ভাওয়াল মামলা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:০২, ১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

ভাওয়াল মামলা সারা বাংলাদেশে তথা ভারতব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ও বিশ শতকের প্রচার মাধ্যমে অন্যতম আলোচিত ঘটনা। এটি পূর্ববঙ্গে বিস্তৃত ভাওয়াল জমিদারির তিন অংশীদারের অন্যতম অংশীদার কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের অভূতপূর্ব মামলা।

বিস্তৃতি, আয় ও মর্যাদার দিক থেকে ভাওয়াল এস্টেট ছিল পূর্ববঙ্গের একটি বৃহৎ ও প্রাচীন জমিদারি। সতের শতকের শেষদিক থেকে এই এস্টেটের উদ্ভব। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ গোত্রভুক্ত এই রাজপরিবার ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় ও রাজা খেতাব লাভ করে। রাজ্যের মূল কেন্দ্র জয়দেবপুর এবং এখানেই জমিদারির কাচারি বা রাজবাড়ি অবস্থিত। কালীনারায়ণের পর এস্টেটের গদি লাভ করেন তাঁর একমাত্র ছেলে রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়। রাজেন্দ্র তিন সন্তান রেখে অল্প বয়সে মারা যান। এদের মধ্যে আবার দুজন কম বয়সে মারা যায়। ভাওয়ালের বিখ্যাত মামলার ঘটনাটি যখন ঘটে তখনও দ্বিতীয় পুত্র রমেন্দ্রনারায়ণ রায় (জন্ম ২৮ জুলাই ১৮৮৪) জমিদারির ব্যবস্থাপনা হাতে নেন নি।

১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসের শেষদিকে স্ত্রী বিভাবতী দেবী ও শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জমিদার মহলের এক বহর ভৃত্যসহ রমেন্দ্রনারায়ণ স্বাস্থ্য উদ্ধারের লক্ষ্যে বায়ু পরিবর্তনে দার্জিলিং যান। একদিন ভাওয়ালের লোকজন জানল যে, রমেন্দ্রনারায়ণ দার্জিলিংয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন; সেখানে তাঁকে যথারীতি দাহ করা হয়েছে এবং তাঁর স্ত্রী ও অন্যান্যরা তাঁর মৃত্যুতে শেষকৃত্য করার জন্য ঘরে ফিরে এসেছেন। কিন্তু ১৯২০ সালে রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ সন্ন্যাসীবেশে ঢাকায় পুনরাবির্ভূত হন। অনেকে তাঁকে শনাক্ত করলেও রাজা নিজের থেকে আপন পরিচয় দেন নি। তিনি একথাও বলেননি যে, তিনি ভাওয়াল রাজ্যের তিন অংশীদারের একজন। যারা তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন তারা ১৯২২ সালে তাঁকে ভাওয়ালে নিয়ে আসে এবং তখনই তিনি আত্মপরিচয় ঘোষণা করেন। পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে রাজবাড়ির প্রতিটি জিনিসের সঙ্গে তিনি কতখানি পরিচিত এটি প্রমাণের জন্য তিনি বেশ কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রদর্শন করেন।

কিন্তু রমেন্দ্রনারায়ণের পরিবার তাঁকে প্রকৃত রমেন্দ্রনারায়ণ রূপে মেনে নিতে অস্বীকার করে। তাদের দাবি, রমেন্দ্র ১৯০৯ সালে দার্জিলিংয়ে মারা গেছেন। এদিকে রাজা নিজে তাঁর পরিচয়ের ব্যাপারে কোন রকম তৎপরতা না দেখানোতে যারা তাঁকে রাজবাড়িতে নিয়ে এসেছিল তারা রমেন্দ্রের সত্যিকারের পরিচয় প্রতিষ্ঠায় প্রথমে অসুবিধায় পড়ে। তবে একটি সুবিধা ছিল এই যে, তিনি রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন জিনিস চিনতে পারেন এবং সেসবের বৃত্তান্ত তাঁর জানা আছে বলে দাবি করেন।

শেষপর্যন্ত সন্ন্যাসী বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে বলেন যে, তিনি ভাওয়াল রাজ্যের এক তৃতীয়াংশের মালিক। কিন্তু তাঁর পরিবার সঙ্গে সঙ্গে এই দাবি নাকচ করে দেয় এবং সন্ন্যাসীবেশী রমেন্দ্রকে একজন বিপজ্জনক মিথ্যা দাবিদার হিসেবে গণ্য করে। রাজপরিবার এই ভন্ড নাগা সন্না্যাসীর হাত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য সরকারের নিকট অনুরোধ জানায়। রমেন্দ্রের কলকাতা নিবাসী স্ত্রী সন্ন্যাসীকে তাঁর স্বামী হিসেবে মেনে নিতে বার বার অস্বীকৃতি জানান।

আপসে সমস্যা সমাধানের সকল প্রয়াস ব্যর্থ হলে রমেন্দ্রনারায়ণ ১৯৩৫ সালে ঢাকা জজকোর্টে একটি উত্তরাধিকার মামলা দায়ের করেন। পান্নালাল বসুর কোর্টে তাঁর মামলা পরিচালনার জন্য ব্যারিস্টার বি.সি চ্যাটার্জিকে নিয়োগ করা হয়। কোর্টে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেওয়ার জন্য বহুসংখ্যক দেশি ও ইউরোপীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তালিকাবদ্ধ করা হয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ সাক্ষ্যে শনাক্ত করেন যে, সন্ন্যাসী আসলেই রমেন্দ্রনারায়ণ। কোর্টে রমেন্দ্রনারায়ণ দাবি করেন যে, তিনি তাঁর শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ষড়যন্ত্রের শিকার। সত্যেন্দ্রনাথ এক বেকার স্নাতক সে তার সন্তানহীনা বোনের সমর্থনে রমেন্দ্রের জমিদারি অংশ নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করে। রাজা আরও দাবি করেন যে, সত্যেন্দ্রনাথের ষড়যন্ত্র পরিকল্পনায় সহযোগী ছিলেন পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাশগুপ্ত। রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ ছিলেন সিফিলিসের রোগী। রোগমুক্তির কথা বলে তারা তাঁকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে দার্জিলিংয়ে নিয়ে যায় এবং দার্জিলিংয়ের নতুন শ্মশানের কাছে স্টেপ এসাইড নামের একটি গেস্ট হাউজে তাঁর আবাসের ব্যবস্থা করে। রাজা জানালেন যে, ওরা তাঁকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল এবং রাতের অন্ধকারে তাঁকে দ্রুত দাহ করতে চেয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে ঐ এলাকায় হঠাৎ শিলাঝড় শুরু হলে যেসব ভাড়া করা ডোম রাজাকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিল তারা তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায়।

ঐ সময় একদল নাগা সন্ন্যাসী শ্মশানের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তারা রাজাকে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। সন্ন্যাসীরা তাদের ডেরায় রাজাকে বহন করে নিয়ে যায় এবং সেবাশুশ্রূষা করে। সেবায় রাজা আরোগ্য লাভ করেন বটে, কিন্তু স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তিনি ১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ জীবনযাপন করেন। ১৯২০ সালে যখন ওদের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছেন তখন আকস্মিকভাবে তিনি লুপ্ত স্মৃতি ফিরে পান। তখন থেকে তিনি তাঁর ভবঘুরে জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে মনস্থ করেন এবং সদরঘাটের বাকল্যান্ড বাঁধএর ধারে সন্ন্যাসীবেশে অবস্থান করতে থাকেন। স্মৃতিভ্রংশতা থেকে মুক্ত হওয়ার পর ভাওয়ালে ফিরে গিয়ে জমিদারির দাবিদার হওয়ার কোন বাসনা তাঁর ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতিই তাঁকে তাঁর পরিচয় ঘোষণা করতে এবং ১৯৩৫ সালে উত্তাধিকার মামলা রুজু করতে বাধ্য করে।

রমেন্দ্রনারায়ণের অনুকুলে আদালতে বেশ কিছু আলামত পেশ করা হয়, যার মধ্যে ছিল নানা ছবি, চিত্র, শারীরিক চিহ্ন, পরিচিতদের চিঠিপত্র ও বিবৃতি ইত্যাদি। এসব সাক্ষ্যের প্রায় সবগুলিই প্রমাণ করে যে, সন্ন্যাসী প্রকৃতপক্ষে রমেন্দ্রনারায়ণ রায়। বিজ্ঞ বিচারক পরিশেষে ১৯৩৭ সালের ২২ ডিসেম্বর তাঁর রায় প্রদান করেন যে, এই সন্ন্যাসীই ভাওয়াল রাজের সহ-অংশীদার কুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী বিভাবতী ঐ রায় না মেনে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। কলকাতা হাইকোর্ট জেলা জজের রায় বহাল রাখে। বাদী প্রিভি কাউন্সিলে মামলাটি স্থানান্তরের জন্য আবেদন করে, কিন্তু হাইকোর্ট এই আবেদন নাকচ করে দেয়।

ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলাটি এতই উত্তেজনাপূর্ণ ছিল যে, মামলা যতই গড়াতে থাকে ততই দেশের সকল পত্র-পত্রিকায় নানা মনগড়া মন্তব্য ও রসালো কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে। অধিকন্তু, জনতার কৌতূহল মেটাতে অসংখ্য প্রচারপত্র, বিজ্ঞপ্তি ও কাহিনী ছাপা হতে থাকে। ১৯৩৭ সালে এই মামলার নিষ্পত্তি পর্যন্ত এবং পরেও ভাওয়াল সন্ন্যাসী বহুবছর ধরে গীত, গাথা, নাটক, থিয়েটার, যাত্রা ও সিনেমার উপজীব্যে পর্যবসিত হয়। [সিরাজুল ইসলাম]