আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। এতে দখলি রায়তকে তার উপরস্থ ভূস্বামীকে এক চতুর্থাংশ পারিতোষিক প্রদানের শর্তে তার জমি হস্তান্তরের অধিকার দেওয়া হয়। ভূস্বামী কর্তৃক এ ধরনের জমিতে অগ্রাধিকার প্রয়োগ, এবং ভূমিমালিক কর্তৃক ভোগদখলের স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত কোন বর্গাদারকে প্রজা হিসেবে স্বীকার না করা, প্রজার মালামাল ক্রোক ও উঠতি ফসল বা মালামাল বিক্রয়ের বিধানসমূহ এই আইন দ্বারা রহিত করা হয়। দখলি প্রজাদের তাদের জমিতে গাছ লাগানোর, গাছের ফল ভোগের, গাছ কাটা ও বিক্রয়ের ক্ষমতা প্রদান এবং অধীনস্থ রায়তদের ১৫ বছরের জন্য তাদের জমি অহস্তান্তরযোগ্য বন্ধক রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালের ৬ নম্বর আইনের মাধ্যমে উপর্যুক্ত আইনের আরও সংশোধনী আনা হয়। দখলি প্রজা কর্তৃক তাদের জমি হস্তান্তরের জন্য ভূস্বামীকে পারিতোষিক প্রদানের বিধান রহিতকরণ, এ ধরনের জমি ভূস্বামী কর্তৃক অগ্রক্রয়ের অধিকার, এবং যদি কোন আগমুতক বা আগমুতকসমূহের কাছে হস্তান্তর করা হয়, সেক্ষেত্রে অন্যান্য দখলি রায়তের অংশীদার হস্তান্তরকারীকে অগ্রক্রয়াধিকার প্রদানের বিধানসমূহ এই আইনের আওতাভুক্ত করা হয়। এতে ভোগদখলীকৃত জমির বন্ধককে ১৫ বছরের জন্য অহস্তান্তরযোগ্য বন্ধক হিসেবে গণ্য করার এবং আদালতের মাধ্যমে দখল উদ্ধারের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়। অধীনস্থ রায়তদের তাদের জমি হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয় এবং প্রজাদের রাজস্ব বৃদ্ধির বিধান ১০ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। তালুকদার এবং অধীনস্থ রায়তদের তাদের উপরস্থ ভূস্বামীর বরাবরে অধিকার হস্তান্তরের অনুমতি দেওয়া হয়। বিলীনকৃত জমির রাজস্ব হ্রাস, এ ধরনের জমি পুনর্গঠনের পর তাতে দখলের অধিকার এবং বকেয়া রাজস্ব আদায়ের জন্য সার্টিফিকেট মামলা রুজু করার বিধান বিলোপ করা হয়। ১৯৩৯-এর ১৩ নম্বর আইনের দ্বারা উল্লিখিত আইনের ৫২ ধারা সংশোধন করা হয় এবং কোন প্রজার রাজস্ব বৃদ্ধি করে আদালতের ডিক্রি জারি নিষিদ্ধ করা হয়। প্রজা কর্তৃক দখলীকৃত জমির প্রকৃত পরিমাণ যদি তার সঙ্গে বন্দোবস্তকৃত জমির চেয়ে বেশি হয় তাহলেও এই আদেশ বলবৎ হবে।

১৯৪০-এর ১৮ নম্বর আইনে উল্লিখিত আইনের ২৬ ধারা সংশোধন করা হয়। এতে শর্তাধীন বিক্রয়ের বন্ধকসহ দখলি জমির সকল বন্ধক ১৫ বছরের জন্য অহস্তান্তরযোগ্য বন্ধকরূপে গণ্য করা হয় এবং আদালতের মাধ্যমে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য বলা হয়। উপরন্তু, বকেয়া রাজস্বের জন্য কোন ডিক্রি বা সার্টিফিকেট মামলা দায়েরের মাধ্যমে তালুক বা ভূসম্পত্তি ব্যতীত কোন প্রজার অন্য সম্পত্তি বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়। বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের সংশোধিত বিধানগুলি ১৭৭৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের মাধ্যমে হূত সকল অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। এ কারণেই বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনকে বাংলায় প্রজাদের ম্যাগনা কার্টা (মহাসনদ) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

পাকিস্তান আমল ব্রিটিশ শাসনের শেষভাগে এসে জমিদারি বিলোপের একটি দাবি উত্থাপিত হয় এবং ১৯৩৯ সালে ফ্রান্সিস ফ্লাউড-কে চেয়ারম্যান করে ভূমি রাজস্ব কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। রাজস্ব আয়কারী সকল সম্পত্তি সরকার কর্তৃক হুকুমদখলের সুপারিশসহ এই কমিশন ১৯৪০ সালে তার প্রতিবেদন পেশ করে। এই কমিশনের সুপারিশমালার ওপর ভিত্তি করেই পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ পাশ হয়। এভাবেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের ১৬৩ বছর পর সকল রাজস্ব আয়কারী বিষয়াদিসহ জমিদারি প্রথা বাতিলপূর্বক ভূমি ব্যবস্থা সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন চলে যায়। এই আইনে সকল রাজস্ব আয়কারী জমিজমা ও পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘার অতিরিক্তি জমি, হাট-বাজার, জলমহাল, খনি ও অন্যান্য অধিকার হুকুমদখল এবং তার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রাখা হয়। খতিয়ান তৈরি ও সংশোধন, প্রজাদের সেবাসহ সকল জমির রাজস্ব পুনর্নির্ধারণ এই আইনের আওতাভুক্ত করা হয়। উল্লিখিত সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন এবং সকল রাজস্বসংশ্লিষ্ট ও অন্যান্য স্থাপনা হুকুমদখল, খতিয়ান ও ক্ষতিপূরণ নির্ধারণী চূড়ান্ত বিবরণী প্রকাশিত হবার পর উল্লিখিত আইনে প্রজার অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত পঞ্চম অধ্যায় কার্যকর করে সর্বপ্রথম এখনকার পটুয়াখালী জেলার জন্য ১৯৫৪ সালে পরিপত্র জারি করা হয়। এ বিষয়ে সর্বশেষ পরিপত্র জারি হয় ১৯৬৫ সালে ফরিদপুরে।

কোন এলাকায় পঞ্চম অধ্যায় কার্যকর হওয়ার পর, বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, সিলেট প্রজাস্বত্ব আইন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনসমেত অন্যান্য ২৭টি বিধানসহ ১৪টি আইনের সকল অরদকৃত ধারাসমূহ রদ করা হয়। এর ফলে কৃষিজমির মাত্র একশ্রেণীর দখলদার মালিক হিসেবে টিকে থাকে এবং ১৯৫০-এর আইনের অংশ ৫-এর অনুবিধির দ্বারা তাদের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ধরনের মালিকের খনিজ সম্পদ ও অন্যান্য ভূগর্ভস্থ সম্পদের ওপর কোন অধিকার থাকে না এবং সরকার কোন নির্ধারিত সময়ের জন্য যদি কোন জমি ইজারা দেয়, তাহলে তার অধিকার ও দায়দায়িত্ব ইজারায় বর্ণিত শর্তানুযায়ী পরিচালিত হবে। রাজস্ব আয়কারী কোন জমি হুকুমদখলের পূর্বেই অকৃষিজমির মালিকের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা যদি ১৯৪৯ সালের অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে অংশ ৫-এ বর্ণিত বিষয়ে কোন অসঙ্গতি না থাকলে, সরকার কর্তৃক হুকুমদখলের পর সেই কৃষক উল্লিখিত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। রাজস্ব নির্ধারণ ছাড়া, অকৃষিভূমি মালিকের অধিকার ও বাধ্যবাধকতার আওতা বৃদ্ধি বা হ্রাস ইজারা দলিলে উল্লিখিত শর্তাধীনে এবং ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। যে কোন কৃষি বা অকৃষিজমি ইজারা দিলে তা অকার্যকর হবে এবং এ ধরনের জমি বাজেয়াপ্ত হয়ে সরকারের অধিকারে চলে যাবে। ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি দ্বারা ইজারা দলিল কার্যকর ও নিবন্ধিত না হলে শুধু পারিতোষিক বা রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে কোন সরকারি জমিতে অকৃষি বা অকৃষি প্রজাস্বত্ব সৃষ্টি করা যায় না। একজন প্রকৃত চাষি সে-ই, যে নিজে বা তার পরিবারের সদস্যদের দ্বারা, বা চাকর অথবা কৃষি বা অন্য শ্রমিক দ্বারা বা অংশীদার বা বর্গাদার দ্বারা তার জমি চাষ করে।

একজন চাষি ইচ্ছানুযায়ী যে কোনভাবে তার জমি ব্যবহার ও দখলে রাখতে পারে এবং সে যদি কোন উইল না করে মৃত্যুবরণ করে তাহলে তার জন্য প্রযোজ্য উত্তরাধিকার আইনের বিধানানুযায়ী তার বংশধররা উত্তরাধিকারী হবে। সে তার জমি হস্তান্তরও করতে পারে এবং সে হস্তান্তর হতে হবে দালিলিক। তবে উত্তরাধিকারসূত্রে বা হস্তান্তরের মাধ্যমে কেউই কোন জমি অর্জন করতে পারবে না যদি সে জমি তার পরিবারের বিদ্যমান জমির সঙ্গে যুক্ত হলে একটি পরিবারের জন্য নির্ধারিত জমির পরিমাণের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে। এ ধরনের অতিরিক্ত জমি সরকারের অধিকারে চলে যাবে। রায়ত কর্তৃক কোন জমি হস্তান্তর তার সহঅংশীদার বা নিকটস্থ রায়তের নিকট কয়েকটা শর্তাধীনে বিক্রয়ের বাধ্যবাধকতা থাকে। কোন রায়ত নির্ধারিত সময়ের জন্য অহস্তান্তরযোগ্য বন্ধক ছাড়া তার জমি বন্ধক রাখতে পারবে না। রাজস্ব কর্মকর্তার অনুমোদন ব্যতীত কোন আদিবাসী অআদিবাসী ব্যক্তির নিকট জমি হস্তান্তর করতে পারবে না। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন জমি হস্তান্তর হলে তা অবৈধ বলে বিবেচিত হবে এবং রাজস্ব কর্মকর্তা ক্রেতাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারবেন। হস্তান্তরিত জমি হস্তান্তরকারীর অথবা তার উত্তরাধিকারীর বরাবরে পুনর্বহাল করতে পারেন। এই আইনে, রাজস্ব বৃদ্ধি বা হ্রাস, কোন জমির বিভাজন বা একত্রীকরণ ও বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে রাজস্ব ভাগাভাগি করে দেওয়া এবং আপস অথবা সার্টিফিকেট মামলা রুজু অথবা নিলামে জমি বিক্রয়ের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের বিধান রয়েছে। এছাড়া খতিয়ান প্রস্ত্তত, সংশোধন ও রক্ষণাবেক্ষণের বিধান, সরকার কর্তৃক হুকুমদখলকৃত জমির ইজারা প্রদান, সম্পত্তি পরিত্যাগ, বা হুকুমদখল এই আইনের আওতাভুক্ত করা হয়। এই আইনের ১৪৪ ধারার অধীনে প্রস্ত্ততকৃত ও সংশোধিত প্রতিটি অন্তর্ভুক্তি সঠিক বলে ধরা হবে যদি না কোন অসঙ্গতি প্রামাণিক দলিল দ্বারা প্রমাণিত হয়। কোন রাজস্ব কর্মকর্তার আদেশের বিরুদ্ধে আবেদন করতে হলে তা তার উপরস্থ কালেক্টরের কাছে দাখিল করতে হবে। কোন কালেক্টরের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কমিশনারের নিকট এবং বিভাগীয় কমিশনারের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে রাজস্ব বোর্ডের নিকট আবেদন করতে হবে। একইভাবে, ঐসব কর্মকর্তা বা রাজস্ব বোর্ড সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অথবা সুয়োমটো জারির মাধ্যমে এ ধরনের আদেশ পরিবর্তন করতে পারেন। যে কোন রাজস্ব কর্মকর্তা তার নিজের অথবা তার পূর্বসূরির আদেশ পর্যালোচনা অথবা পরিবর্তন করতে পারেন। ১৮৭২-এর চুক্তি আইনের বিধানসমূহ ও ১৮৮২-এর সম্পত্তি হস্তান্তর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অকৃষিজমির মালিকদের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত কোন বিধান বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনে ছিল না। এর ফলে অকৃষিজমির ভোগদখলকারীদের তাদের ইজারার মেয়াদ শেষ হবার পর উচ্ছেদ করা যেত এবং ভূস্বামীরা ইজারা নবায়নের সময় তাদের ইচ্ছে মতো রাজস্ব বৃদ্ধি করতে পারত।

১৯৩৬ সালের অকৃষি-ভূমি রাজস্ব নির্ধারণ আইন (Non-Agricultural Land Rent Assessment Act 1936) শুধু সাময়িক বন্দোবস্ত ও সরকারি খাসজমির জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় এটি ব্যক্তিগত ভূস্বামীর অধীনস্থ বিপুলসংখ্যক অকৃষি-প্রজার দুঃখদুর্দশা লাঘব করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৩৮ সালে অকৃষি ভূমি তদন্ত কমিটি (Non-Agricultural Land Enquiry Committee) যা চান্দিনা কমিটি নামেই পরিচিত ছিল, গঠনের পর ভূস্বামীরা অকৃষিজমির প্রজাদের উচেছদ আরম্ভ করলে সরকার এই উচেছদ বন্ধের উদ্দেশ্যে সাময়িকভাবে বঙ্গীয় অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৪০ (সাময়িক বিধান) প্রণয়ন করে। এই কমিটির সুপারিশ অনুসারে অকৃষিজমির মালিকদের দুর্দশা লাঘবের জন্য পূর্ববঙ্গ অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৪৯ (East Bengal Non-Agricultural Tenancy Act of 1949) প্রণয়ন করা হয়। এই আইনানুসারে, যে কোন জমি কৃষি বা বাগানের জন্য ব্যবহূত না হলেই তা অকৃষিজমি হিসেবে বিবেচিত হবে। অকৃষিজমির মালিক ছিল দুই প্রকার মালিক ও অধীনস্থ মালিক। অকৃষিজমির ভোগদখলকারী যদি ১২ বছর বা তার অধিক একটানা জমি দখলে রাখে তাহলে স্থায়ী ভোগদখলকারীর মতোই ঐ জমির ওপর তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাকে উচ্ছেদ করা যাবে না। তবে অন্যান্য ভোগদখলকারী বা অধীনস্থ ভোগদখলকারীদের উল্লিখিত আইনের বিধানানুসারে এ ধরনের কোন অধিকার ছিল না এবং যে কোন সময় তাদের উচ্ছেদ করা যেত। অকৃষিজমির মালিকের মৃত্যুর পূর্বে কোন উইল না থাকলে উত্তরাধিকারসূত্রে তার বংশধরগণ সম্পত্তির ভাগীদার হবে এবং নিবন্ধিত দলিলের মাধ্যমে তা হস্তান্তরযোগ্য করতে পারবে। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে পরবর্তী উপরস্থ ভূস্বামী বা সহঅংশীদারদের অগ্রক্রয়াধিকার ছিল। সরকার রাজস্ব কর্মকর্তাকে অকৃষিজমির খতিয়ান প্রস্ত্তত ও রাজস্ব নির্ধারণের নির্দেশ দিতে পারতেন। অকৃষিজমির মালিকদের রাজস্ব ১৫ বছরের জন্য নির্ধারিত ছিল ও জমির উন্নয়নের অজুহাত ছাড়া অধীনস্থ রায়তদের ৫ বছরের মধ্যে কোন কর বৃদ্ধি করা যেত না। ভূস্বামী আপসে রাজস্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে অকৃষি মালিক আদালতে তা জমা দিতে পারবে। একইভাবে, ভূস্বামী দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে বকেয়া আদায় করতে পারত এবং বকেয়া রাজস্বের জন্য আদালত থেকে ডিক্রি প্রাপ্তিসাপেক্ষে খেলাপি মালিকের জমি নিলামে বিক্রয় করতে পারত। এই আইনের বিধানসমূহ বন্দর, রেলওয়ে অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ অথবা বনভূমি সৃষ্টি, খনিজ পদার্থ সংগ্রহ বা মৎস্য চাষের জন্য ইজারাকৃত জমি অথবা সরকারের কোন বিভাগের ব্যবহারের জন্য, অথবা যে কোন ওয়াক্ফ অথবা ট্রাস্টের জমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না বা এখনও নেই। প্রস্ত্ততকৃত ও সংশোধিত খতিয়ান এবং ক্ষতিপূরণ নির্ধারণী বিবরণী প্রকাশ, অকৃষিজমি হুকুমদখলের পর রাজস্ব গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধ এবং অকৃষিজমি ইজারা নিয়ে বর্গা দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ও ১৯৬৭-এর ৯ নম্বর অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে উল্লিখিত আইনের অনেকগুলি অনুবিধি রদ করার পর এই আইন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। অকৃষিজমির কোন অংশীদার তার অংশ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সহঅংশীদার কর্তৃক অগ্রক্রয়াধিকার প্রয়োগ ছাড়া এই আইনের অন্যান্য অরদকৃত বিধিবিধান বস্ত্ততপক্ষে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

১৯৪৮-এর জরুরি সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইনে (Emergency Requisition of Property Act, 1948) সরকারি কাজে বা জনস্বার্থে সরকার যে কোন বাড়ি বা জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। সরকারি জমি ও দালানকোঠা থেকে অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে ১৯৫২-এর ১০ নম্বর আইন ও ১৯৭০ সালের ২৪ নম্বর অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

হাট ও বাজার (প্রতিষ্ঠা ও অধিগ্রহণ) অধ্যাদেশ ১৯৫৯-এর আওতায় কোন ব্যক্তি তার দখলীকৃত জমিতে কালেক্টরের নিকট থেকে লাইসেন্স গ্রহণপূর্বক হাট-বাজার স্থাপন করতে পারে। এ ধরনের লাইসেন্স গ্রহণ না করেই হাট-বাজার স্থাপন করলে এই অধ্যাদেশে তা বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং ক্ষতিপূরণ নির্ধারণী বিবরণীর চূড়ান্ত প্রকাশ ও সরকারি গেজেটে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ জারি হবার পর কোন স্থানে হাট-বাজার স্থাপিত হলে তা অধিগ্রহণের অধিকার দেয়। ওয়াক্ফ সম্পত্তির আরও সুষ্ঠু তদারকির জন্য বেঙ্গল ওয়াক্ফ আইন ১৯৩৪ বাতিল করে ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ ১৯৬২ জারি করা হয়।

বাংলাদেশ আমল পাকিস্তানে সামরিক শাসনামলে পরিবারপ্রতি জমির সর্বোচচ পরিমাণ ১০০ বিঘা থেকে বৃদ্ধি করে ৩৭৫ বিঘায় উন্নীত করা হয়েছিল। ফলে গড়পড়তা চাষিপরিবার-প্রতি জমির পরিমাণ হ্রাস পায় এবং ভূমিহীনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেয়। পরিবারপ্রতি জমির সর্বোচচ সীমা পুনরায় ১০০ বিঘায় হ্রাস করে এবং এভাবে প্রাপ্ত অতিরিক্ত জমি সরকারের অধিকারে নিয়ে এসে সেগুলি খাসজমির সাথে ভূমিহীন চাষির মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করে। নদীভাঙন কবলিত জমির মালিকদের কর হ্রাসের বিধানসমূহ অক্ষুন্ন রাখা হয়। তবে এ ধরনের জমি পুনর্গঠনের পর সেখানে ঐ মালিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এতে সরকারি খাসজমি বন্দোবস্ত নীতির আওতায় অবশ্য এ ধরনের জমিতে ঐ মালিক বা তার বংশধরদের অগ্রাধিকার থাকে। একইভাবে, কোন চাষির জমিসংলগ্ন অতিরিক্ত জমির মালিকানা লাভের অধিকারও কেড়ে নিয়ে তা সরকারের অধিকারে দেওয়া হয়। অহস্তান্তরযোগ্য বন্ধকের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করা হয়। এতে সমসাময়িক চুক্তির মাধ্যমে জমি হস্তান্তর হলে তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পুনঃক্রয় করা ও বন্ধকগ্রহীতা কর্তৃক বন্ধককৃত জমি দখলে রাখার সময়সীমা ৭ বছরে হ্রাস করা হয় এবং দেওয়ানি আদালতের পরিবর্তে রাজস্ব কর্মকর্তার মাধ্যমে এ ধরনের বন্ধকীকৃত জমির দখল ফিরে পেতে বন্ধকদাতাকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। জমির ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান ও জমিরাজস্ব প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮৬ সালে যে রাজস্ব বোর্ড গঠন করেছিল তা রাষ্ট্রপতির ২ নম্বর আদেশের মাধ্যমে বিলোপ করা হয়। তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা এবং রাজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত হয়। বিভাগীয় কমিশনারের সিদ্ধান্তের ওপর আবেদনের শুনানি বিলুপ্ত ঘোষিত রাজস্ব বোর্ডের পরিবর্তে সরকারের ওপর ন্যস্ত হয়।

পরিবারপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমি কর রহিত করা হলেও উন্নয়ন ও সাহায্য কর এবং প্রাথমিক শিক্ষা করসহ অন্যান্য কর বলবৎ থাকে। ১৯৭৬ সালের ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ উল্লিখিত সকল কর মওকুফ করে মাত্রাঙ্কিত হারে ভূমি উন্নয়ন কর আরোপ করে। এতে পরিবারপ্রতি ২৫ বিঘার অতিরিক্ত কৃষিজমির জন্য শতকপ্রতি সর্বনিম্ন এক টাকা ও সর্বোচচ এক টাকা পয়তাল্লিশ পয়সা হারে কর প্রদান সাপেক্ষে কোন পরিবারের ২ একর পর্যন্ত জমির জন্য শতকপ্রতি বাৎসরিক সর্বনিম্ন ৩ পয়সা হারে কর ধার্য করা হয়। নগরী বা বৃহৎ শিল্পাঞ্চলে বাণিজ্যিক শিল্প স্থাপনের জন্য ব্যবহূত জমির মালিকদের শতকপ্রতি ৬০ টাকা হারে ভূমি কর ধার্য করা হয়। ঐ জমি যদি বাসস্থান বা অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহূত হয় তাহলে তার কর ধরা হয় শতকপ্রতি বাৎসরিক ১২ টাকা। জেলা সদরে বা পৌরসভা এলাকায় জমির মালিকদের বাণিজ্যিক ও শিল্প স্থাপনের কাজে ব্যবহারের জন্য শতকপ্রতি ১০ টাকা এবং বাসস্থান বা অন্য কাজে ব্যবহারের জন্য ৪ টাকা বাৎসরিক কর ধরা হয়। ১৯৮৫ সালে অকৃষিজমির উন্নয়ন কর এবং ১৯৮৭ সালে কৃষিজমির উন্নয়ন কর বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৯১ সালে সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির মালিক কৃষিপরিবার-এর কর বাংলা ১৩৯৮ সালের বৈশাখ মাস থেকে মওকুফ করে দেয়। ১৯৯৩ সালে ভূমি উন্নয়ন কর আবারও বৃদ্ধি করা হয়।

ভূমি হুকুমদখল আইন ১৮৯৪ এবং (জরুরি) সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন ১৯৪৮ বাতিলের পর সরকার ১৯৮২ সালে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশ জারি করে। এতে বাতিলকৃত আইনের অনুবিধিসমূহ পরিবর্তন করা হয় এবং অধিগ্রহণকৃত অব্যবহূত জমি পূর্বতন মালিক বা তার উত্তরাধিকার বরাবর খারিজের বিধান রাখা হয়। ভূমি রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করার পর থেকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তত্ত্বাবধায়কের কাজ, রাজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের পক্ষে বিভাগীয় কমিশনারের সিদ্ধান্তের ওপর আবেদনের শুনানি গ্রহণ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য ১৯৮০ সালে ভূমি প্রশাসন বোর্ড গঠন করা হয়। এতে একজন চেয়ারম্যান এবং কমপক্ষে ২ জন সদস্য থাকবে।

ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর মাধ্যমে বর্গাদার ও জমির মালিককে বীজ, সার ও সেচের খরচ সমানভাবে বহন করার এবং উৎপাদিত ফসলও সমানভাগে ভাগ করার বিধান দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে জমির মালিক যদি এ ধরনের খরচ বহনে অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে বর্গাদারকে ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ প্রদানের নির্দেশ দেয়। এই আইনে জমির মালিক ও বর্গাদারকে লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য বলা হয় এবং বর্গাদারকে কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ বা নিজে চাষ করার জন্য ছাড়া উচেছদ করা থেকে বিরত রাখা হয়। এই আইনে কোন মৃত বর্গাদারের উত্তরাধিকারকে বর্গাকালীন ঐ জমি চাষবাসের অধিকার দেয়। এই আইন কোন পরিবারকে ক্রয়, উত্তরাধিকার দান বা অন্যসূত্র থেকে ৬০ বিঘা পর্যন্ত জমি অর্জনের সর্বোচচ সীমা বেঁধে দেয়। অন্যের নামে বা বেনামিতে কৃষিজমি ক্রয় নিষিদ্ধ করা হয় এবং আপাত হস্তান্তরকারীকে ঐ জমির প্রকৃত মালিক হিসেবে বিবেচনার বিধান চালু করা হয়। এই আইন আদালত বা অন্যকোন কর্তৃপক্ষকে কোন কৃষকের বাসস্থান ক্রোক, বাতিল বা বিক্রয় থেকে এবং এ ধরনের জমি বেদখল বা উচ্ছেদ থেকে বিরত রাখে।

ভূমি খতিয়ান (পার্বত্য চট্টগ্রাম) অধ্যাদেশ ১৯৮৪ প্রথমবারের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে জমির জরিপ ও মালিকদের নামে খতিয়ান তৈরির বিধান করে। জরুরি সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন ১৯৮৯ বন্যা, নদীভাঙন ইত্যাদি কারণে জরুরি অবস্থা মেটানোর জন্য জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ ঋণ নিষ্পত্তি আইন ১৯৮৯, প্রতি থানায় ঋণ বন্দোবস্ত বোর্ড গঠনের বিধান করে দেয়। এই বোর্ড গরিব চাষি যারা মহাজনের কাছে বিক্রয়সহ বিভিন্নভাবে এক একর পর্যন্ত জমি ৩০,০০০ টাকায় হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে, তাদেরও ঐ জমি বন্ধক হিসেবে বিবেচনা করে অথবা ঐ হস্তান্তরকে বাতিল করে হস্তান্তরকারীকে জমি পুনরুদ্ধার করে দেওয়ার বিধান করে। ১৯৮৯ সালে ভূমি রাজস্ব বোর্ড দুভাবে ভাগ করা হয়: ভূমি সংস্কার বোর্ড এবং ভূমি আপিল বোর্ড। ভূমি সংস্কার বোর্ডকে তত্ত্বাবধান ও সকল রাজস্ব কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া হয় আর ভূমি আপিল বোর্ডের দায়িত্ব হয় বিচার বিভাগীয় বিষয়সমূহের নিষ্পত্তি বিধান করা এবং ভূমি আপিল বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদন সরকারের নিকট প্রেরণ করা। [কাজী এবাদুল হক]