মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪০, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩)  নদীয়ার রাজা এবং কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর। কৃষ্ণনগরেই তাঁর জন্ম; পিতা রঘুরাম রায়। রক্ষণশীল এ হিন্দু রাজা বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সমান ব্যুৎপন্ন ছিলেন। সঙ্গীত ও অস্ত্রবিদ্যায়ও তিনি পারদর্শী ছিলেন।

কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন কূটকৌশলী ব্যক্তি। তাঁর শাসনকালে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেন। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাশিম তাঁকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ তিনি ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। তদুপরি ক্লাইভের নিকট থেকে উপঢৌকন হিসেবে পান পাঁচটি কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন।

কৃষ্ণচন্দ্র একজন বিশিষ্ট সাহিত্যপ্রেমিক ছিলেন। মধ্যযুগের অন্যতম বিখ্যাত কবি  ভারতচন্দ্র ছিলেন তাঁর সভাকবি। এ ছাড়া সাধককবি  রামপ্রসাদ সেন, পন্ডিত  বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্ত প্রমুখ তাঁর রাজসভা অলঙ্কৃত করেন। হাস্যরসিক  গোপাল ভাঁড় ছিলেন তাঁর দরবারের প্রখ্যাত বিদূষক।

কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারতচন্দ্র তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্য  অন্নদামঙ্গল রচনা করেন। কথিত আছে, দেবী অন্নপূর্ণার স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী তিনি ভারতচন্দ্রকে দিয়ে দেবীর মাহাত্ম্যসূচক এ কাব্য রচনা করান। কাব্যটি তিন খন্ডে বিভক্ত। তৃতীয় খন্ডের নাম মানসিংহ। এতে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের ইতিহাস,  মানসিংহ কর্তৃক প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার কাহিনী এবং অন্নদার মহিমা বর্ণিত হয়েছে।

নবদ্বীপসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতচর্চার ক্ষেত্রে কৃষ্ণচন্দ্রের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সংস্কৃতচর্চা বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন এবং এজন্য প্রচুর অর্থও ব্যয় করেন। নদীয়ার বাইরে সুদূর  বিক্রমপুর ও বাকলার পন্ডিতগণও তাঁর অর্থানুকূল্য ভোগ করতেন। তিনি নদীয়ায় অনেক টোল-চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন এবং সেগুলির ব্যয়ভার বহনের জন্য করমুক্ত ভূসম্পত্তি দান করে সংস্কৃতচর্চার পথ প্রশস্ত করেন। সংস্কৃত বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য নদীয়ায় আগত বিদেশী ছাত্রদের জন্য তিনি মাসে দু’শ টাকা মাসোহারা দেবারও ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী রানী ভবানীও সে যুগে বাংলাদেশে সংস্কৃতচর্চার পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তখন বাংলায় সঙ্গীতেরও যথেষ্ট বিকাশ ঘটেছিল। আঠারো শতকের প্রথম দিকে মুগল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলে মুগল দরবার, রাজপুরুষ ও দরবারঘনিষ্ঠ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আশ্রিত সঙ্গীতজ্ঞরা ভাগ্যান্বেষণে ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদেরই কয়েকজন কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় স্থানলাভ করেন। রামপ্রসাদ সেনকে তিনি প্রথমে মাসোহারা ও পরে জমি দান করে  শ্যামাসঙ্গীত চর্চায় সহায়তা করেন। ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে সেখানকার উচ্চ সাঙ্গীতিক পরিবেশের কথা জানা যায়।

কৃষ্ণচন্দ্র বহু জনহিতকর কাজও করেছেন। ১৭৬২ সালে  নদীয়া জেলার শিবনিবাসে তিনি একটি বৃহৎ শিবমন্দির নির্মাণ করেন এবং বাংলায় তিনিই প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। তাঁর উৎসাহ ও উদ্যোগে নাটোরের কয়েকজন বিখ্যাত মৃৎশিল্পী কৃষ্ণনগরে গিয়ে মৃৎশিল্পের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটান।  [সমবারু চন্দ্র মহন্ত]