হরিকেল মুদ্রা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:০১, ২৯ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

হরিকেল মুদ্রা  গুপ্ত পরবর্তী যুগে বাংলায় রৌপ্যমুদ্রার পুনরাবির্ভাব হয় হরিকেল মুদ্রার মধ্য দিয়ে। বিশ শতকের ষাটের দশকে এই মুদ্রাগুলি গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খ্রিস্টীয় সাত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ বা আট শতকের প্রথমার্ধে নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চল এবং ত্রিপুরার বেশ খানিকটা অংশ নিয়ে গঠিত ছিল প্রাচীন  হরিকেল রাজ্য। খ্রিস্টীয় ৬৭৩-৬৮৭-তে চৈনিক পরিব্রাজক  ই-ৎসিঙ্ ভারতবর্ষ ভ্রমণে এসে এই এলাকা সফর করেন। তিনি হরিকেলকে ভারতবর্ষের পূর্বের সীমা বলে তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করেন।

শুরুতে এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন খড়গ বংশের রাজাগণ, পরবর্তীকালে দেব বংশের অভ্যুদয় হয়। অপর একটি রাজবংশের কথাও জানা যায়, যাঁরা আনুমানিক আট শতকে এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন। এঁদের নামের শেষে ‘আকর’ উপাধি ব্যবহূত হতো। একই ধরনের মুদ্রায় রাজার নাম রয়েছে ললিতাকর, রম্যাকর, প্রদ্যুম্মাকর, অন্তাকর বা অন্যাকর। এই রাজবংশের রাজত্বকাল লিপিতত্ত্বের আলোকে দশ শতকের বলে মনে হয়।  ময়নামতী এবং ত্রিপুরার বিলোনিয়ার বিশাল মুদ্রাভান্ডার থেকে দেশীয় ও বৈদেশিক অঙ্গনে একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থার কথা জানা যায়। ধারণা করা হয় যে, দ্বিতীয় পর্যায়ের হরিকেল মুদ্রাগুলি চন্দ্ররাজাদের দ্বারা প্রচলিত হয়।

হরিকেল মুদ্রা

বাংলাদেশ এবং ত্রিপুরার একাধিক স্থান থেকে হরিকেল মুদ্রা পাওয়া গেছে। স্থানগুলির মধ্যে সিলেটের মুদ্রাভান্ডারের কথা সর্বপ্রথম জানা যায়। এখানে ৩০-৪০টি হরিকেল মুদ্রার কথা জানা যায়, যেগুলির মধ্যে ৮টি বর্তমানে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। ময়নামতীর আনন্দবিহারে পাওয়া ৬৩টি মুদ্রা বর্তমানে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। শালবন বিহারের ১৩নং কুঠরি থেকে ১৭৫টি এবং ৩নং কুঠরি থেকে ৫২টি হরিকেল মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রাম থেকে দুরকম মাপের ২৮টি মুদ্রা পাওয়া গেছে। বিলোনিয়ার মুদ্রাভান্ডার থেকে বেশির ভাগ কম বেধ যুক্ত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। শেষোক্ত মুদ্রাগুলি বিলোনিয়া ছাড়া সিলেট ও ময়নামতীতেও পাওয়া গেছে। পশ্চিমের মুদ্রাবিদগণ দ্বিতীয় পর্যায়ের মুদ্রাগুলিকে ‘ব্র্যাকট্রিটস’ বলে অভিহিত করেন।

হরিকেল মুদ্রা বিভিন্ন ওজন ও আকারে পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলি সবই গোলাকার। প্রথম দিকের মুদ্রার প্রামাণিক ওজন ছিল ৬৪ রতি যা মোটামুটিভাবে ৭.৫ গ্রাম। পরে হরিকেল মুদ্রার প্রামাণিক ওজন কমে গিয়ে ৬০ ও ৫০ রতিতে পরিণত হয়। প্রাপ্ত মুদ্রার রেকর্ডকৃত ওজন ৭.৬ থেকে ৪.৫ গ্রামের মধ্যে এবং এর ব্যাসও পরিবর্তিত হয়েছে ৩.২ থেকে ২.৬ সেন্টিমিটারের মধ্যে। এর থেকে প্রামাণিক পূর্ণ মুদ্রা (৭.৬ গ্রাম), অর্ধ (৩.৮ গ্রাম), সিকি (১.৯ গ্রাম), অষ্টমাংশ (০.৯৫ গ্রাম) ও ষোড়শাংশ (০.৪৫ গ্রাম) - এই রকমের বিভিন্ন মানের হরিকেল মুদ্রা সম্বন্ধে জানা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ের মুদ্রা বা ‘ব্র্যাকট্রিটস’গুলি ওজনেও যেমন কম সেরকম এগুলির বেধও বেশ কম ছিল। এগুলির ওজন ২.৩৮ থেকে ৩.৩৭ গ্রামের মধ্যে, আর ব্যাসও পরিবর্তিত হয়েছে ৪.৮ থেকে ৫.৫৩ সেন্টিমিটারের মধ্যে। তবে অত্যন্ত বিরল কিছু মুদ্রার সর্বোচ্চ ওজন ও দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৪.৩১ গ্রাম এবং ব্যাস ৫.৯৫ সেন্টিমিটারও দেখা গেছে। এই শ্রেণির মুদ্রার ওজনের মান এবং বাইরের চিত্রাঙ্কণে সম্ভবত আববাসীয় মুদ্রার প্রভাব রয়েছে।

হরিকেলের এই রৌপ্য মুদ্রায় খুব উচ্চমানের রূপার ব্যবহার দেখা যায়, মোটামুটিভাবে রূপার বিশুদ্ধতা ৯৫.১৩%। এর সঙ্গে মিশ্রিত সোনা, সীসা ও তামার পরিমাণ যথাক্রমে ০.৫৯, ০.৩৮ ও ৩.৬২%। হরিকেল মুদ্রা তৈরিতে আগে থেকে ওজন করা ধাতুর গুটির ব্যবহার হতো। এর পর হাতুড়ির সাহায্যে পেটাই করে মুদ্রার নির্দিষ্ট চাকতিতে পরিণত করে নিয়ে পরে মুদ্রার ‘ডাই’-এর সাহায্যে পেটাই করে চিত্রাঙ্কণ করা হতো। ধাতুবীক্ষণের সাহায্যে দেখা যায় মুদ্রার অভ্যন্তরে ঢালাই এর গঠনের সঙ্গে পরিবর্তিত সমান্তরাল ব্যান্ড-এর অবস্থান। প্রাথমিকভাবে ওই ধাতুর গুটি নির্মিত হতো ছোট মুচিতে এবং নির্ধারিত মান অনুযায়ী প্রয়োজনীয় রূপা গলিয়ে নেওয়া হতো। যতদূর মনে হয় রূপায় তামার সংযোজন আগেই করা হতো। কিছু কিছু মুদ্রার বাইরের দিকের ঢেউ খেলান ধার থেকে নির্দিষ্টভাবে বলা যায় যে, নেহাইয়ের উপর রেখে হাতুড়ির সাহায্যে পেটাই করে এগুলি নির্মিত হতো। অপরদিকে ব্র্যাকট্রিটসগুলি নির্মাণে ধাতুর পাত থেকে মুদ্রার আকারে চাকতি কেটে নেওয়া হতো। পরে এই চাকতিগুলিকে আবার মোটা চামড়ার উপরে রেখে ‘ডাই’-এর সাহায্যে পেটাই করে চিত্রাঙ্কণ করা হতো। প্রথমদিকে দুদিকেই পেটাই করে চিত্রাঙ্কণ করা হলেও পরে ধাতুর বেধ কম থাকায় শুধু এক দিকেই তা করা শুরু হয়।

মুদ্রার মুখ্যদিকে অর্ধশায়িত বৃষের মূর্তি রয়েছে। বৃষের গলায় কখনও কখনও ঘণ্টা বা ঘুঙুরের ব্যবহারও দেখা যায়। গৌণ দিকে ত্রিশূল আকৃতি চিহ্ন রয়েছে। বাইরে রয়েছে ঝুলন্ত অবস্থায় মালা। মুখ্য ও গৌণ উভয়দিকেই চিত্রের বাইরে বিন্দুমন্ডলের মার্জিন রয়েছে। মুখ্যদিকে রয়েছে ব্রাহ্মী হরফে ‘হরিকেল’ লিপি। ক্ষুদ্র মুদ্রাগুলিতে শুধু ‘হরি’ লিখিত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ের বেশ কিছু মুদ্রায় পরিষ্কারভাবেই ‘হরিকেল’ লিখিত। আবার কখনও ‘বেরক’ (মতান্তরে ‘হরিকে’) লিখিত হয়েছে।

মুদ্রায় ব্যবহূত ওই লিপি বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্নভাবে পাঠ করেন যেমন ‘য়ারিকৃয়্য, হরিকোট, পটিকের‌্য, পরিকের, পট্টিকেড়’ ইত্যাদি। ওই সমস্ত পাঠ বাতিল করে প্রফেসর ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আরাকানরাজ আনন্দচন্দ্রের আরাকানের ম্রোহাউঙ্গে অবস্থিত শিটাহুং প্যাগোডার স্তম্ভলিপির তুলনামূলক পাঠের সাহায্যে সর্বপ্রথম ‘হরিকেল’ নামটি প্রকাশ করেন।

বাংলার পাল ও সেন রাজাদের কোন মুদ্রা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। হরিকেল মুদ্রাগুলি আরাকানের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক যোগাযোগ নির্দেশ করে। হরিকেলের বণিকেরা শ্যামদেশের নানচাও (ইউনান) এবং ব্রহ্মদেশের শান প্রদেশের বডউইন খনিতে উৎখনিত রূপা আমদানি করতেন। পরে সেগুলি আবার উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করতেন। ময়নামতীর উৎখননে প্রাপ্ত সোনার মুদ্রাগুলি থেকে জানা যায় এই অঞ্চলে প্রচলিত মুদ্রা  শশাঙ্ক ও অন্যান্য গুপ্ত পরবর্তী উচ্চখাদ যুক্ত সোনার মুদ্রার অনুকরণে নির্মিত হয়েছিল। অপরপক্ষে হরিকেলের রৌপ্যমুদ্রাগুলি আরাকানে প্রচলিত মুদ্রার টাইপ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।  [প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়]