রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প (Rooppur Nuclear Power Plant Project)  ক্রমবর্ধমান বৈদ্যুতিক চাহিদা, দেশজ জ্বালানির অপ্রতুলতা, জ্বালানি সরবরাহের নিরাপত্তা, পরিবেশের ভারসাম্যতা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে দেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সুষম, আর্থিকভাবে লাভজনক ও কারিগরি দিক থেকে গ্রহণযোগ্য পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে গৃহীত প্রকল্প। স্বাধীনতা পূর্বকালে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন কোম্পানি প্রকল্পটির উপযোগিতা নিয়ে বেশকিছু সমীক্ষাকার্য পরিচালনা করে। এ সকল কোম্পানি প্রকল্পের কারিগরি ও আর্থিক দিক বিবেচনার পর পাবনার রূপপুরে প্রকল্পের স্থান নির্বাচন করে। এ লক্ষ্যে ১৬২.১৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্থ জনগণকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এবং নিকটবর্তী এলাকায় পুনর্বাসিত করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল এর নির্বাহী কমিটি বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পের বিভিন্ন আকার নির্ধারণ করে- ১৯৬৩ সালে ৭০ মেগাওয়াট, ১৯৬৬ সালে ১৪০ মেগাওয়াট এবং ১৯৬৯ সালে ২০০ মেগাওয়াট নির্ধারিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইডেন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বেলজিয়ামের পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহকারীরা বিভিন্ন আকৃতি ও ধরনের পারমাণবিক চzুল্ল সরবরাহের প্রস্তাবনা পেশ করে। কয়েকটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক অর্থ সাহায্য প্রদানেরও প্রস্তাব করে। একটি ৭০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন চুল্লির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থান করার প্রতিশ্রুতি দেয়ার কিছুকাল পর ইউএসএইড অকস্মাৎ ১৯৬৩ সালে চলে যায়। কানাডীয় কর্তৃপক্ষ প্রথম পর্যায়ে রূপপুরে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করলেও ১৯৬৫ সালে তারা করাচিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। ১৯৬৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইডেন যৌথ উদ্যোগে ঋণ সুবিধা প্রদানসহ ১৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক চzুল্ল স্থাপনের প্রস্তাব দিলেও তাদের প্রদত্ত শর্তাবলী তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পছন্দ না হওয়ায় এই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।

১৯৬৮ সালে একটি সোভিয়েত কোম্পানি ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি চুল্লি স্থাপনের সম্ভাব্যতা রিপোর্টসহ প্রকল্প সুপারিশ পেশ করে। চুল্লি স্থাপন সম্পন্ন করার সময়সীমা নির্ণয় করা হয় ১০ বছর। সাবেক সোভিয়েত সরকার এই প্রকল্পের জন্য কারিগরি ও অর্থ সহায়তা দিতেও রাজি হয়। প্রায় একই সময়ে ১৯৬৯ সালে বেলজিয়াম থেকেও ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের একটি প্রস্তাব আসে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসময় প্রয়োজন হওয়ার কারণে সরকার দ্বিতীয় প্রস্তাবটিকে গুরুত্ব দেয়। একটি সুইস কনসালটিং ফার্ম দ্বিতীয় প্রস্তাবের সম্ভাব্যতা জরিপ সম্পন্ন করে এবং অনুকূল মতামত প্রদান করে। বেলজিয়ামের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সমন্বয়ে গঠিত একটি কনসোর্টিয়াম স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিতে রাজী হয়। এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পাদনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু দেশে তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই চুক্তি সম্পাদিত হতে পারে নি। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বেলজিয়াম থেকে পাওয়া প্রস্তাবটি পুনর্জাগরিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, কিন্তু সেসময় দেশে ব্যাপক পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন কর্মকান্ড পরিচালনার প্রয়োজন হওয়ায় তৎকালীন সরকার পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অন্যান্য প্রকল্পে স্থানান্তর করার তাগিদ অনুভব করেন। একই কারণে সরকার ১৯৭৩ সালে কানাডা সরকারের নবায়নকৃত প্রস্তাবটিতেও কোন সাড়া প্রদান করেন নি। ১৯৭৭ সালে একটি ফরাসি কনসাল্টিং প্রতিষ্ঠান পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা নিয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করে। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে এই সমীক্ষাকার্যে অর্থের যোগান দেয়। এই সমীক্ষা থেকে রূপপুরে ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের পক্ষে মত দেওয়া হয়।

একটি ফরাসি পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কনসোর্টিয়াম সহযোগীদের সমন্বয়ে ১৯৭৮ সালে ১২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প প্রস্তাবনা পেশ করে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একদল বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলি এই প্রস্তাবনা মূল্যায়ন করে এটিকে বাস্তবায়নের উপযোগী বলে রিপোর্ট প্রদান করে। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থাও এই রিপোর্টের ওপর তাদের অনুকূল মতামত প্রদান করে। এ লক্ষ্যে সকল প্রকার আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পের অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পরবর্তীতে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে প্রচেষ্টা অব্যহত রাখা হয়। এই প্রচেষ্টার ফল হিসেবে ১৯৮৬ সালে জার্মানী থেকে যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই লক্ষ্যে সমীক্ষাকার্যও সম্পন্ন হয়, কিন্তু এক্ষেত্রেও বৈদেশিক অর্থ সহায়তার সংস্থান না হওয়ায় প্রস্তাবটি তিমিরেই থেকে যায়। ইতোমধ্যে সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণকে অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের বেসরকারিকরণ নীতির ফলে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পরমাণু শক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে পাবনার রূপপুরে ২০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পটির ব্যয়ভার নির্ধরিত হয়েছে ১.৫ থেকে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সম্ভাব্য সময়কাল ২০১৭-১৮। দেশের বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যেই প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় দেশের এই সর্বপ্রথম পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বিদ্যুতের ঘাটতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।  [এম.এ কাইউম]