অপভ্রংশ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৭:৪৯, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

অপভ্রংশ  মধ্যভারতীয় আর্যভাষা পালি-প্রাকৃতের শেষ স্তর। ‘অপশব্দ’ বা ‘অপভ্রষ্ট’ শব্দ থেকে এর নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। ‘অপভ্রংশ’ শব্দের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পতঞ্জলির মহাভাষ্যে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে রচিত এ গ্রন্থে পতঞ্জলি  সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত কিন্তু শিষ্ট ভাষায় অচল এমন শব্দ (অপশব্দ) বোঝাতে অপভ্রংশ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। উক্ত অর্থে এখন পালি-প্রাকৃত শব্দ ব্যবহূত হয়। পরবর্তীকালে পুরুষোত্তম প্রভৃতি প্রাকৃত বৈয়াকরণ অপভ্রংশের উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁরা অপভ্রংশকে প্রাকৃতের শেষ স্তর না বলে পৃথক ভাষা বলেছেন এবং এ ভাষার নিদর্শন হিসেবে প্রধানত উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথের উত্তরভাগে সংস্কৃতের সহযোগীরূপে প্রচলিত সাহিত্যিক নাগরক বা নাগর অপভ্রংশকে নির্দেশ করেছেন।

বর্তমানে অপভ্রংশ ভাষা সম্পর্কে যে মতবাদ প্রচলিত তা হচ্ছে, সকল  প্রাকৃত ভাষারই শেষস্তর অপভ্রংশ এবং সেসব থেকে বিভিন্ন নব্যভারতীয় আর্যভাষার উৎপত্তি হয়েছে। এ মতবাদ অনুযায়ী পূর্বভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভূত হয়েছিল এবং তা থেকে ভোজপুরী, মগহী ও মৈথিলী এ তিন বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও উড়িয়া এ তিন গৌড়ীয় ভাষার উদ্ভব ঘটেছে। আর পশ্চিমা শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে হিন্দি প্রভৃতি ভাষা। অপভ্রংশ ভাষার কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ১৭শ অব্দ পর্যন্ত। এ ভাষা নিম্নশ্রেণীর লোকদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।

অপভ্রংশ ভাষার সাহিত্যিক প্রয়োগের প্রথম নিদর্শন পাওয়া যায় ভরতের নাট্যশাস্ত্রে (আনু. খ্রিস্টপূর্বাব্দ-খ্রিস্টীয় ৩য় শতক)। এখানে অপভ্রংশে রচিত কতগুলি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। এ ছাড়া শ্বেতাম্বর জৈনদের আগমগ্রন্থ (আচা ২, ৪, ৫), পরবর্তীকালীন বৌদ্ধগ্রন্থ (লঙ্কাবতার, ললিতবিস্তর, মহাবস্ত্ত ইত্যাদি), বিমলসূরির (৩য় শতক) মহারাষ্ট্রী প্রাকৃতে লিখিত পউমচরিয়ম্ নামক গ্রন্থে অপভ্রংশ ভাষার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। কালিদাসের (৪র্থ শতক) বিক্রমোর্বশীয়ম্ নাটকের চতুর্থ অঙ্কের গানগুলিও অপভ্রংশে রচিত। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কালিদাসের সময়ে কিংবা তারও পূর্ব থেকেই অপভ্রংশ ভাষার বিকাশ ঘটেছিল।

ভামহ (৭ম শতক), দন্ডী (৮ম শতক) প্রমুখ আলঙ্কারিক অপভ্রংশ ভাষায় রচিত সাহিত্যকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। ভাষার দিক থেকে তাঁরা কাব্যকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করেছেন, যথা: সংস্কৃত, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ। অপভ্রংশে রচিত কাব্যের মান সংস্কৃত বা প্রাকৃত কাব্য থেকে কোনো অংশেই কম নয় এরূপ অভিমতও তাঁরা ব্যক্ত করেছেন। পরবর্তীকালে পুরুষোত্তম (১২শ শতক) অপভ্রংশকে শিষ্ট লোকের ভাষা বলেই অভিহিত করেছেন।

অপভ্রংশ ভাষার অধিকাংশ গ্রন্থই জৈনদের দ্বারা রচিত। তাঁরা বিভিন্ন চরিতকাব্য, নীতিকাব্য, কথানক কাব্য, এমনকি জৈনদর্শন পর্যন্ত অপভ্রংশ ভাষায় রচনা করেছেন। চরিতকাব্যের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন স্বয়ম্ভূদেবের (৭ম/৮ম শতক) পউমচরিউ। এতে ৫৬টি সন্ধি এবং ১২,০০০ শ্লোকে রামচন্দ্রের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিতকাব্য হলো: ধাহিলের (বা দাহিলের) পউমসিরিচরিউ (১০ম শতক), পুষ্পদন্তের (১০ম শতক) মহাপুরাণ, জসহরচরিউ ও নয়কুমারচরিউ, হরিভদ্রের নেমিণাহচরিউ (১১৫৯ খ্রি), পদ্মকীর্তির পার্শ্বপুরাণ (১৪শ শতক) ইত্যাদি। মহাভারতের কৃষ্ণ-বলরাম এবং কুরু-পান্ডবের কাহিনী অবলম্বনে রচিত আরেকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো ধবলকবির হরিবংশপুরাণ।

বিভিন্ন আখ্যায়িকা অবলম্বনে রচিত কাব্যের মধ্যে ধনপালের (১০ম শতক) ভবিস্সয়ত্তকহা একটি উৎকৃষ্ট রোম্যান্টিক কাব্য। ধার্মিকনায়ক সুদর্শনের কাহিনী অবলম্বনে নয়নন্দী (১০৪৪ খ্রি) সুদর্শনচরিত রচনা করে যশস্বী হন। সিংহসেন মেহেসরচরিউ (১৪৩৯ খ্রি) লিখে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তিনি ‘রৈধূ’ নামে পরিচিত ছিলেন এবং এ নামে তিনি দহলক্থণ-জয়মাল ও জীবন্ধরচরিত রচনা করেন। দ্বিতীয়টিকে অবলম্বন করে পরবর্তীকালে আরও অনেক অপভ্রংশ গ্রন্থ রচিত হয়েছে। কনকামর মুনি (১৬৬৫ খ্রি) কর্তৃক বিরচিত করকন্ডচরিউ কাব্যে জৈন সাধু করকন্ডের জীবনচরিত বিবৃত হয়েছে। করকন্ড জৈন ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের পূজনীয় ছিলেন। কথানক কাব্যের মধ্যে শ্রীচন্দ্রের (১০ম বা ১২শ শতক) কথাকোষ একটি উৎকৃষ্ট সংকলন গ্রন্থ। এতে ৫৩টি গল্প স্থান পেয়েছে। গল্পগুলি ঘটনার পারিপাট্যে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।

নীতিমূলক কাব্য রচনায়ও জৈনগণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। হেমচন্দ্রের সমসাময়িক ও জিনবল্লভ সূরির শিষ্য জিনদত্তসূরি (১০৭৫-১১৫৪ খ্রি) তিনখানি নীতিকাব্য লিখে যশস্বী হয়েছেন। তাঁর আচার্য জিনবল্লভ সূরির স্ত্ততিমূলক চ্চচরী একটি ক্ষুদ্র গীতিকাব্য। বহু উপদেশ ও তত্ত্বে পূর্ণ তাঁর আরও দুটি নীতিকাব্য হচ্ছে উপদেশরসায়নরাস ও কালস্বরূপকুলক। সুপ্রভাচার্যের বৈরাগ্যসারও (১৭৭১ খ্রি) একটি উল্লেখযোগ্য নীতিকাব্য।

দার্শনিক গ্রন্থ রচনায় প্রভূত পান্ডিত্য দেখিয়েছেন জৈনাচার্য জোইন্দু। কারও মতে তিনি খ্রিস্টীয় ৭ম শতকে জীবিত ছিলেন; আবার কারও কারও মতে তাঁর আবির্ভাবকাল ১০০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে নয়। তাঁর রচিত পরমাত্মপ্রকাশ, যোগসার, শ্রাবকাচারদোহক ও দোহাপাহুড় উল্লেখযোগ্য দার্শনিক গ্রন্থ। তিনি প্রায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন বলে কথিত হয়। দর্শনবিষয়ক আরও কিছু গ্রন্থ হলো: দেবসেনের সাবয়ধম্মদোহা (৮৯৪ খ্রি), রাজসিংহের পাহুড়দোহা (১০ম শতক), অভয়দেব সূরির জয়তিহুয়ণস্তোত্র প্রভৃতি।

জৈনদের এসব গ্রন্থ পশ্চিমী ও দক্ষিণী অপভ্রংশে রচিত। পূর্বী অপভ্রংশে যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেছেন তাঁরা ছিলেন প্রধানত বাঙালি বৌদ্ধ। তাঁদের মধ্যে  কাহ্নপা (৭ম শতক), সরহপা (১০ম শতক) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কাহ্নপা ও সরহপার দোহাকোষ সাধনসংকেতমূলক গ্রন্থ। এটি উপদেশাত্মক হলেও এতে প্রভূত কবিত্বশক্তির নিদর্শন আছে। ডাকার্ণবতন্ত্রও এ শ্রেণির গ্রন্থ। এঁরাই প্রথম কবিতায় অন্ত্যমিল বা অন্ত্যানুপ্রাসের প্রচলন করেন এবং এ থেকেই দেশিয় ভাষার ছন্দে মিলের উদ্ভব ঘটে। পিঙ্গলাচার্যের (আনু. ১৪শ শতক) প্রাকৃতপৈঙ্গল এবং প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির (১৫শ শতক) কীর্তিলতা পূর্বী অপভ্রংশের আরও দুটি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। প্রাকৃতপৈঙ্গলে মাত্রাবৃত্ত ও বর্ণবৃত্ত উভয় জাতীয় ছন্দেরই আলোচনা আছে। পিঙ্গল উদাহরণসহ যেসব ছন্দের আলোচনা করেছেন সে সবের মধ্যে মাত্রাবৃত্তে গাহা, বিগ্গাহা, উগ্গাহা, দোহা, রোলা, ছপ্পঅ, কববলক্খণ, দোঅই (দ্বিপদী) প্রভৃতি এবং বর্ণবৃত্তে পঞ্চাল, মন্দর, মালতী, মল্লিকা, রূপমালা, তোটক, চাসর, চ্চচরী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব ছন্দের উদাহরণ হিসেবে তিনি যে শ্লোকগুলি উদ্ধৃত করেছেন, সেগুলির সাহিত্যিক মূল্যও উল্লেখযোগ্য।  [শাশ্বতী হালদার]