রেশম

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৩৭, ১০ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

রেশম  বমবিকস মোরি বর্গভুক্ত রেশমপোকার গুটি থেকে তৈরি সুতা দিয়ে বোনা একপ্রকার সূক্ষ্ম ও কোমল তন্তু। বাংলায় দীর্ঘদিন থেকে চার ধরনের রেশম তৈরি হয়ে আসছে: মালবেরি, এন্ডি, মুগা এবং তসর। প্রথমটি তৈরি হয় বমবিকস বর্গের রেশমপোকার গুটি থেকে, যে পোকা মালবেরি বা তুঁত গাছের পাতা খায়; দ্বিতীয়টি তৈরি হয় ফিলোসেমিয়া বর্গের রেশমগুটি থেকে যারা ক্যাস্টর গাছের পাতা খায়; তৃতীয়টি অ্যান্থেরিয়া আসমেনসিন বর্গের রেশমগুটি থেকে, যারা কুল, তেজপাতা ও কর্পুরের পাতা খায় এবং চতুর্থটি অ্যানথেরি বর্গভুক্ত রেশমগুটি থেকে যারা ওক গাছের পাতা খায়। সচরাচর মালবেরি রেশম সবচেয়ে মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত।

রেশমগুটি বা কোকুন দেখতে অনেকটা কবুতরের ডিমের ন্যায়। কোকুনের সুতা অবিন্যস্ত, কিন্তু ভেতরে ৫০০ মিটারেরও বেশি লমতা একটি মাত্র সুতা সমকেন্দ্রীয়ভাবে বিন্যস্ত থাকে। কোকুন তৈরি হতে তিনদিন সময় লাগে। কোকুনের আকৃতি ও রঙে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ৮ দিনের মধ্যে গুটির ভেতর শুককীট পিউপায় পরিণত হয়। পিউপায় পরিণত হওয়ার পূর্বেই কোকুন গরম পানিতে সিদ্ধ করে ভেতরের পোকাটি মেরে ফেলতে হয়। এই কোকুন থেকেই রেশম সুতা সংগ্রহ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ পিউপা মথে পরিণত হয়ে গুটির প্রান্ত ফুটা করে যদি বের হয়ে আসে তবে সুতার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় এবং রেশম সুতার গুণগত মান হ্রাস পায়। ২ থেকে ৬টি গুটির ভেতরের সুতা একত্রিত করে একটি রিল তৈরি করা হয়। বাইরের পরিত্যক্ত সুতোগুলি পাকিয়ে স্প্যান সিল্ক প্রস্তুত করা হয় যার দ্বারা তৈরি হয় মটকা জাতীয় সিল্ক।

রেশমের নমুনা

রেশম সুতা উৎপাদনের লক্ষ্যে রেশমপোকা প্রতিপালনকে রেশম চাষ বলে। রেশম চাষের তিনটি পর্যায় রয়েছে: তুঁত গাছ চাষ, রেশমপোকা পালন এবং কাপড় তৈরির জন্য রেশমগুটির সুতা পৃথক করা। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে পুরোপুরি কৃষিভিত্তিক, তৃতীয় পর্যায় মূলত শিল্পগত ব্যাপার, যা নিষ্পন্ন হয় কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানে যা ফিলাচার নামে পরিচিত। রেশম উৎপাদন একটি জটিল প্রক্রিয়া। রেশমগুটি আসলে রেশম মথের শুঁয়াপোকা, এদের একমাত্র খাদ্য তুঁত পাতা। রেশমগুটি ডিম থেকে জন্মায় এবং গুটিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর্যায় শেষ করে রেশম মথ হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্ত্রী মথ তখন কালচক্র পুনরায় শুরু করার জন্য ডিম পাড়ে। গুটিবদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলিকে মেরে ফেলে সেগুলিকে গরম পানিতে সেদ্ধ করে সুতা ছাড়ানো হয় এবং পরে তা গোটানো হয়। এই সুতা বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হয়। বাংলাদেশে বছরে চার থেকে পাঁচটি রেশম মৌসুম থাকে। আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে একটি রেশম মৌসুম ৩০ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রধান প্রধান মৌসুমগুলি হচ্ছে চৈত্র, জ্যৈষ্ঠ এবং অগ্রহায়ণ।

রেশম থেকে প্রথমে হ্যান্ডলুম কিংবা পাওয়ার লুমে থান কাপড় প্রস্তুত করা হয়। রেশম থেকে প্রস্তুত পোশাকের মধ্যে শাড়ি, কামিজ, থ্রি পিস, লেহেঙ্গা, ওড়না, সার্ট, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, স্কার্ফ, রুমাল, টাই, বেবি ওয়্যার ইত্যাদি অন্যতম। শাড়ি এবং অন্যান্য তৈরি পোশাকে বৈচিত্র্য আনার জন্য বিভিন্ন ধরনের নকশা করা হয়। এসকল নকশায় রং, রঙিন সুতা, জরি, পুতি, কাঁচ, প­াস্টিক নানাবিধ উপকরণ ব্যবহূত হয়ে থাকে।

বন্দনা (রেশমী রুমাল, উনিশ শতক)

রেশমের ঐতিহ্যবাহী এবং অতি জনপ্রিয় শাড়ির নাম গরদ। রাজশাহী অঞ্চলে বুনানো এই শাড়ি রেশমের সতাভাবিক রঙের জমিনের বিপরীতে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লাল বা সবুজ এবং কখনও সোনালী জড়ির কাজ করা পাড় থাকে। পাড়ে রেখা, ত্রিভুজ ও জ্যামিতিক আকার সমৃদ্ধ সূক্ষ্ম নকশা থাকে। সতাভাবিক রঙের রেশমী কাপড়ের নাম কোরা, ক্ষারি বা ধোয়া হলে তার নাম হয় গরদ। গরদের শাড়ির পাড়ের রং যাই হোক না কেন, শাড়ির জমিন উজ্জল বা হাতির দাঁতের বর্ণ হয়ে থাকে। রেশমের তৈরি অপর একটি জনপ্রিয় শাড়ির নাম ঢাকার কাতান। ভারতের উত্তর প্রদেশের বেনারস থেকে আগত মোহাজেরগণ ঢাকা শহরের মালিটোলা, বেঁচারাম দেউড়ী, দক্ষিণ মৌসুন্ডি এবং লালমোহন সাহা স্ট্রিটে বেনারসি কাতান বয়ন আরম্ভ করে। পরে এরা মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে বসতি স্থাপন করে। কাতান বয়নে গর্ত তাঁত  (Throw Shuttle Loom) ব্যবহার করা হয়। এ তাঁতে শাড়ির নকশা তোলার কাজে জ্যাকার্ড ব্যবহার করা হয়। টানা ও বানাতে রেশমী সুতা ও বুটির জন্য জরি ব্যবহূত হয়। পাকান (Twisted) রেশমী সুতার নাম কাতান। বেনারসি শাড়িতে পাকান সুতা ব্যবহূত হয় বলে এর অপর নাম কাতান শাড়ি।

খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ বছর পূর্বে চীন দেশে সর্ব প্রথম রেশমকীট থেকে গুটি এবং গুটি থেকে সুতা উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়।

রেশম চাষের জন্য কলাকৌশল চীনারা প্রথম দিকে গোপন রাখলেও শেষ পর্যন্ত তা অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে বিগত সাড়ে পাঁচ হাজার বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রেশমকীটের সাহায্যে উৎকৃষ্ট মানের মিহি সুতা প্রাপ্তির কাজ চলে আসছে।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষেরদিকে লিখিত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গে সূক্ষ্মবস্ত্র সম্পর্কে বর্ণনা আছে। সেখানে পত্রোর্ণ নামক বস্ত্রের উল্লেখ আছে যেটি এক প্রকার বুনো রেশমবস্ত্র। পত্রোর্ণ (জাত) বস্ত্র পুন্ডদেশে (পৌন্ড্রিকা) উৎপন্ন হতো। পত্রোর্ণজাত বস্ত্র বলতে এন্ডি ও মুগজাতীয় বস্ত্রকে (পত্র হইতে যাহার উর্ণা (পত্রোর্ণ) বুঝানো হয়েছে। অমরকোষ এর মতে পত্রোর্ণ সাদা অথবা ধোয়া কোষের বস্ত্র; কীট বিশেষের জিহতারস কোনও কোনও বৃক্ষপত্রকে এই ধরনের উর্ণায় রূপান্তরিত করে।

প্রায় ২০০০ বছর পূর্বেই রেশমীবস্ত্র বাণিজ্য পণ্য হিসেবে গণ্য ছিল। তাঁতিদের বস্ত্র বিশেষত সূক্ষ্ম, সতচ্ছ মলমল যা ইউরোপে  মসলিন নামে পরিচিত ছিল। গ্রিক ও রোমের লেখকদের লেখা প্রাচীন গ্রন্থে ‘গাঙ্গেয় মসলিন’ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগে এগুলি ভারত থেকে আগত বিলাস সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল। সে সময় রোমে এসব পণ্যের সুন্দর কাব্যিক নাম ছিল যেমন ‘নেবুনা’ যার অর্থ কুয়াশা, বাষ্প বা মেঘ এবং ‘ভেন্টিটেক্সটিলেন’ অর্থ বুনন করা হাওয়া। নবম শতকের পর হতে পূর্ব ভারতে আগমনকারী আরবীয়, চীনা ও এবং ইউরোপীয় পরিব্রাজকরা বাঙলার ধনী বণিকদের সমন্ধে তাদের বিবরণে জানিয়েছেন যে, এ স্থান চীন দেশ থেকে আবিসিনিয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এ বাণিজ্যের অন্যতম পণ্য ছিল প্রথমে সুতি এবং পরে রেশম বস্ত্র। পতুর্গিজ ও ইরেজরা ১৬ শতকে প্রথম ভারতে আগমন করে, তখন বাংলায় সামুদ্রিক বাণিজ্যের একচেটিয়া দখল ছিল আরব, পারস্য ও অবাঙালি ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। তারা সাঁতগাঁও (হুগলী) এবং চট্টগ্রামে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করলে ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রসার ঘটে এবং পূর্বসাগর বাণিজ্যের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। ঐ সময় সাতগাঁও অঞ্চলে সুতি বা পাটের জমিনের উপর হলুদ তসর বা মুগা (পূর্ব বাংলা ও আসামের বুনো রেশম) সুতার সুচিকর্ম উৎপন্ন হতো। যা ইংল্যান্ড ও পর্তুগালে খুবই সমাদৃত ছিল। ১৬৩২ সালে হুগলীতে পর্তুগীজদের পতন ঘটে এবং এর সাথে সাতগাঁও কাঁথাও বিলীন হয়ে যায়, তবে সাদা সুতিতে মুগা বা তসরের সুচিকর্ম টিকে থাকে।

১৭ শতকের মধ্যভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুগল সরকার থেকে বাংলায় কয়েকটি ফ্যাক্টরি খোলার অনুমতি পায়। তারা মালদহ জেলায় কাসিমবাজারে চাষ করা রেশম এবং মিশ্রবস্ত্র, ময়ূরভঞ্জ তথা মেদিনীপুরের রেশম এবং সুতি মিশ্রণ ও সুতি কাপড়, ঢাকা এবং শান্তিপুরের সূক্ষ্ম মসলিন, এছাড়া শুধু ঢাকায় উৎপন্ন সূক্ষ্ম সুচিকর্ম (সাদা কাজ করা মসলিন বা চিকন নামে পরিচিত ছিল) নিয়ে কাজ করে। প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যের গতি মাঝারি রকমের ছিল কিন্তু হঠাৎ ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সাথে বিলাস দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং প্রচুর পরিমাণে বাংলার থান কাপড় ব্রিটেনে রপ্তানি হয়। ১৭ শতকের শেষ দিক থেকে ১৯ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত এ অবস্থা চলে। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার তাঁত শিল্পের একচেটিয়া বাণিজ্য দখল করে নেয়। তবে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপন্ন প্রথমে সস্তা কাপড় এবং পরবর্তীকালে সুতা (ইংলিশ টুইস্ট) বাংলার তাঁত শিল্পে প্রতিযোগী হয়ে ওঠে। এছাড়া মুগল ও নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় এ শিল্পে ধ্বস নামে। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ অধিকাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

বাংলায় ঠিক কখন থেকে মালবেরি রেশম প্রস্ত্তত শুরু হয় এ সংক্রান্ত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এটা নিশ্চিত যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ শিল্প এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ হিসেবে এই রেশম তৈরি প্রক্রিয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছিল বহু শতক আগেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তেরো শতকে সুদূর ইতালিতে এই রেশম গাঙ্গেয় সিল্ক নামে পরিচিত ছিল। বাংলায় রেশম উৎপাদনের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে দেখা যায়, গ্রামের গৃহস্থরা রেশম উৎপাদনের প্রথম তিনটি পর্যায় সম্পন্ন করে: মালবেরি বা তুঁত চাষ, রেশমগুটি লালনপালন এবং সুতা কাটা। তারপর সেই সুতা নিকটবর্তী গ্রাম বা শহরের দক্ষ তাঁতিদের কাছে বিক্রয় করা হয় বিভিন্ন প্রকার রেশম বস্ত্র তৈরির জন্য। বাংলায় এত বেশি রেশম উৎপাদিত হতো যে তা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পর প্রচুর পরিমাণে বাইরে রপ্তানি হতো। এই সিল্কের বাজারই প্রথম ইউরোপীয় বণিকদের বাংলায় আসতে আকৃষ্ট করে। ছোট আকারে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে পরিণতিতে ইউরোপীয় বণিক কোম্পানিগুলি বাংলার বস্ত্রশিল্পের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে।

ক্রমশ তারা বাংলার তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রভাবান্বিত করে এবং বস্ত্র রপ্তানির পরিবর্তে প্রসারণশীল বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী বস্ত্র তৈরির কাঁচামাল রপ্তানি শুরু করে। ১৮৩৫ সালের মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৎপরতা এ অঞ্চলের একশটি রেশম নিষ্কাশন কেন্দ্রকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে এবং প্রায় ৪০০ টন রেশম তৈরির কাঁচামাল রপ্তানি করে। এরপর থেকে প্রাইভেট কোম্পানিগুলি রেশমের কাঁচামাল বাণিজ্যকে ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণ করে এবং রেশমের রপ্তানি বাণিজ্য বেশ কিছুকাল জমজমাট থাকে। কিন্তু ১৮৭০-এর দশকে মহামারী আকারে রেশমকীটের রোগবিস্তার এবং কারিগরি দিক থেকে অচলাবস্থা সৃষ্টির দরুন বাংলার রেশম শিল্প বিদেশের বাজার হারায়।

বিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে বাংলার রেশম বস্ত্রের কদর কমে গিয়ে সেখানে কাশ্মীর ও মহীশূর সিল্কের চাহিদা তৈরি হয়। ১৯৩০ সালের মধ্যে চীন এবং জাপানের সিল্ক বাংলার রেশমের স্থান দখল করে, এমনকি বাংলায়ও এসব সিল্ক আসতে শুরু করে। এর ফলে বাংলায় কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। রাজশাহী জেলার একটি উদাহরণ থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮৭০-এর দশকের এক হিসাবে জানা যায়, রাজশাহীতে সিল্ক উৎপাদন থেকে প্রায় ২,৫০,০০০ লোকের কর্মসংস্থান হতো; ১৯০১ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪১,০০০ এবং ১৯২১ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬০০ জনে। সিল্ক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই বিপর্যয় বাংলার তৎকালীন সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।

১৯০৮ সালে সরকার রেশমপোকা চাষের জন্য একটি বিভাগ চালু করে। এটাই ছিল রেশম শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বাংলায় তুঁতগাছ চাষের এলাকা ১৮৯৬ সালে ছিল ৫৪,০০০ হেক্টর, ১৯১৪ সালে তা দাঁড়ায় ৭,০০০ হেক্টরে এবং ১৯৩৭ সালে ৪,০০০ হেক্টরে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরে অধিকাংশ রেশম উৎপাদক এলাকা ভারতের মধ্যে পড়ে। বাংলার তুঁতচাষ এলাকার ১০ ভাগেরও কম অংশ পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রায় ২,০০০ লোক জীবিকার জন্য রেশম উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল হয়।

এই রেশম উৎপাদনকারীরা ভারতের রেশমবস্ত্র তৈরির কারখানা ও সেখানকার বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রেশম উৎপাদনে পাকিস্তান সরকারের তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। রেশম শিল্পকে ব্যক্তিমালিকানায় গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে কোন উদ্যোক্তা এগিয়ে আসে নি; আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও কোন সংরক্ষণমূলক শুল্কনীতি ছিল না। সরকার রেশম উৎপাদনের কাঁচামাল আমদানির ব্যাপারে অবাধ সুযোগ দেয়। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষ রেশম শিল্পের উন্নয়নের জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এর ফলে ১৯৬২ সালের মধ্যে সরকারি অর্থায়নে রাজশাহী সিল্ক ফ্যাক্টরি চালু হয়। কিন্তু এসব পদক্ষেপ রেশম উৎপাদনকারীদের অবস্থার বিশেষ কোন উন্নতি ঘটাতে পারে নি। বিভাগকালীন সামান্য ৩০০ হেক্টর তুঁতচাষ এলাকা ১৯৭১ সালে ৫০০ হেক্টর পর্যন্ত প্রসারিত হয় এবং তা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের আনুমানিক ৫,০০০ লোকের কর্মসংস্থান হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রেশম শিল্পের উন্নয়নের জন্য অধিকতর সুসংবদ্ধ নীতি গ্রহণ করা হয়। এছাড়া এই শিল্প বৈদেশিক সাহায্য এবং কারিগরি সহায়তা লাভ করে। ১৯৭৭ সালে সিল্ক খাতের কার্যক্রম সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয়  উদ্যোগের অভাবে উন্নয়ন ধীরগতিতে চলে। ১৯৮০-র দশকে একটি মূল্যায়ন দলের অভিমত অনুসারে সেরিকালচার বা রেশমগুটির চাষ সরকারের একটি গৌণ খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়, যদিও গ্রামীণ কর্মসংস্থান এবং আয়ের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে এ শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। ইতোমধ্যে কতিপয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রেশম উৎপাদনে এগিয়ে আসে। স্থানীয়ভাবে কিছু সাফল্য অর্জিত হলেও অধিকাংশ উদ্যোগই নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। ১৯৮০-র দশকের শেষদিকে এসে দেশে তুঁতচাষ এলাকার পরিমাণ ছিল ৩,০০০ হেক্টর এবং রেশম খাত ৫০,০০০ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিল বলে ধারণা করা হয়। সে সময় বাংলাদেশের রেশম উৎপাদনের পরিমাণ ভারতের সিল্ক উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক ছিল।

রেশম উৎপাদন একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। রেশমগুটি থেকে রেশম তৈরি করা হয়। রেশমগুটি আসলে রেশম মথের শুঁয়াপোকা; এদের একমাত্র খাদ্য তুঁতপাতা। রেশমকীট ডিম থেকে জন্মায় এবং গুটিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর্যায় শেষ করে তারা রেশম মথ হিসেবে আবির্ভূত হয়। স্ত্রী মথ তখন কালচক্র পুনরায় শুরু করার জন্য ডিম পাড়ে। গুটিবদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলিকে মেরে ফেলে সেগুলিকে সেদ্ধ করে সুতা ছাড়ানো হয় এবং পরে তা গোটানো হয়। এর এই সুতা বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র তৈরির জন্য নানাভাবে প্রস্ত্তত করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় সবধরনের রেশমগুটিই গ্রামের হাটগুলিতে বাঁশের ট্রেতে করে প্রতিপালন করা হয়। রেশমগুটি পালন খুবই পরিশ্রমসাপেক্ষ, বিশেষ করে মৌসুমের শেষে যখন হাজার হাজার রেশমপোকা গোগ্রাসে পাতা খায় তখন তাদের পালনের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমের প্রয়োজন হয়। রেশম রং করা, বোনা ও ছাপা প্রভৃতি কাজ গ্রামের ছোট কারখানা এবং শহরের উন্নত ফ্যাক্টরিতে সম্পন্ন হয়। বাংলায় যারা সিল্ক তৈরি করে (তবে সচরাচর নিজেরা পরতে পারে না), তাদের মধ্যে রেশমের ভিন্ন ধরনের নাম প্রচলিত আছে। উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর নির্ভর করে এই নামকরণ করা হয়। যেমন রেশমগুটি পালনকারীকে বলা হয় বোসনি, রেশমগুটিকে পোলু, গুটির সুপ্তাবস্থাকে চোঞ্চ বা বিজন গুটি, গুটি মেলার বাঁশের চালনকে বলে চন্দ্রোকি, ১,২৮০টি রেশমগুটিকে কাহন, রেশমকীটের মহামারী রোগকে কোটা রোগ এবং জীবাণু সংক্রামক মাছিকে বলা হয় উজি।

বাংলাদেশের রেশম বাজার পুরোপুরি স্থানীয়। কখনও কখনও স্থানীয় সরবরাহের বাইরেও রেশমের চাহিদা দেখা যায় এবং বৈধ ও অবৈধ উপায়ে প্রধানত ভারত থেকে রেশমবস্ত্র আমদানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর জীবনে রেশমের একটি উলে­খযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। একখানি রেশম শাড়ির আভিজাত্য একটি দামি সুন্দর পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি। রেশম শাড়ি বিত্ত, সভ্যতা, বাঙালি রমণীর ঐতিহ্যগত সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক। সিল্কের বিভিন্ন নমুনা এবং ডিজাইনের জন্য বাংলা ভাষায় বিশেষ বিশেষ নাম প্রচলিত, যেমন গরদ, মটকা, বেনারসি প্রভৃতি।  [উইলেম ভ্যান শ্যান্ডেল]