প্রকৌশল

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:০৫, ১২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

প্রকৌশল (Engineering)  গণিত এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসমূহের জ্ঞানের সমন্বয়ে সৃষ্ট বিজ্ঞান। গবেষণা, অভিজ্ঞতা এবং চর্চা দ্বারা আহরিত এই জ্ঞান মানব জাতির উপকারার্থে প্রাকৃতিক শক্তি ও উপকরণাদির সদ্ব্যবহার তথা কার্যকরভাবে ব্যবহারের উদ্দেশে প্রয়োগ করা হয়। যথার্থভাবে প্রকৌশল বিদ্যা কম্পিউটার, নভোযান, লেজার এবং উপগ্রহ যোগাযোগ থেকে বাড়িঘর, সড়ক, পোতাশ্রয়, বর্জ্য নিষ্কাশন, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করণ ও মোড়কজাত করা এবং বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনপ্রণালী পর্যন্ত সমাজের প্রতিটি কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই প্রকৌশল বিদ্যারও সূত্রপাত ঘটে। কিছুক্ষেত্রে প্রকৌশল শাস্ত্রের ইতিহাস হলো ভৌত সীমাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে বস্ত্তর প্রকৃতি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতির ব্যবহারভিত্তিক প্রাকৃতিক পরিবেশের ইতিবাচক পরিবর্তন, বিকাশ এবং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানবতার প্রগতির ইতিহাস। প্রাচীন সভ্যতাসমূহের অনেকগুলোর ক্ষেত্রে সুসংগঠিত এবং জটিল প্রকৌশল কর্মের বিন্যাস অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। এ সকল সভ্যতায় দূর্গ, স্মৃতিসৌধ, সড়ক, জলপ্রণালীর পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ণ ও নির্মাণ, সেচ কার্যক্রম এবং অন্যান্য স্থাপনায় প্রয়োজনীয় কারিগরি দক্ষতার ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল, যার কিছু নিদর্শন বর্তমান সময়েও টিকে রয়েছে। আধুনিক প্রকৌশল পেশা মূলত অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে ইউরোপে সংঘটিত দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নের ফলাফল: শিল্প বিপ্লব এবং বিজ্ঞানের প্রতি দ্রুত প্রসারমান আস্থা। এ সময়ে সমস্ত পৃথিবী জুড়েই প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহ প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। বিংশ শতকেই শিক্ষার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিষয় হিসেবে প্রকৌশল বিদ্যা বিকশিত হতে শুরু করে এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিস্ফোরণ সদৃশ ব্যাপক প্রসারের ক্ষেত্রটি তৈরি হয়েছিল।

শিল্প বিপ্লব পর্যন্ত দুই ধরনের প্রকৌশলিদের অবস্থান পরিলক্ষিত হয়। সামরিক প্রকৌশলিগণ যুক্ত থাকতেন দূর্গ, প্রস্তর বা তীর নিক্ষেপের প্রাচীন যুদ্ধাস্ত্র এবং পরবর্তী সময়ের কামান নির্মাণ কর্মকান্ডে। পুর প্রকৌশলিগণ নির্মাণ করতেন সেতু, পোতাশ্রয়, জলপ্রণালী, দালানকোঠা এবং অন্যান্য স্থাপনা। যন্ত্রপাতি তৈরি এবং এসকলকে ক্রিয়াশীল করতে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহের নিমিত্তে ইঞ্জিন তৈরির জন্য ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে যন্ত্র প্রকৌশল পৃথক একটি ক্ষেত্র হিসেবে বিকশিত হয়। ১৮১৮ সালে প্রথম ব্রিটিশ পুর প্রকৌশলীদের পেশাদার সমিতি গঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৮৪৭ সালে যন্ত্র প্রকৌশলীদের সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৌশল বিদ্যার বিভিন্ন শাখার বিকাশের ধারাটিকে পেশাদার সমিতিসমূহের প্রতিষ্ঠার তারিখের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়। সেক্ষেত্রে, পুর প্রকৌশল (১৮৫২), খনি ও ধাতুবিদ্যাগত প্রকৌশল (১৮৭১), যন্ত্র প্রকৌশল (১৮৮০) এবং রসায়ন প্রকৌশল (১৯০৮) ইত্যাদি উল্লেখ করা যেতে পারে। বিমান চালনা সংক্রান্ত প্রকৌশল, শিল্প প্রকৌশল এবং বংশগতি প্রকৌশল ইত্যাদি শাখা প্রকৌশল শাস্ত্রে আরও আধুনিকতম সংযোজন। বাংলাদেশে প্রকৌশলীদের পেশাদার সমিতি ‘ইন্সটিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ৫ মে।

বাংলায় প্রকৌশল চর্চার প্রাথমিক ইতিহাস মূলত দালানকোঠা, ঘরবাড়ি, সড়ক এবং বন্যা প্রশমনে ভেড়িবাঁধ নির্মাণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নৌঁকা ও গৃহ নির্মাণ, গরুরগাড়ি অথবা ঠেলাগাড়ি তৈরি, সেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতি, গৃহকর্মের যন্ত্রপাতি উপকরণ ইত্যাদি তৈরির কৌশলনির্ভর দেশজ প্রকৌশল বর্তমান সময়েও বহুল ব্যবহূত। প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ সমূহের মধ্যে বগুড়ার মহাস্থান গড়, নওগাঁর পাহাড়পুর, কুমিল্লার ময়নামতি সে সময়ের বিরাজিত নির্মাণ দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করছে। প্রাচীন যুগের (১২১৩ খৃস্টাব্দের পূর্বে) একটি সেচ খাল প্রণালীর অস্তিত্বের কথা জানা যায় বৈদিক সাহিত্য ও কাব্যে এর উল্লেখ থেকে। মন্দির এবং পূজা অর্চনার স্থান নির্মাণেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সুলতান (১২১৩-১৫১৯ খ্রি) এবং মোঘল আমলে (১৪৫৯-১৪৭৫ খ্রি) বহু স্মৃতিস্তম্ভ, সমাধি ক্ষেত্র, প্রাসাদ ভবন, দূর্গ এবং মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। ভারতের আগ্রা নগরীতে সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজ মহলের কবরের উপর কিংবদন্তীতুল্য সমাধিক্ষেত্র তাজমহল নির্মাণ করেন, যা পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি।

১৭৮৮ সালে প্রকাশিত মেজর জেমস রেনেল এর স্বীয় পর্যবেক্ষণ সম্বলিত গ্রন্থ মেমোআর অব এ ম্যাপ অব হিন্দুস্তান অর দি মুগল এম্পায়ার-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রারম্ভপূর্ব বাংলা অববাহিকা অঞ্চলে সড়ক ও নৌপরিবহণের বর্ণনা দিয়েছেন। শহর এলাকা এবং সামরিক দূর্গের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সড়ক নির্মাণ করা হতো। মুগল শাসনামলের শেষ দিকে এবং ইউরোপীয় বণিকদের আগমনের সময় বাণিজ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগের পথ হিসেবে নদীপথের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। সপ্তদশ, অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে বাংলার নদী তীরবর্তী বাণিজ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন আভ্যন্তরীণ জলপথের উন্নতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। ঔপনিবেশিক শাসনামলের প্রথমদিকে সড়ক যোগাযোগের উন্নতি ঘটে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সৈন্য চলাচল এবং ডাক যোগাযোগ সহজতর করা। ঔপনিবেশিক শাসনামলের মাঝামাঝি পর্যায়ে ব্রিটিশ প্রকৌশলিগণ সড়ক ও নৌপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং রেলপথ নির্মাণের জন্য মানচিত্র অঙ্কন এবং জরিপ পরিচালনার কাজ হাতে নিয়েছিল।

জেমস রেনেল সর্বপ্রথম বাংলার ভৌগোলিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করেন এবং ১৭৮১ সালে তাঁর বেঙ্গল এটলাস-এ এক ইঞ্চি সমান ১২ মাইল ধরে এতদসংক্রান্ত মানচিত্রগুলি প্রকাশ করেন। ১৭৯২ সালে প্রকাশিত রেনেলের বাংলার নৌচলাচল পথ-এর মানচিত্রে সকল প্রধান নৌচলাচল পথ অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর হিন্দুস্তানের মানচিত্র-এ রেনেল কলকাতার সঙ্গে দূরবর্তী অঞ্চলের সংযোগ রক্ষাকারী ছয়টি প্রধান সড়কের কথা উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে দুটি সম্প্রসারিত ছিল আজকের বাংলাদেশ অঞ্চলে। বাংলার নদীপথে স্টিমার চলাচল শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন জেমস জনস্টন। ১৮২৯ সালে মেরিন বোর্ডের অধীন বাংলার নদীসমূহে চলাচলকারী সকল স্টিমারের অস্থায়ী নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয় জনস্টনকে। ১৮৩০ সালে তাঁকে বৃটেনে পাঠানো হয় ভারতীয় নদীসমূহে চলাচলের উপযোগি স্টিমার নির্মাণ এবং নকশা তৈরির ক্ষেত্রে পরামর্শ প্রদানের জন্য। ঊনবিংশ শতকের ৬০ এর দশকের মধ্যে দ্রুততর এবং অধিকতর আস্থা সৃষ্টিকারী পরিবহণ ব্যবস্থা হিসেবে পূর্বভারতীয় রেলপথ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত স্থাপিত রেলপথ চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ভারতে রেলপথের সূচনার প্রথম দুই দশকের মধ্যেই মূল প্রধান লাইনগুলোর কাজ সমাপ্ত হয় এবং পরে শুরু করা হয় প্রধান লাইনের সঙ্গে সংযুক্ত সরবরাহকারী অপ্রধান লাইনগুলোর কাজ যেগুলি ‘ন্যারো গেজ’ নামে পরিচিত। ১৯১৫ সালে পাকশির সারার সন্নিকটে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত হয় হার্ডিঞ্জ সেতু যার মাধ্যমে ব্রডগেজ লাইন সান্তাহার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল।

ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর, উন্নয়ন উপযোগী অবকাঠামোর প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন কর্মকান্ড, সেচ, বিদ্যমান সড়ক ও সেতুর উন্নয়ন এবং নতুন নতুন স্থানে নির্মাণ, শিল্প কারখানা এবং গ্যাস ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, আহরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়নের উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সালের ব্যাপক বন্যার পর বহু স্থানে ভেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং নিষ্কাশন ব্যবস্থা সুগম করা হয়েছিল। ১৯৫৪ সালে জি-কে প্রজেক্ট (গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প) বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ১৯৬২ সালে প্রাথমিক পর্যায়ের একটি খাল প্রণালীসহ একটি পাম্প কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। প্রায় একই সময়ে ৮০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং এর সঙ্গে কর্ণফুলি নদীর উপর একটি বাঁধ নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৬২ সালে। বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৬৩-১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সময়কালে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ডান তীরে কাউনিয়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ২১৭ কিমি দীর্ঘ ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লোনাপানির অনুপ্রবেশ এবং জোয়ারসৃষ্ট ও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চ অঞ্চলের নদীর বন্যা প্রতিরোধার্থে ১৯৬১-১৯৬৮ সালে ‘উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্পের’ আওতায় একটি জটিল বিন্যাসের বাঁধ নির্মাণ করা হয়। ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশকের মধ্যে সমাপ্ত হয় আরও কয়েকটি প্রধান বন্যা নিয়ন্ত্রণ-নিষ্কাশন এবং সেচ প্রকল্প, যেমন: কর্ণফুলি সেচ প্রকল্প, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প, মুহুরি সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প ইত্যাদি। রংপুরের দুয়ানিতে তিস্তা নদীর উপর ১৯৮০ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত সময়কালে একটি বাঁধ নির্মিত হয়। বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর এবং বগুড়া জেলার ৫,৪০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এই বাঁধ নির্মিত হয়। দেশের অন্যান্য বিশিষ্ট প্রকৌশল স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ১৯৭০-এর দশকে ঢাকায় নির্মিত জাতীয় সংসদ ভবন, যমুনা নদীর উপর দিয়ে পুর্ব-পশ্চিম বিদ্যুত সরবরাহ সংযোগ ব্যবস্থা, ১৯৮০-এর দশকে সাভারে নির্মিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং ১৯৯৮ সালে যমুনা নদীর উপর নির্মিত যমুনা বহুমুখী সেতু।

সরাসরি উৎপাদনমুখী এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ ভিত্তিক শিল্প কারখানাগুলি ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে শুরু করেছিল ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে। এই ধারার সূত্রপাত ঘটেছিল পাটকলগুলির মাধ্যমে। পরবর্তী পর্যায়ে গড়ে উঠেছে, চিনি, বস্ত্র, সিরামিক এবং সার কারখানাগুলি। সিলেট ও কুমিল্লার গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন ঘটে এবং গৃহকর্ম এবং শিল্পে ব্যবহারের উদ্দেশে বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন নির্মিত হয় ১৯৭০ এর দশকে। ১৯৮০ এর দশক থেকে সামর্থ্য এবং মান- উভয় দিক থেকে নির্মাণ শিল্পে এদেশে প্রকৃত অর্থেই উন্নয়ন ঘটেছে। গত দশক থেকে নির্মিত বহুতল ভবনগুলি ঢাকা মহানগরের দিগন্তকে বদলে দিয়েছে। তবে এর মূল্য দিতে হয়েছে অন্যান্য ক্ষেত্রে, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহে মারাত্মক ঘাটতি এবং অত্যন্ত অপর্যাপ্ত বর্জ্য আবর্জনা ও বন্যার পানি নিষ্কাশন সুবিধা বর্তমানে এই মহানগরের বৈশিষ্ট্য। শিল্পায়ন এবং শহুরে জনসংখ্যার ও যন্ত্রচালিত যানবাহনের বৃদ্ধি নগরসমূহে দূষণ, রোগ, অগ্নিকান্ড এবং ভূমিকম্পের মত দুর্যোগজনিত সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

প্রকৌশল বিদ্যার বিশেষায়িত ক্ষেত্রসমূহ  প্রকৌশল বিদ্যার বিভিন্ন শাখা রয়েছে। কিছু সংখ্যক প্রধান শাখা বা বিশেষায়িত ক্ষেত্রের সঙ্গে অপ্রধান কিছু ক্ষেত্রও এর অন্তর্ভুক্ত। এইসব শাখাসমূহ সৃষ্টি হয়েছিল প্রযুক্তিজ্ঞানের ক্রম সম্প্রসারণশীল ধারার ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে প্রকৌশল বিদ্যার প্রধান শাখাগুলো সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হলো:

কৃষি প্রকৌশল  কৃষিপণ্যের উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাত করণে প্রকৌশল বিদ্যার নীতিসমূহের প্রয়োগ সম্পর্কিত শাখা। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যন্ত্র, উপকরণ ও শক্তি এর আলোচ্য বিষয়। কৃষি প্রকৌশলিগণ কৃষি সরঞ্জামের নকশা তৈরি ও উন্নত করার কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট, এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে যেমন ট্রাক্টর, সার ছিটিয়ে দেওয়ার যন্ত্র, ফলিসো কাটার যন্ত্র এবং পশুদের খাদ্যপ্রদান ব্যবস্থা। খাদ্যশস্য সংগ্রহ, বহন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের যান্ত্রিক কৌশল, খামারে উৎপন্ন কৃষিপণ্যের সঞ্চয় অথবা মজুতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো এবং হাঁসমুরগি, গরু ছাগল ও অন্যান্য খামার প্রাণীর জন্য আবাসস্থলের পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন ছাড়াও সেচ, নিষ্কাশন, ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমি ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নত পদ্ধতির ব্যবহার এবং আরও উন্নত করনের কাজের সঙ্গে যুক্ত কৃষি প্রকৌশলিগণ।

রসায়ন প্রকৌশল  পরীক্ষাগারে রসায়নবিদের আবিষ্কৃত রাসায়নিক বিক্রিয়াসমূহের জ্ঞান ব্যবহার করে বৃহৎ পরিসরে এসিড, রঞ্জনদ্রব্য, ঔষধপত্র, প্লাস্টিক এবং কৃত্রিম রাবার এর মত পণ্য তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি এবং স্থাপনার পরিকল্পনা, নির্মাণ ও পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিদ্যা।

পুর প্রকৌশল  প্রকৌশল বিদ্যার একটি প্রশস্ত শাখা। এই শাখাটি ভবন, সেতু, সুরঙ্গ পথ, রেলপথ, রাজপথ এবং বিমানবন্দর প্রভৃতির পরিকল্পনা, নকশা প্রণয়ন এবং নির্মাণ কর্মকান্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট। পানি সম্পদ উন্নয়ন এবং ব্যবহার প্রকল্পসমূহ, যেমন: নদী শাসন এবং বন্যা প্রশমন কর্মকান্ড, ড্যাম এবং বাঁধসমূহ ছাড়াও পানি সরবরাহ এবং নর্দমা ও আবর্জনা নিষ্কাশন প্রণালী পুর প্রকৌশলের আওতাভুক্ত বিষয়। পুর প্রকৌশলীর কাজ উচ্চমাত্রায় বিশেষায়িত হতে পারে, যা সরকারি এবং ব্যক্তিপর্যায়ের নির্মাণ কর্মকান্ডের প্রতিটি কল্পনাসাধ্য দৃষ্টিভঙ্গিকে ধারণ করে। এর অন্তর্ভুক্ত বিশেষায়িত কয়েকটি শাখা নিম্নরূপ:

পরিবেশ প্রকৌশল  প্রস্তাবিত প্রকৌশল কর্মকান্ডসমূহের পরিবেশগত প্রভাবকে লাঘব করার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পরিবেশ প্রকৌশলিগণ কঠিনাকারে বর্জ্য নিষ্কাশন এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। তারা পানি বিশুদ্ধকরণ এবং আবর্জনা প্রক্রিয়াজাতকরণ স্থাপনার নকশা প্রণয়ন ও কার্যক্রম তত্ত্বাবধান এবং ভূমির উপরে বায়ু ও পানিতে দূষণ পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপ করে থাকেন।

ভূপ্রযুক্তি প্রকৌশল  এর অধীত বিষয় মৃত্তিকা এবং পাথরের গঠনগত আচরণ। স্থাপনাসমূহে প্রয়োজনীয় মৃত্তিকার গুণাগুণ বিশ্লেষণ এবং ভবন, সেতু, রাজপথ এবং বিমানবন্দরে ব্যবহূত চলাচলের পথ প্রভৃতির ভিত্তি স্থাপন সংক্রান্ত কর্মকান্ড ভূপ্রযুক্তি প্রকৌশলের আওতাভুক্ত। গঠন সংক্রান্ত প্রকৌশল বিশাল ভবন, সেতু, স্তম্ভ এবং অন্যান্য অবয়বের নকশা বা পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্ট। এ শাখার প্রকৌশলিগণ যথোপযুক্ত গঠন সংক্রান্ত উপাদানের (উদাহরণস্বরূপ বীম, স্তম্ভ, স্লাব) নকশা তৈরি ও উপকরণ নির্বাচন করেন। স্থাপনার পর্যাপ্ত শক্তি, স্থায়িত্ব ও টেকসই ক্ষমতা সৃষ্টির পদ্ধতি এই প্রকৌশলভুক্ত।

জরিপ ও ভূ-আকার পরিমাপ প্রকৌশল  ভূখন্ডের প্রাকৃতিক অথবা মানবসৃষ্ট আকৃতির গঠন ও অবস্থান সম্পর্কে চিত্রানুগ বর্ণনা, ভূ-পৃষ্ঠের মানচিত্র তৈরি এবং পরিমাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

পরিবহণ প্রকৌশল  রাজপথ, রেলপথ, বিমানবন্দর এবং গণপরিবহণ ব্যবস্থার পরিকল্পনা এবং নকশা তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রকৌশলিগণ পরিবহণ টার্মিনাল ও পরিবহণ কৌশল এবং যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ প্রণালীর পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়ন করেন।

পানি সম্পদ প্রকৌশল  পানির ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত। পানি সম্পদ প্রকৌশলিগণের কাজের ক্ষেত্রসমূহ হলো সেচ, নিষ্কাশন, পানিসৃষ্ট দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ (যেমন: বন্যা), পরিবহণের জন্য পোতাশ্রয় ও নদী উন্নয়ন, পানির সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করণ এবং পানির আক্রমণ (যেমন: সমুদ্র তরঙ্গ, নদীপ্রবাহ) থেকে স্থাপনা প্রতিরক্ষা। এরা জলবাহী কাঠামোসমূহের (বাঁধ, ড্যাম, খাল, কৃত্রিম জলপ্রণালী ইত্যাদি), পৌর পানি বিষয়ক কর্মকান্ড, নিষ্কাশন এবং ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ, সেচ প্রণালী, পোতাশ্রয় ও বন্দর কাঠামোর পরিকল্পনা ও নকশা প্রণয়নের কাজ সম্পাদন করেন।

তড়িৎ এবং ইলেকট্রনিক প্রকৌশল  সমাজের প্রয়োজন পূরণে বিদ্যুতের ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করে। তড়িৎ প্রকৌশলিগণ ব্যাপক পরিসরের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। কম্পিউটার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা, চিপ সমূহের নকশা প্রণয়ন ও উৎপাদন থেকে শুরু করে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বৃহৎ বৈদ্যুতিক শক্তি কেন্দ্রের পরিচালনা তত্ত্বাবধান ও পরিকল্পনা পর্যন্ত এই কর্মকান্ড বিস্তৃত। আবাসগৃহে বিদ্যুৎ সংযোগ, ব্যবসার জন্য ইলেকট্রনিক প্রচার, শিল্পে লেজার রশ্মির ব্যবহারসহ যোগাযোগে ভূ-উপগ্রহের ব্যবহার সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এদের অবদান রয়েছে।

যন্ত্র প্রকৌশল  যন্ত্রপাতি, শক্তি এবং যান্ত্রিক উৎপাদন বা উৎপাদন প্রণালীর সাথে সংশ্লিষ্ট। যম্প্রকৌশলিগণ মেশিন টুলের নকশা ও উৎপাদন কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকেন। মেশিন টুল হলো যন্ত্র এবং শিল্পের সকল শাখার জন্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম তৈরির যন্ত্র। যন্ত্র প্রকৌশলিগণ টারবাইন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ও রেফ্রিজারেশন প্রণালী, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী স্থাপনা এবং বিমান পোত, মোটরগাড়ি ইত্যাদির নকশা প্রণয়ন এবং তৈরি করে।

ধাতু এবং ধাতব প্রকৌশল  ধাতু এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত উপকরণের আহরণ, খাদ মিশ্রণ, নির্দিষ্ট আকার প্রদান ও তা দ্বারা নির্মাণ কর্মকান্ডে সংশ্লিষ্ট। এই শাখার প্রকৌশলিকে রসাযন এবং পদার্থ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতে হয়, বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে তাপ গতিবিদ্যা, উচ্চ তাপমাত্রা দ্রবণ রসায়ন এবং তড়িৎ রসায়ন, কঠিনীভবনের নীতিসমূহ, কঠিন অবস্থার পর্যায়গত পরিবর্তন, ক্ষয় এবং বিকৃতি প্রভূতি বিষয়ের উপর। প্রকৌশলিগণ রাসায়নিক আলোক বিদ্যা এবং সুক্ষ্ম বিশ্লেষণাত্মক কৌশলসমূহ ও ভৌত পরীক্ষা পদ্ধতিসমূহের সঙ্গেও সবিশেষ পরিচিত থাকেন।

নৌ স্থাপত্য এবং সমুদ্র প্রকৌশল  সমুদ্রগামী জাহাজের নকশা ও নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল। সমুদ্রের ভৌত প্রভাবের ধারণা ও সমুদ্রপোতাদির বৈদ্যুতিক সার্কিট, কাঠামোগত বিভিন্ন অংশ এবং অন্যান্য বিভিন্ন উপাদান উপকরণ সম্বলিত সমগ্র জটিল কর্মকান্ডের সমন্বিত নকশা প্রণয়নের সামর্থ্য উভয় দিকটিই এ শাখার প্রকৌশল বিদ্যার অন্তর্ভুক্ত।

শিল্প প্রকৌশল  শিল্প উৎপাদন পরিবেশে জনশক্তির কার্যকর ব্যবস্থাপনা, শিল্প যন্ত্রপাতি এবং উপকরাণাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রণালী বিশ্লেষণ, কিউ পদ্ধতি (অর্থাৎ অপেক্ষমান-সারি প্রক্রিয়া), পরিসংখ্যান এবং অন্যান্য গণিতভিত্তিক বিষয় ব্যবহার করে শিল্প প্রকৌশলিগণ স্থাপনার নকশা প্রণয়ন, উপকরণ সংগ্রহ ও ব্যবহার, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এবং শিল্প মান নিয়ন্ত্রণের মতো শিল্প কর্মকান্ডের পরিচালনা সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন।

জ্বালানি তৈল এবং খনিজ সম্পদ প্রকৌশল  খনিজ দ্রব্যের অনুসন্ধান, অবস্থান নির্ণয় এবং গ্যাস ও তেলের মজুত নির্ণয়, এসব খনির অভ্যন্তরস্থ তরল পদার্থের প্রকৃতি ও পরিমাণ নির্ণয় এবং ঐসব তরলের যথাযথ ও আর্থিক সদ্ব্যবহার সম্পর্কিত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। খনিজ তেল এবং খনিজ তেল সামগ্রীর আবিষ্কার, উৎপাদন, পরিবহণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাত করণের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত, পর্যালোচনা প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। বিশেষ করে, যারা খনি এলাকার সড়ক নির্মাণ এবং কূপ প্রস্ত্তত ও উৎপাদন, উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সুবিধাদি, সংগ্রহ ও সরবরাহ প্রণালী ইত্যাদি কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তাদের জন্য।

বস্ত্র প্রকৌশল  বস্ত্র শিল্পে উৎপাদন স্থাপনাসমূহের পরিকল্পনা, নকশা এবং পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

প্রকৌশল শিক্ষা  বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার ইতিহাস খুঁজলে ফিরে যেতে হয় ১৮৭৬ সালে যখন নীলগোলায় ঢাকা জরিপ স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি ভাড়া করা ইমারতে, ব্রিটিশ ভারতে বাংলার সরকারের জন্য জরিপকারীদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশে ঢাকা জরিপ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মুসলিম সমাজে শিক্ষাকে সহজতর এবং শিক্ষাবৃদ্ধির জন্য নওয়াব স্যার খাজা আহসানউল্লাহ এই প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ, উন্নয়ন এবং মান উন্নত করার জন্য ১৯০৫ সালে ১ লক্ষ ১২ হাজার রূপি দান করেন। ১৯০৬ সালে সরকারি উদ্যোগে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লা্হ হলের কাছে নিজস্ব বিদ্যালয় ভবন নির্মিত হয়। কয়েক বৎসর পূর্বেও এ স্থানে টিকে থাকা একটি লম্বা চিমনি প্রতিষ্ঠানটির সাক্ষ্য বহন করত। ১৯০৮ সালে আহসানউল্লাহর দানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিদ্যালয়টির পুর্ণ নামকরণ করা হয় আহসানউল্লাহ প্রকৌশল বিদ্যালয়। ১৯২০ সালে বিদ্যালয়টিকে আজকের বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে অবস্থিত সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়টি ঢাকা কলেজের অধিভুক্ত ছিল এবং পরে প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালক, গণনির্দেশনা বিভাগের অধীনে আনা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তৎকালীন সরকার বাংলায় শিল্প উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিসরের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, তবে তখন দক্ষ শ্রমশক্তির তীব্র ঘাটতি ছিল। এ অবস্থায় সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একটি কমিটি ঢাকায় একটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করে। যার আসন সংখ্যা ১২০টি। যন্ত্র, তড়িৎ, রসায়ন এবং কৃষি প্রকৌশলে ৪ বৎসরের স্নাতক ডিগ্রি প্রদানের কর্মসূচি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কমিটি আহসানউল্লাহ প্রকৌশল বিদ্যালয়কে তখনকার পলাশী ব্যারাক এলাকায় স্থানান্তর এবং পূর, যন্ত্র এবং তড়িৎ প্রকৌশলে ৩ বৎসরের ডিপ্লোমা কোর্সে ৪৮০ জন ছাত্রছাত্রীর ভর্তি অনুমোদন করে।

১৯৪৭ সালের অগাস্টে আহসানউল্লাহ প্রকৌশল বিদ্যালয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রকৌশল অনুষদ হিসেবে আহসানউল্লাহ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ে উন্নীত হয় (অধুনা বি.ইউ.ই.টি)। প্রতিষ্ঠানটি দেশে প্রকৌশলির ক্রমবৃদ্ধিমান চাহিদা পূরণ এবং প্রকৌশল শিক্ষার অগ্রসরতার জন্য সুযোগ সুবিধার সম্প্রসারণের উদ্দেশে পুর, তড়িৎ, যন্ত্র প্রকৌশলে চার বৎসরের স্নাতক কোর্স চালু করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে হাকিম আলিকে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়টিকে স্বীকৃতি প্রদান করে এবং পুর, যন্ত্র, তড়িৎ, রসায়ন, কৃষি এবং বস্ত্র প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি প্রদান ও পুর, যন্ত্র ও তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদান অনুমোদন করে। শেষাবধি বস্ত্র ও কৃষি প্রকৌশলের পরিবর্তে ধাতুবিদ্যাগত প্রকৌশল বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে ১৯৫১ সালে মি. টি.এইচ ম্যাথুম্যান এবং ১৯৫৪ সালে এম.এ রশীদ প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন।

১৯৫৬ সালে আহসাউল্লাহ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় নতুন কোর্স শিক্ষাক্রম এবং অর্ধ বর্ষব্যাপী পাঠক্রম পদ্ধতি প্রবর্তন করে। ১৯৫৭ সালে স্নাতক পর্যায়ে ভর্তির আসন সংখ্যা ১২০ থেকে ২৪০ এ বৃদ্ধি করা হয় এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ডিপ্লোমা কোর্স বন্ধ করে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘টেক্সাস এ এন্ড এম কলেজের’ সাথে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্পর্কিত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। টেক্সাস থেকে একাধিক শিক্ষক এখানে এসেছিলেন এবং তাঁরা শিক্ষাদান, পরীক্ষাগারের উন্নয়ন এবং কোর্স পাঠক্রমের মনোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এখানকার কয়েকজন শিক্ষককে ‘টেক্সাস এএন্ডএম’ কলেজে পাঠান হয় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নের জন্য। এশিয়া ফাউন্ডেশন প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক দান করে এবং বই ভাড়া দেয়ার গ্রন্থাগার পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়ন এবং গবেষণার সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে আহসানউল্লাহ প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়কে ১৯৬২ সালের ১লা জুনে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয। এম.এ রশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে, এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচটি অনুষদের অধীনে ষোলটি বিভাগে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মানবিক বিভাগ ব্যতীত সকল বিভাগের ডিগ্রি প্রদান কার্যক্রম রয়েছে, অবশ্য এ বিভাগ সমূহের কোন কোনটি শুধুমাত্র স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করে।

প্রকৌশল শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য দেশের অন্যান্য অঞ্চলসমূহে প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে দুটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় পুর, যন্ত্র ও তড়িৎ প্রকৌশলে ৪ বৎসরের স্নাতক ডিগ্রি প্রদানের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। রাজশাহী প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র/ছাত্রীর প্রথম দলটি ১৯৬৪ সালে শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেছিল এবং ১৯৬৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছিল। সত্তর দশকের মধ্য ভাগে খুলনা প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধামাত্র পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ৩ বৎসরের ডিপ্লোমা অর্জনকারী ছাত্র/ছাত্রীদের জন্য সাড়ে তিন বৎসরের স্নাতক শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে অপর একটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়গুলি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। আশির দশকের প্রথমদিকে চারটি প্রকৌশল মহাবিদ্যালয়ের সবকটিই ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং প্রতিষ্ঠানের সমূহের নামেরও নিম্নরূপ পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনলজি, রাজশাহী; বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, চট্টগ্রাম; বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, খুলনা এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি, ঢাকা। প্রকৌশল শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে সরকার ২০০২ সালে বাংলাদেশে চারটি টেকনোলজি ইনস্টিটিউটকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করে। এদের নামকরণ হয় রাজশাহী  প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগাং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯৯০ এর দশকে বাংলাদেশে প্রকৌশল শিক্ষার বৃদ্ধি ধীর গতিতে ঘটেছে। সে সময় বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কয়েকটি কিছু প্রকৌশল ক্ষেত্রে ডিগ্রি প্রদান করছে।

কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা  যন্ত্রবিদগণ ব্যবহারিক উদ্দেশ্য অর্জনের পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান রাখেন। যন্ত্রবিদের চিরাচরিত কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে নকশা অঙ্কন, জরিপ, প্রাক্কলন, তথ্য সংগ্রহ এবং নির্মাণ ও উৎপাদন প্রক্রিয়া সমূহের তত্ত্বাবধান। কারিগরেরা দক্ষ কর্মী, এরা নকশা অনুযায়ী বিভিন্ন উপকরণ ও পণ্য উৎপাদন বা সুবিধাদি রক্ষার কাজে যুক্ত। এ ধরনের বিশেষজ্ঞের মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎ মিস্ত্রি, ছুতার মিস্ত্রি, ওয়েল্ডার, যন্ত্রচালক।

বাংলাদেশে বিভিন্ন স্তরের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করা হয়। এইসব শিক্ষা কর্মসূচিসমূহ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। ঢাকায় অবস্থিত বস্ত্র প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয় এবং চামড়া প্রযুক্তি মহাবিদ্যালয়ে বস্ত্র প্রকৌশল এবং চামড়া প্রকৌশলে চার বৎসরের স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করা হয়। সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে ছড়ানো ২০টি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সমূহে স্থাপত্য ও প্রকৌশলবিদ্যায় ডিপ্লোমা প্রদান করা হয়। মাধ্যমিক স্তর উত্তর এই তিন বৎসরের ডিপ্লোমায় বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন: অটোমোবাইল, স্থাপত্য বিদ্যা, রেফ্রিজারেশন এবং এয়ার কন্ডিশনিং এবং পুর, যন্ত্র, তড়িৎ প্রকৌশল। পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এর শিক্ষকগণের প্রশিক্ষণের জন্য একটি কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয় রয়েছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিপ্লোমামুখী শিক্ষা কর্মসূচি রয়েছে। ডিপ্লোমা প্রদান করছে বাণিজ্যে (সাচিবিক বিদ্যা এবং হিসাব বিজ্ঞান), বস্ত্রে, জরিপ, এবং গ্রাফিক আর্টসে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৬টি কমার্শিয়াল ইন্সটিটিউট রয়েছে, একটি গ্রাফিক আর্টস এবং একটি কাঁচ ও সিরামিক ইন্সটিটিউট ঢাকায় অবস্থিত এবং রাজশাহীতে রয়েছে একটি জরিপ ইন্সটিটিউট। দেশের ৫১টি বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বৃত্তিভিত্তিক কোর্স পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় যান, বৈদ্যুতিক, নকশা অঞ্চল (পুর ও যন্ত্র), বেতার, টিভি, রেফ্রিজারেশন বা হিমায়ন এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, ওয়েল্ডিং, খামার যন্ত্রপাতি, পূর্ত কর্ম, কাঠের কাজ, প্লাম্বিং এবং পাইপ ফিটিং, বয়ন, নির্মাণ রক্ষাণাবেক্ষণ।

পেশাদারী সমিতিসমূহ প্রকৌশলীদের প্রথম পেশাদারী সমিতিটি ইন্সটিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৪৮ এর মে মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৌশল পেশার উন্নতি বিধানে প্রয়োজনীয় কর্মকান্ড, দেশের এবং অন্যান্য দেশের প্রকৌশলীদের মধ্যে জ্ঞান, চিন্তাভাবনা ধারণা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় কার্যক্রম পরিচালনার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত। প্রতিষ্ঠানটি সমিতির সহযোগী সদস্যপদের পার্ট এ এবং পার্ট বি পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে। এই পরীক্ষার উত্তীর্ণ হওয়ার পর একজন প্রকৌশলি ইন্সটিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর সহযোগী সদস্য পদ লাভ করেন (এ.এম.আই.ই)। একজন এ.এম.আই.ই স্নাতক ডিগ্রিধারী প্রকৌশলীর মতো একইরূপ কাজ পেতে পারেন। আই.ই.বি প্রকৌশলী এবং যন্ত্রবিদদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিতভাবে প্রকৌশল পেশাভিত্তিক পত্রিকা ও নিউজ লেটারও প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য প্রকৌশলী সমিতি সমূহের মধ্যে রয়েছে পরামর্শক প্রকৌশলী সমিতি, স্বনিযুক্ত প্রকৌশলী সমিতি, যন্ত্র প্রকৌশলী সমিতি, ভূপ্রযুক্তি প্রকৌশলী সমিতি ইত্যাদি।  [মোহাম্মদ ফজলুল বারী]