গ্রাম

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:২৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

গ্রাম জনবসতির ক্ষুদ্রতম একক এবং রাষ্টীয় প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নিম্নতম একক হলো গ্রাম। একে শহরের মহল্লা বা ওয়ার্ডের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। এটি সরকারের নিম্নতম রাজস্ব একক মৌজার সঙ্গেও অনেকটা অভিন্ন। ভূমিকরের আওতাধীন সকল জমি মৌজার অন্তর্ভুক্ত, আর গ্রাম হচ্ছে মৌজাভুক্ত সমাজ ও বন্দোবস্ত মহাল। এ অর্থে একটি নির্দিষ্ট মৌজা একের অধিক গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। দক্ষিণ এশীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে যে দুটি সত্তা লক্ষ্য করা গেছে তা হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্রাট এবং সর্বনিম্ন স্তরে গ্রাম। রাজ্যের রাজস্বের মূল উৎস গ্রাম বিধায় উপনিবেশ-পূর্ব সব সাম্রাজ্যে সম্রাটরা গ্রামের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করতেন। সাম্রাজ্যের আর্থিক সংস্থানের প্রশ্নে শাসকগণ গ্রামকে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানরূপে বিবেচনা করতেন।

আবহমান কাল থেকে দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করত এবং সামাজিক ও কৃষি ক্ষেত্রে সব গ্রাম ছিল অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। রাজার কর্মচারিরা পাওনা আদায়ের জন্য গ্রামে আসত আর গ্রামের লোকেরা নিরাপত্তার জন্য রাজার ওপর ছিল নির্ভরশীল। গ্রাম ছিল এক স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান। কর্মসাধনের জন্য গ্রামে গড়ে উঠত নাপিত, ধোপা, হাজাম, মাঝি, বাহক, মেথর, এবং কাঠমিস্ত্রি ও ধাতব কারিগরের ন্যায় বিশেষজ্ঞ দল। গ্রামবাসীদের পারস্পরিক সম্পর্ক বাধা ছিল প্রথা, কর্তৃত্ব ও পারস্পরিক দায়িত্ব বোধের নিয়মবন্ধনে।

সমাজবিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবেত্তাগণ বাংলার গ্রামগুলোর স্বায়ত্তশাসিত ও আত্মনির্ভর প্রকৃতি সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ না করলেও গ্রামের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দিক সম্পর্কে তারা ভিন্নমত পোষণ করতেন। গ্রামীণ সভার (গণসভা) ধরন সম্পর্কেও মতের ভিন্নতা আছে। বাংলার অধিকাংশ স্থানে স্বশাসন ও প্রতিরক্ষা পদ্ধতি সম্ভবত একইভাবে কাজ করে নি। ভৌগোলিক অবস্থা, জনবসতি এবং ফসল বৈচিত্র্যের কারণে গ্রামগুলো ছিল আকারে ক্ষুদ্র ও বিক্ষিপ্ত। এভাবে গ্রামীণ সমাজ উত্তর ভারতের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বিকশিত হয়েছে, কিন্তু বাংলায় পুনরাবৃত্ত হয় নি। এরূপ বিশ্বাসের কারণ রয়েছে যে, রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চলে গ্রাম বসতি ছিল বেশ বিস্তৃত এবং সেখানে গড়ে উঠেছিল পঞ্চায়েত  ধরনের গ্রামীণ সমাজ। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র-পদ্মা-গঙ্গার সমভূমিতে সম্ভবত এ পদ্ধতি অতি দুর্বল ছিল এবং সেখানে গ্রামীণ সমাজ ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছিল। ব-দ্বীপ এলাকায় গ্রামীণ সমাজ গড়ে উঠার মতো বৃহদায়তন হওয়ার আগেই গ্রামগুলো ভেঙে যায় এবং চাষাবাদ এলাকায় গড়ে ওঠে নতুন বসতি। পূর্ববঙ্গের জেলাগুলোতে গ্রামীণ বসতি ও গ্রামীণ সমাজের পৃথক বৈশিষ্ট্যের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয়ে গ্রাম পর্যায়ে কর্মকর্তা নিয়োগ করতেন যাতে তারা রাজস্ব বিলিব্যবস্থা এবং রাজস্ব সংগ্রহের প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এভাবে বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় গ্রামে আমরা পাটোয়ারী, কানুনগো, তরফদার, মাজমুয়াদার, ওয়াদ্দাদার, কুটকিন্দার, সেজওয়াল প্রভৃতি সরকারি কর্মচারীদের অবস্থান দেখতে পাই। তবে যেখানে গ্রামীণ সভা বিদ্যমান সেসব অঞ্চলে কদাচিৎ এদের সাক্ষাৎ মেলে। মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র সাধারণত গ্রামীণ সভার আমলাদের কাজে হস্তক্ষেপ করত না। কিন্তু বাংলায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক অনুপস্থিতিতে গ্রাম পর্যায়ে রাষ্ট্র তার কর্মকর্তা নিয়োগ করত।

গ্রামীণ কর্মকর্তারা জমিদারদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়ে এবং তারা ভূমিকর আদায় ছাড়াও নানা ধরনের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। গ্রামীণ আমলা এবং তাদের ঊর্ধ্বতন জমিদারগণ শুধু খাজনা নির্ধারণ ও খাজনা সংগ্রহের কাজেই নিয়োজিত ছিলেন না, গ্রামের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বও তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। গ্রাম্য মাতববর বা নেতৃস্থানীয় লোকদের সহায়তায় তারা গ্রামের সব ধরনের বিবাদ মীমাংসা করত। তাছাড়া গ্রামের লোকেরা রাষ্ট্রীয় আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামের সীমার মধ্যে বাঁধ, পানি নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জলাধার, সেতু ও কালভার্ট দেখাশোনা করত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মহামারী একইভাবে মোকাবেলা করা হতো।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) গ্রামীণ ব্যবস্থাপনার প্রচলিত কাঠামোকে প্রায় সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। নতুন ব্যবস্থায় জমির চূড়ান্ত স্বত্বাধিকারী হয়ে জমিদার গ্রামে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। পূর্বে রায়তরা ছিল জমির স্থায়ী দখলদার, কৃষক হিসাবে স্বাধীন এবং জমিদারদের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত। জমিদাররা ছিল গ্রামে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি আর রাষ্ট্রের নিকট গ্রামের প্রতিনিধি। জমিদারি ব্যবস্থায় গ্রামের রায়তরা প্রজা বা জমির মালিকদের ভাড়াটিয়াতে পরিণত হয়। গ্রামের ব্যবস্থাপনায় জমিদারদের ছিল নতুন ব্যবস্থা। জমিদারি কাচারির কর্তাব্যক্তিরা পূর্বের ন্যায় প্রায়ই পাটোয়ারি, কানুনগো  ইত্যাদি নামে অভিহিত হতো, কিন্তু তাদের কার্যক্রম একই রকম ছিল না। তখন থেকে তারা প্রায়ই পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে বিশেষভাবে উনিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্যাপক কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বাংলার  গ্রামগুলো জরিপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতোপূর্বে গ্রাম এবং ভূ-সম্পত্তির স্থায়ী সীমারেখা ছিল না। বন্দোবস্তের কাগজপত্রে  জমির অধিকার, সীমানা চিহ্নিতকরণ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ ছাড়াই সর্বমোট কর নির্ধারণসহ একগুচ্ছ গ্রামের উল্লেখ ছিল। একটি গ্রাম প্রায়ই অনেক মালিকের আয়ত্তাধীন ছিল এবং তাদের স্ব স্ব অধিকারসীমা সুস্পষ্টভাবে নির্দেশিত ছিল না। ফলে কৃষকের উপর এক্তিয়ার এবং জমিতে মালিকানা অধিকারের সীমা নিয়ে প্রায়ই বিবাদ দেখা দিত; আর এ বিবাদ প্রায়ই রক্তাক্ত দাঙ্গা এবং মামলা মোকদ্দমায় রূপ নিত। কৃষক অসন্তোষ দমন এবং গ্রাম পর্যায়ে উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কতিপয় জরিপ সমীক্ষা পরিচালিত হয়। চল্লিশের দশকে থাকবস্ত জরিপ মাধ্যমে গ্রাম এবং গ্রামের অভ্যন্তরীণ ভূসম্পত্তির খসড়া মানচিত্র তৈরি করা হয়। রাজস্ব জরিপ সমীক্ষা পরিচালিত হয় ষাট ও সত্তরের দশকে। এ জরিপে গ্রাম ও গ্রামের ভূ-সম্পত্তির সীমানা চিহ্নিতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। জরিপে দেখা যায় যে, বাংলার অধিকাংশ গ্রামে বহু স্বত্বাধিকারী ছিল। গ্রামের অভ্যন্তরে তাদের জমির সীমানা চিহ্নিতকরণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জমিতে রায়ত এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের অধিকার শনাক্তকরণ, সংজ্ঞায়ন এবং সীমানা চিহ্নিতকরণ ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের অধীনে শুরু করা এ জরিপকার্য বাংলার জেলাসমূহে তপসিল-ভুক্তি জরিপ ও বন্দোবস্ত প্রণালীর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। উনিশ শতকের আশির দশকের শেষদিকে শুরু করা জরিপের কাজ সমাপ্ত হয় বিশ শতকের বিশের দশকের শেষদিকে। এ জরিপ ও বন্দোবস্ত গ্রামের জমিতে মালিকানা শনাক্ত ও সংজ্ঞায়িত করে। বাংলার প্রত্যেক গ্রামের জন্য দাগভিত্তিক অনুপুঙ্খ অধিকার সম্বলিত মৌজা মানচিত্র প্রস্ত্তত করা হয়। মালিকানা, প্রজাস্বত্ব, উপপ্রজাস্বত্বের ক্রমতালিকা সম্বলিত অধিকারের খতিয়ান এবং শেষে গ্রামের মধ্যে রায়তি অধিকার শনাক্ত, নথিভুক্ত, প্রত্যায়িত এবং পরিশেষে সংরক্ষণ ও বরাতের জন্য মুদ্রিত অবস্থায় সংরক্ষিত হয়।

গ্রামের বন্দোবস্তের ধরন সমগ্র বাংলাদেশে একরূপ ছিল না। ভূসংস্থান গ্রামের বন্দোবস্তের ধরন নির্ধারণ করে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বড় নদীর তীরবর্তী গ্রাম ব্যতিক্রমহীনভাবে সরলরৈখিক, কারণ নদীতীরের দূরবর্তী জমি নিচু ও বন্যাপ্রবণ। উত্তরবঙ্গের গ্রামগুলো সাধারণত পুকুর-ডোবার চারদিকে কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলায় বাড়িঘর সাধারণত ফসলী জমির মধ্যস্থল বা পার্শ্বে তৈরি হয় যেখানে জমি সমতল এবং খাঁড়ি ও খাল পথে পানি সরবরাহযোগ্য। বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের হাওড় এলাকায় গ্রামগুলো প্রাকৃতিক বাঁধের ওপর (স্থানীয় ভাষায় কান্দা) নির্মিত ও কেন্দ্রীভূত। হাওর এলাকার গ্রামগুলো বৃহদায়তন, কারণ ঢিবির বাইরে কোনো বসতি স্থাপন সম্ভব হয় না। শুষ্ক মৌসুমে ফসল তোলার সময় মূল গ্রাম থেকে দূরবর্তী হাওড়ের বুকে অস্থায়ী ক্ষুদ্র গ্রাম তৈরি করা হয়। ফসল কাটার পর বর্ষার প্রাক্কালে গ্রামের কাঠামো ভেঙে ফেলা হয় এবং সংগৃহীত ফসলসহ বাড়িঘরের অবশেষ মূল গ্রামে স্থানান্তরিত হয়। পার্বত্য অঞ্চলে গ্রামগুলো আকারে ছোট এবং সেগুলো তৈরি হয় বসবাসের উপযোগী উচু ভুখন্ডে অথবা উপত্যকার বন্যামুক্ত নিম্নভূমিতে।

প্রথা, আচার-আচরণ, সমাজ কাঠামো ও সামাজিক রীতিনীতিতে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ঐক্য পরিলক্ষিত হয় না। অংশত যোগাযোগ এবং অংশত উৎপাদন ও বন্টনের ধরনের জন্য গ্রামগুলো কমবেশি পরস্পর থেকে বিচিছন্ন এবং এক গ্রামে অনুসৃত প্রথা ও রীতিনীতির খুব সাযুজ্য দেখা যায় না দূরবর্তী প্রতিবেশী গ্র্রামে। ওজন ও পরিমাপ, ভূমি ব্যবস্থা, খাজনা কাঠামো ইত্যাদি জেলা থেকে জেলায়, এমনকি পরগণা থেকে পরগণায় ভিন্নতর। এমনকি সব জেলায় একক মুদ্রা গ্রহণযোগ্য ছিল না। সিলেটে যখন কৌড়ির প্রাধান্য ছিল তখন ত্রিপুরায় আর্কট রূপী এবং নোয়াখালি ও চট্টগ্রামে দশমাষা রূপী চালু ছিল। রংপুর ও দিনাজপুরে নারায়ণী রূপী এবং ঢাকায় সিক্কা রূপী প্রচলিত ছিল। সুতরাং গ্রামগুলো সামাজিক ও কাঠামোগতভাবে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বংশানুক্রমিকভাবেই গ্রামের মর্যাদা-স্তর নির্ধারিত ছিল। গ্রামের জমিদার ও তালুকদার গ্রামীণ সমাজের শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করত। তাদের নিচে ছিল মধ্যস্বত্বভোগী এবং তাদের পরেই গৃহস্থ বা সম্পন্ন কৃষকদের মর্যাদাগত অবস্থান। সমাজের ভিত্তি গড়ে ওঠে সাধারণ কৃষকদের নিয়ে। ভূমিহীন ভাগচাষী এবং ক্ষেতমজুররা ছিল সামাজিক সোপানতন্ত্রের সর্বনিম্ন স্তরে। সুন্দরবন এলাকার গ্রামে সামাজিক ক্রমবিন্যাস ছিল বেশ দীর্ঘ যেখানে জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুন গ্রাম পত্তন করা হয়েছিল। জমিদার ও প্রকৃত চাষীদের মধ্যে ছিল মধ্যস্বত্বভোগীদের বিভিন্ন স্তর।

বিশ শতকের শুরু থেকে গ্রামের সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন সূচিত হয়। পাট অর্থনীতি, শিল্পায়ন, উন্নততর যাতায়াত ব্যবস্থা এবং কৃষক পর্যায়ে জমি হস্তান্তর জমিদার শ্রেণির নিচে ভূমিভিত্তিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দেয়। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে ভূমিমালিক শ্রেণির মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসচ্ছলতা, প্রান্তিক চাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কৃষকদের মধ্যে ঋণগ্রস্ততার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ প্রবণতার ফলে গ্রামীণ সমাজ-কাঠামোর স্তরবিন্যাসের পার্থক্য ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন দ্বারা। এ আইনের অধীনে জমিদার থেকে নিম্নতম মধ্যস্বত্বভোগী পর্যন্ত খাজনা আদায়ী গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিলোপ করা হয় এবং জমির উপর কৃষকের মালিকানা স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পদক্ষেপ গ্রামের সামাজিক ও উৎপাদন সম্পর্ক পরির্বতন করে দেয়। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি প্রযুক্তির পরিবর্তন, শিক্ষা বিস্তার, দ্রুত শহরায়ন এবং জমিতে পুঁজি বিনিয়োগের ফলে গ্রামের পরিবর্তিত কাঠামো নতুন মাত্রা লাভ করে। এ প্রক্রিয়ায় গ্রামের জমি গ্রামের কিছুসংখ্যক পুঁজিপতি কৃষকের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। ভূমিতে পুঁজি খাটানোর ফলে সৃষ্ট ভূমিহীনতা এবং কৃষকশ্রেণীর প্রান্তিকায়ন সমস্যা গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক কৃষক এখন হয় ভূমিহীন নয় অতি প্রান্তিক। বেঁচে থাকার তাগিদে এসব গ্রামের মানুষ এখন শহরে গিয়ে উঠছে অথবা গ্রামে বা গ্রামের বাইরে অকৃষি কার্যক্রমে নিয়োজিত হচ্ছে। তাদের অধিকাংশ কৃষিখাতে শ্রম বিক্রি করে  জীবিকা নির্বাহ করে। গ্রামের মানুষ এখন ধনী কৃষক, প্রান্তিক কৃষক, খামার শ্রমিক, অ-কৃষি শ্রমিক এবং বিভিন্ন বিকল্প পেশায় নিয়োজিত ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত।

১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে গ্রামের সংখ্যা ৬১,৪৯৩। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুয়ায়ী এ সংখ্যা ৬৮,০৩৮ এবং প্রতি গ্রামে পরিবারের সংখ্যা গড়ে ২৩২।

গ্রামের অর্থনীতিতে এখন পরিলক্ষিত হয় রূপান্তর ও তুলনামূলক সমৃদ্ধির চিত্র। উপনিবেশিক আমলের ন্যায় বাংলাদেশের গ্রাম এখন আর অপরিবর্তনীয় ও আত্মনির্ভর নয়। বিশ শতকের ষাটের দশকের প্রথমদিক থেকে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। গ্রামের অবস্থার উন্নতির জন্য বিভিন্ন সরকার ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নেয়। অধিকাংশ গ্রাম এখন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর এবং কোনো কোনো জেলা অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে। গ্রামে গ্রামে এখন যান্ত্রিক কর্ষণ, সেচ ও মাড়াই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ভারবাহী পশুপালনের বিপুল ব্যয় ও ঝুঁকির কারণে কৃষকগণ এখন ক্রমবর্ধমান হারে কলের লাঙ্গলের ওপর নির্ভরশীল। প্রচলিত জাতের ফসলের পরিবর্তে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের চাষ হচ্ছে। গ্রামের জমির বৃহত্তর অংশ মোটামুটি সেচের আওতায় আনা হয়েছে। সর্বত্র রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচেছ। এর ফলে খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে। পূর্বে হাতে ধান ভানা হতো; কিন্তু এখন যন্ত্রচালিত ধান ভানা সর্বত্র চালু হয়েছে। গবাদি পশুপালন, দুগ্ধ খামার, হাঁসমুরগি পালন, হ্যাচারি, মৎস্য চাষ, হিমাগার ইত্যাদি কৃষি-ভিত্তিক শিল্পপ্রকল্প স্থাপনের জন্য সাধারণত শহরসংলগ্ন গ্রাম বাছাই করা হয়। অধিকাংশ এনজিও-র রয়েছে গ্রাম উন্নয়নের প্রকল্প। প্রায় সব গ্রামে রয়েছে এক বা একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় (আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক)। গড়ে প্রায় দুটি গ্রামের জন্য রয়েছে একটি করে মাধ্যমিক ও উচচ বিদ্যালয়। প্রতি জেলায় বহুসংখ্যক গ্রাম এখন বিদ্যুতায়িত। এক কথায় বাংলাদেশের গ্রাম এখন খাদ্যাভাব ও ক্ষুধার অবসানের দ্বারপ্রান্তে সমুপস্থিত।  [সিরাজুল ইসলাম]