উন্নয়ন প্রশাসন

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:৪৪, ২ জুলাই ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

উন্নয়ন প্রশাসন  কাঙ্খিত আর্থসামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে উন্নয়নমূলক নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়ন এবং দক্ষ জনবল কর্তৃক এর বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনা। উন্নয়ন প্রশাসন উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রশাসন কাঠামো ও সংগঠন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি এবং বর্তমান প্রশাসনিক যন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করাও উন্নয়ন প্রশাসনের কাজ। এরূপ প্রশাসনিক সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে  স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ এবং এতে জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের সঙ্গে উন্নয়ন প্রশাসন সম্পৃক্ত। উন্নয়ন প্রশাসন বলতে নীতি প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপকভাবে দায়ী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দক্ষতার উন্নয়নকেও বোঝায়। বাংলাদেশে আর্থ-রাজনৈতিক কারণে উন্নয়ন প্রশাসন বলতে সরকারি খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বোঝায়। সরকারি খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন অব্যাহত সংস্কার প্রক্রিয়া। সংস্কার দু’টি কারণে প্রয়োজন। প্রথমত প্রশাসনকে কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক করার জন্য যেসব অন্তরায় রয়েছে সেগুলির প্রতিবিধান এবং দ্বিতীয়ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা দেশগুলির আরোপিত বাধ্যবাধকতার মোকাবেলা করা।

উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন  বাংলাদেশ প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) গ্রহণ করে ১৯৭৩ সালে। পরবর্তী পরিকল্পনা ছিল দু’বছর মেয়াদী (১৯৭৮-১৯৮০)। ১৯৮০ সাল থেকে পর পর দু’টি পাঁচসালা পরিকল্পনা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হয় (১৯৮০-৮৫, ১৯৮৫-৯০)। চতুর্থ পাঁচসালা পরিকল্পনার মেয়াদ ছিল ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত। ১৯৯৫ সাল থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে দু’বছরের জন্য কোনো পরিকল্পনা প্রণীত হয় নি। ১৯৯৭ সালের জুলাই থেকে পরবর্তী পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।

প্রথম পাঁচসালা ও দ্বিতীয় দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনা ব্যতীত সকল পরিকল্পনার উদ্দেশ্য কম বেশি একই রকমের ছিল। প্রথম পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ত্রাণ সাহায্য প্রদান ও পুনর্গঠন করা। দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল প্রথম পাঁচসালার অন্তর্ভুক্ত অসমাপ্ত প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির জন্য খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয় এমন প্রকল্পগুলির বাস্তবায়ন পরিহার। দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল পল্লী উন্নয়ন। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম পাঁচসালা পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

সকল পরিকল্পনার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল শতকরা ৫ ভাগের উপরে। দেশের অর্ধেক লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থান করায় বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক প্রবাহ সত্ত্বেও বাংলাদেশ নিম্ন প্রবৃদ্ধি কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

সারণি  পরিকল্পিত উন্নয়নের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র।

পরিকল্পনা  পরিকল্পনার অর্থের পরিমাণ (মিলিয়ন টাকায়) প্রকৃত ব্যয় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হার %
লক্ষ্যমাত্রা প্রকৃত
প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) ৪৪,৫৫০ ২০,৭৪০ ৫.৫ ৪.০০
দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৮-৮০) ৩৮,৬১০ ৩৩,৫৯০ ৫.৬ ৩.৫
দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৮০-৮৫) ১৭২,০০০ ১৫২,৯৭০ ৫.৪ ৩.৮
তৃতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০) ৩৮৬,০০০ ২৭০,১১০ ৫.৪ ৪.১৫
চতুর্থ পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৯০-৯৫)   ৬২০,০০০ ... ৫.০ ...
পঞ্চম পাঁচসালা পরিকল্পনা (১৯৯৭-০২)  ১৯৫৯,৫২১ ... ৭.০ ...

সূত্র Govt of Bangladesh, The Fifth Five Year Plan (1997-2002), p. 45।

সরকারের আকার ও পুনর্গঠন প্রচেষ্টা  সরকার কাঠামোর পরিধি বেড়েই চলছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশাসনিক সংস্থার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মন্ত্রণালয় ৩৫, প্রশাসনিক বিভাগ ৫০, পরিদপ্তর ২২১, অধিদপ্তর ১৩৯ এবং ১৫৩টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। এসব সংস্থায় কর্মরত ব্যক্তির মোট সংখ্যা ১০ লাখ।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধা-সরকারি কর্পোরেশন ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। পাকিস্তান আমলে এ প্রশাসনিক কাঠামোর উৎপত্তি হয় এবং তা খুব সীমিত ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সাল থেকে সংস্থার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭২ সাল থেকে এসব সংস্থায় লোকসান হতে থাকে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা বর্তমানে প্রতি বছর লোকসান দিচ্ছে ২৫০০ কোটি টাকা এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট লোকসান হয়েছে ৪৫,০০০ কোটি টাকা। বার্ষিক লোকসানের পরিমাণ হচ্ছে মোট জিডিপির শতকরা ২ ভাগ। সরকার আশির দশক থেকে বেসরকারি খাতে পুঁজি প্রত্যাহার করার নীতি অনুসরণ করেছে। কিন্তু এগুলির মালিকানা গ্রহণের জন্য বেসরকারি খাত থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিনিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য সরকার ১৯৯৩ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ বোর্ড গঠন করে। কিন্তু এ বোর্ড তার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে আছে। এ অবস্থা পর্যালোচনা করে সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রশাসনের নিম্ন, মধ্য ও ঊর্ধ্বতন স্তরে প্রয়োজনাতিরিক্ত যে জনবল কর্মরত রয়েছে তা শুধু সরকারি অর্থের উপর চাপ সৃষ্টিই করছে না, প্রশাসনকে অদক্ষ ও অকার্যকরও করে তুলছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকার ‘গোল্ডেন হ্যান্ডসেক’ বা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে চাকুরি থেকে অবসর প্রদান নীতি গ্রহণ করলেও তা খুব একটা সুফল বয়ে আনতে পারে নি।

বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের অংশগ্রহণ  ১৯৮৩ সালে প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটির সুপারিশ অনুসারে প্রশাসনকে উপজেলায় বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় উপজেলা প্রশাসন সৃষ্টি ও তা শক্তিশালী হয়। উপজেলা প্রশাসনে একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যানের বিধান রাখা হয় এবং জাতীয় আমলাতন্ত্রকে চেয়ারম্যানের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর উপজেলা ব্যবস্থা রহিত করা হয়।

পল্লী উন্নয়ন  দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রথম বছরে এবং প্রাক-পরিকল্পনা সময়েও পল্লী উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক মডেল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়। এগুলির মধ্যে ছিল কাজের বিনিময়ে খাদ্য, স্বনির্ভর বাংলাদেশের বিভিন্ন মডেল, স্বনির্ভর ঋণ কর্মসূচি, খাল খনন, আইআরডিপি-এর অধীনে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট সমবায়। এ আইআরডিপি বর্তমানে বিআরডিবি-তে রূপান্তরিত হয়েছে। এ কর্মসূচির মধ্যে বেশ কিছুর বিলুপ্তি ঘটেছে এবং অন্যান্য কর্মসূচি গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারে নি। বিআরডিবি সরকারি খাতে দারিদ্র্য নিরসন প্রকল্পে একটি বৃহত্তর সংস্থা এবং তা অনেক প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কিন্তু এর উন্নয়নের হার ব্যয়িত অর্থের তুলনায় খুবই সীমিত।

স্থানীয় সরকার ও জনগণের অংশগ্রহণ  উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ হলেও এটি জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে নি। অধিকন্তু স্থানীয় সরকারের নিম্নতম স্তর ইউনিয়ন পরিষদের সম্পদ বিতরণের জন্য এটিকে উপজেলা পরিষদের একটি অধীনস্থ সংস্থায় পরিণত করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের রাজস্ব খাত হ্রাস করার ফলে এ পরিষদ কর্মোদ্যোগ ও গতিশীলতা হারিয়ে ফেলে। নববইয়ের দশকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত দুটি সরকারই স্থানীয় সরকার সম্পর্কে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পালনে যথেষ্ট উৎসাহ দেখিয়েছে।

১৯৯২ সালে সরকার স্থানীয় সরকার সম্পর্কে একটি কমিশন গঠন করে। এ কমিশন ‘হুদা কমিশন’ নামে খ্যাত। এ কমিশন স্থানীয় সরকারের জন্য দুটি স্তর সুপারিশ করে, যদিও প্রতিবেদনে পরোক্ষভাবে চারটি স্তরের কথাই বলা হয়েছে। এ প্রতিবেদনে অনেক কাঠামোগত অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হয় যা কতকাংশে কেবিনেট সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দূর করা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেদনে গৃহীত প্রস্তাবগুলি বাস্তবায়নের পূর্বেই ১৯৯৬ সালের জুন মাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ সরকারও স্থানীয় সরকারের উপর একটি কমিশন গঠন করে এবং এ কমিশন ‘রহমত আলী কমিশন’ নামে পরিচিত। কমিশন স্থানীয় সরকারের চারটি স্তর সুপারিশ করে। এদের মধ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন বলে ইউনিয়ন পরিষদ আগে থেকেই কাজ করে আসছে। অপর স্তরগুলি এখনো চালু করা হয় নি।

সরকারি খাতে সংস্কার ও প্রশাসন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সরকার এ পর্যন্ত ১৯টি সংস্কার কমিটি নিয়োগ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে সত্তরের দশকে ৩টি, আশির দশকে ১০টি এবং নববইয়ের দশকে ৬টি। এগুলির মধ্যে ৪টি কমিটি ছিল বেতন কাঠামো এবং বাকিগুলি চাকুরি ও প্রশাসনিক কাঠামো ন্যায়ভিত্তিক করা সম্পর্কিত। সরকার ১৯৯৭ সালে লোক প্রশাসন সংস্কার কমিটি গঠন করে। কিন্তু আর্থিক ও প্রশাসনিক সাহায্য ও সমর্থন না পাওয়ার কারণে কমিটির পরপর নিয়োগপ্রাপ্ত সাবেক বেসামরিক কর্মকর্তা দুজন চেয়ারম্যানই এ পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

প্রশাসনিক উন্নয়ন  সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং বিভিন্ন খাতের সমষ্টিক পর্যায় থেকে ব্যষ্টিক পর্যায়ে উন্নয়নমূলক কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আমলাদের দক্ষতা বৃদ্ধি একটি জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানব সম্পদ উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অভিপ্রায়ে সরকার ক্যাডার সার্ভিস, নন-ক্যাডার সার্ভিস এবং কারিগরি সার্ভিসের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। চতুর্থ পাঁচসালা পরিকল্পনায় বিদ্যমান বিসিএস (প্রশাসন) একাডেমী ও নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিকে সুদৃঢ় করা এবং প্রশিক্ষণের চাহিদা মেটানোর উদ্দেশ্যে স্ট্যাটিস্টিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এবং ইলেক্টোরাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল।  [এম শামসুর রহমান]