রহমান, মশিহুর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:৫২, ৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
মশিহুর রহমান

রহমান, মশিহুর (১৯২৪-১৯৭৯)  রাজনীতিক। তিনি যাদু মিয়া নামে সমধিক পরিচিত। ১৯২৪ সালের ৯ জুলাই নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলায় খগাখড়িবাড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ওসমান গণি ছিলেন একজন জোতদার এবং মাতা আবিউন্নেসা বেগম। মশিহুর রহমান খগাখড়িবাড়ি গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ডিমলায় রানী বৃন্দাময়ী স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশের পর তিনি ভারতের জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু অচিরেই তিনি মেডিক্যাল স্কুল ত্যাগ করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৩৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় (বাংলা ১৩৪০) মশিহুর রহমান রংপুরে গঠিত ফুড কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। এরপর তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগের অধীনে গঠিত ইয়ং ম্যান্স অ্যাসোসিয়েশনের পূর্ববঙ্গ শাখার প্রধান নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি মুসলিম লীগের রংপুর জেলা শাখার জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। মশিহুর রহমান স্থানীয় সরকার পর্যায়ের রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি রংপুর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নীতি এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতির কারণে তিনি এই দল ত্যাগ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনে ভূমিকা রাখেন। তিনি ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কৃষক সমিতির সাথেও যুক্ত ছিলেন।

১৯৬২ সালে মশিহুর রহমান মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় রংপুর-৫ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে নীলফামারী থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে পুনরায় তিনি জাতীয় পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারের প্রতি তাঁর বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়। আন্দোলন সমর্থন করার কারণে ১৯৬৩ সালে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এক মাস কারাভোগের পর আন্দোলনের চাপে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। সরকারের নিপীড়ন এবং ১১ দফা দাবির প্রেক্ষাপটে মশিহুর রহমান ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

মশিহুর রহমান ১৯৭০ সালে খুলনায় অনুষ্ঠিত ন্যাপের কাউন্সিল অধিবেশনে ন্যাপের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের বিরোধিতা করার কারণে ১৯৭০ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং ৮ মাস কারাভোগ করেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে চলে যান। কিন্তু পরে দেশে ফিরে এসে পাকবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি দালাল আইনে গ্রেফতার হন এবং ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে মুক্তিলাভ করেন। একই বছর জুন মাসে পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট মুক্তিলাভ করেন।

১৯৭৬ সালে মশিহুর রহমান মওলানা ভাসানীর সাথে মিলিত হয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করা এবং পানির সুষম বন্টনের জন্য আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের নিমিত্তে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে মওলানা ভাসানী, মশিহুর রহমান এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে ফারাক্কা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এই সমাবেশের পর তাঁরা রাজশাহীর প্রেমতলী থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট (ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত) পর্যন্ত লং মার্চ করেন।

১৯৭৭ সালে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর মশিহুর রহমান ন্যাপের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল গঠিত হলে মশিহুর রহমান এ দলে যোগ দেন এবং ১৯৭৮ সালে নির্বাচনের সময় দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হলে মশিহুর রহমান দলের ভাইস-চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।

১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মশিহুর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় রেলপথ, মহাসড়ক এবং সড়ক পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর সময়ে চট্টগ্রাম, সিলেট এবং উত্তরবঙ্গের (একতা, সমতা ও শাহজালাল এক্সপ্রেস) সাথে প্রথমবারের মতো রেলযোগাযোগ শুরু হয়। তিনি এশিয়ান হাইওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন।

মশিহুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বাইরে জনহিতৈষী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে রংপুর জেলা বোর্ডের চেয়্যারম্যান থাকাকালীন দুর্ভিক্ষপীড়িত ও দুর্যোগপ্রবণ নিম্নাঞ্চলে বিশেষত বৃহত্তর রংপুরের উন্নয়নে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁর নামে কুড়িগ্রামের একটি চরের নামকরণ হয় যাদুর চর। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম সমবায় সংগঠন রংপুর ডিস্ট্রিক্ট কনজ্যুমার্স সোসাইটি লিমিটেডের সভাপতি ছিলেন। মশিহুর রহমান ছিলেন খেলাধূলায় পারদর্শী এবং একজন নামকরা ক্রীড়া সংগঠক। তিনি রংপুর ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্ট্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ১৩ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়। [লিলীমা আহমেদ]