পাঁচসনা বন্দোবস্ত

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:০৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পাঁচসনা বন্দোবস্ত (১৭৭২-১৭৭৭)  প্রচলিত জমিদার পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ খাজনা দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ  ইজারাদারদের সঙ্গে পাঁচ বছরকালীন খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা প্রবর্তনই পাঁচসনা বন্দোবস্ত। ওয়ারেন হেস্টিংস কর্তৃক ১৭৭২ সালে সম্পাদিত এ পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল, ভূমির খাজনা বৃদ্ধি ও তা যথাসময়ে আদায় করা। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সম্রাট শাহ আলম ও বাংলার নওয়াব নাজমুদ্দৌলার সঙ্গে যথাক্রমে ১২ আগস্ট ১৭৬৫ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ১৭৬৫-তে সম্পাদিত দুটি ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি লাভ করে। এ দুটি চুক্তির আওতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে রাজকীয় ফরমান এর মাধ্যমে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ান নিযুক্ত করা হয় এ শর্তে যে, কোম্পানি বাংলায় আদায়কৃত রাজস্ব হতে সম্রাটকে কর হিসেবে সুনির্দ্দিষ্ট ছাবিবশ লক্ষ টাকা এবং বাংলার নওয়াবকে তাঁর নিজামত (বেসামরিক প্রশাসন) চালাবার জন্য তিপ্পান্ন লক্ষ টাকা দেবে।

কোম্পানির দীউয়ানি দায়িত্ব গ্রহণের উদ্দেশ্য ছিল, এ রাজ্যের উদ্বৃত্ত রাজস্ব দ্বারা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় বাণিজ্যের ব্যয় সংকুলান করা। ব্যবসা বাণিজ্যে পূর্ণ মনোনিবেশের উদ্দেশ্যে কোম্পানি স্থানীয়ভাবে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দীউয়ানি প্রশাসন চালাতে সচেষ্ট ছিল। কিন্তু, দীউয়ানি প্রশাসনের পরোক্ষ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানির অভীষ্ট আয় আসছিল না। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস দীউয়ানি প্রশাসন সরাসরি হাতে তুলে নিলেন। তাঁর প্রশাসনের ধারণা জন্মেছিল যে, বিদেশি শাসকদের কাছে দেশের সম্পদ আড়াল করে রাখা হচ্ছে, এবং এরূপ বিশ্বাসভঙ্গতা প্রতিরোধের উপায় হলো প্রতিযোগিতামূলক ভূমি বন্দোবস্ত।

হেস্টিংস তাই তাঁর দুজন নায়েব দীউয়ান রেজা খান ও শিতাব রায়কে বরখাস্ত করে দীউয়ানির দায়িত্বভার নিজেই সরাসরি হাতে তুলে নেন। তিনি খালসা, অর্থাৎ রাজস্ব সদর দপ্তর মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় সরিয়ে আনেন, এবং দীউয়ানি পরিচালনার জন্য স্বয়ং সভাপতি থেকে একটি রাজস্ব কমিটি গঠন করেন। রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কর্ণধার হিসেবে হেস্টিংস ১৪ মে ১৭৭২ তারিখে তাঁর রাজস্ব প্রশাসনের রূপরেখা ঘোষণা করেন। তদনুযায়ী, কমিটি অব সার্কিট (এ কমিটির চেয়ারম্যান তিনি নিজেই ছিলেন) দেশের বিভিন্ন প্রদেশে সফর করে রাজস্ব আদায়কারীদের সঙ্গে ‘পাঁচসনা বন্দোবস্ত’ চূড়ান্ত করে। রাজস্ব আদায়কারীদের আদায়কৃত রাজস্বের শতকরা দশ ভাগ, রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব হতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পূর্বকার জমিদারদেরকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বার্ষিক ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। ইউরোপীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। এরা ‘জেলা কালেক্টর’ হিসেবে অভিহিত হন। কমিটি অব সার্কিট বন্দোবস্তের কাজ ১৭৭২ সালের মধ্যে শেষ করে।

পাঁচসনা বন্দোবস্তের কার্যকারিতা কালে দেখা যায় যে, বহুসংখ্যক কৃষক অনুমান ভিত্তিক অতিরিক্ত রাজস্ব ধার্যের কারণে রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হয়। এমনকি, তাদের মধ্যে অনেকেই গ্রেপ্তার হওয়া এবং আটক থাকার ভয়ে পালিয়ে যায়। অনেক পরগনায় নির্যাতিত রায়তগণ অত্যাচারী রাজস্ব আদায়কারীদেরকে প্রকাশ্যে বাধা দেয়। অধিকাংশ রাজস্ব আদায়কারীরই ভূম্যধিকারী হওয়ার এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু তাঁরা ধনী হওয়ার আশায় ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু ভূমিসম্বন্ধীয় কাজের বাস্তবতায় তাঁরা একেবারে হতাশ হয়ে পড়েন। বিভিন্ন ধরনের কঠোরতা ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাঁরা রাজস্ব আদায় খাতে বিনিয়োগকৃত মূলধন আহরণে সচেষ্ট হন। ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। গ্রামাঞ্চল শাসন করার জন্য নতুন ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গঠিত সকল প্রাদেশিক কাউন্সিল রাজস্ব আদায় ব্যবস্থার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠাল। ওয়ারেন হেস্টিংসকে তাঁর রাজস্ব নীতির জন্য কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। বস্ত্তত, তাঁর অভিশংসনের প্রধান কারণগুলির একটি ছিল তাঁর রাজস্ব নীতি। যাহোক, কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স কলকাতা সরকারকে ভবিষ্যতে রাজস্ব আদায়ে ইজারাদারি ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করার পরামর্শ দেয়। তদনুযায়ী, ১৭৭৭ সালে কুখ্যাত পাঁচসনা বন্দোবস্তের মেয়াদান্তে জমিদারদের সঙ্গে স্বল্প-মেয়াদি রাজস্ব বন্দোবস্ত করা হয়।  [সিরাজুল ইসলাম]