পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থা

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:০৯, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থা  বাংলাদেশে চালু হয়েছিল ব্রিটিশদের উদ্যোগে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত রীতি অনুসারে ১০ বছরের স্কুল পাঠক্রম শেষ করার পর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা বা এস.এস.সি নামে প্রথম পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হতো এদেশের শিক্ষার্থীদের। ২০০৯ সালে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষানীতির আওতায় ওই বছর থেকে পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণশেষে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নামে একটি নতুন পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হয়েছে। পরের বছর থেকে চালু হয়েছে ৮ বছরের নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষাশেষে অনুষ্ঠেয় জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা বা জে.এস.সি। বর্তমানে এ দুটি পরীক্ষাসহ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এস.এস.সি), দ্বাদশ ধাপ বা স্তর শেষ হওয়ার পর উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা (এইচ.এস.সি), ১৫ বছর পাঠক্রম সম্পন্ন করার পর স্নাতক (বি.এ, বি.এসসি, বি.এস.এস, বি.কম) এবং ১৭ বছর পাঠক্রম সম্পন্ন করার পর স্নাতকোত্তর পরীক্ষা (এম.এ, এম.এসসি, এম.এস.এস, এম.কম) পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে চালু রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা (বি.সি.এস) সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির পদ পূরণের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক পরীক্ষা।

ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক সরকার লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষা সমাপনের পর একটি প্রবেশিকা পরীক্ষা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। শুরুতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে এই পরীক্ষা পরিচালিত হতো। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, মাদ্রাজ (চেন্নাই) এবং বোম্বেতে (মুম্বাই) বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা (পরবর্তী সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষা নামে অভিহিত) পরিচালনার দায়িত্ব এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অর্পিত হয়। ম্যাট্রিক সার্টিফিকেট দুটি উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহূত হতো: প্রথমত, সরকারি চাকুরি প্রাপ্তি এবং দ্বিতীয়ত, কলেজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ।

একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯১৭ সালে একটি কমিশন গঠন করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা  স্যাডলার কমিশন নামে বহুল পরিচিত এই কমিশন ১৯১৯ সালে এর সুপারিশমালা প্রকাশ করে। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পরিচালনার জন্য একটি বোর্ড প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল উক্ত কমিশনের সুপারিশসমূহের মধ্যে অন্যতম।

স্যাডলার কমিশনের সুপারিশমালার ভিত্তিতে ১৯২১ সালে একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা শহরের সকল কলেজকে উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে রূপান্তর করা হয় এবং এসব কলেজসহ মাধ্যমিক ইংরেজি বিদ্যালয়সমূহ ঢাকা বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তৎকালীন বাংলা ও আসাম প্রদেশের ইসলামি শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত সকল ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট এবং ম্যাট্রিক স্তরের পরীক্ষা একটি অ্যাডভাইজারি বোর্ডের মাধ্যমে জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) কর্তৃক পরিচালিত হতো।

ভারত বিভাগ এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বিলুপ্ত করে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। এই বোর্ডের অধীনে পূর্ববঙ্গের মাধ্যমিক শিক্ষা ন্যস্ত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর অর্পণ করা হয় উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাসহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব। ১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড।

১৯৬১ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পাকিস্তানের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে পুনরায় বোর্ডসমূহের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ব্যবস্থা অনুযায়ী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় ঢাকা বোর্ডের ওপর। পরে এর নাম আবার পরিবর্তিত হয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড নামে অভিহিত হয়।

পরবর্তী সময়ে স্কুল ও ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন বোর্ড স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালে ঢাকার বাইরে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনায় তিনটি মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বোর্ডসমূহ রাজশাহী, কুমিল্লা ও যশোরে অবস্থিত। ১৯৯৪ সালে চট্টগ্রামে আরেকটি বোর্ড স্থাপিত হয়। বাংলাদেশের নবগঠিত সিলেট ও বরিশাল বিভাগে আরও দুটি বোর্ড প্রতিষ্ঠার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডসমূহ তাদের এখতিয়ারভুক্ত এলাকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষা নামে একটি ধর্মীয় শিক্ষার ধারা বিদ্যমান। এই ধারায় এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষার সমমানের পাবলিক পরীক্ষা যথাক্রমে দাখিল ও আলিম নামে অভিহিত। অনুরূপভাবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার নাম যথাক্রমে ফাজিল ও কামিল। মাদ্রাসা শিক্ষার এই পরীক্ষাসমূহ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড নামে একটি স্বতন্ত্র বোর্ড-এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষার ক্ষেত্রে কয়েক প্রকার ডিগ্রি, ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্স প্রদান করা হয়। স্নাতক পর্যায়ের টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষার পাবলিক পরীক্ষাসমূহ হলো বি.এসসি (টেক্সটাইল টেকনোলজি), বি.এসসি (লেদার টেকনোলজি) এবং বি.এসসি (টেকনিক্যাল)। এসব পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত হয় ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট পর্যায়ের পরীক্ষাসমূহ। কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও কাজ শুরু করে ১৯৬৯ সাল থেকে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে এই বোর্ডসমূহ স্বায়ত্তশাসিত।

স্নাতক ও উচ্চস্তরের পরীক্ষাসমূহ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। ১৯৯১ সালের পূর্বে দেশের সকল স্নাতক কলেজ ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমের অধীন ছিল। কলেজে পাঠরত সকল শিক্ষার্থীর স্নাতক ও উচ্চ পর্যায়ের পরীক্ষাসমূহ পরিচালনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষে একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং টেকনিক্যাল কলেজ ব্যতীত দেশের সকল স্নাতক কলেজকে এর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় যাতে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে অধিক সচেষ্ট ও যত্নশীল হয়, সে উদ্দেশ্যেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পাবলিক পরীক্ষার পরিবর্তে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ভিত্তিতে ডিগ্রি বা সনদ প্রদান করে থাকে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কলেজসমূহে পাঠরত শিক্ষার্থীদের স্নাতক ও উচ্চস্তরের পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত।

২০০১ সালের আগে পাবলিক পরীক্ষাসমূহের ফলাফল পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে গৃহীত স্কোরের মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। সাধারণত একজন পরীক্ষার্থী গড়ে ৩৬% নম্বর পেলে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বলে গণ্য করা হতো। একজন পরীক্ষার্থী ৩৬% থেকে ৪৫%-এর কম নম্বর পেলে তৃতীয় বিভাগ, ৪৫% থেকে ৬০%-এর নিচে পর্যন্ত নম্বর পেলে দ্বিতীয় বিভাগ এবং ৬০% বা তদূর্ধ্ব নম্বর পেলে প্রথম বিভাগ প্রাপ্তির সনদ প্রদান করা হতো। ৭৫% বা তদূর্ধ্ব নম্বরপ্রাপ্ত পরীক্ষার্থীদের স্টার মার্কস (তারকা চিহ্নিত মার্কস) প্রাপ্ত বলে গণ্য করা হতো এবং মার্কস স্কোরিং বা প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে একটি মেধা তালিকা প্রস্ত্তত করা হতো। ২০০১ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে এবং ২০০৩ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। বর্তমানে এ পরীক্ষায় ৮০ শতাংশ বা তদুর্ধ্ব নম্বর পেলে জিপিএ-৫, ৭০ থেকে ৭৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৪, ৬০ থেকে ৬৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৩.৫, ৫০ থেকে ৫৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-৩, ৪০ থেকে ৪৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-২ এবং ৩৩ থেকে ৩৯ শতাংশ নম্বর পেলে জিপিএ-১ প্রাপ্তির সনদ দেওয়া হয়। পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়ে থাকে।

দেশে প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা ব্যবস্থায় কেবল মুখস্থ করার মাধ্যমে ভাল ফল লাভের প্রবণতা দেখা যায় এবং এতে শিক্ষার্থীর প্রকৃত মেধার প্রতিফলন ঘটে না। সে কারণে সম্প্রতি এসএসসি পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু করা হয়েছে।  [শামসুদ্দোহা]