সুফিবাদ

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২৩:১১, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল­াহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। ‘সুফ অর্থ পশম আর তাসাওউফের অর্থ পশমী বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাব্সু’স-সুফ)- অতঃপর মরমীতত্ত্বের সাধনায় কাহারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।’ (সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ, প্রথম খন্ড, পৃ.৪৫২) ইসলামি পরিভাষায় সুফিবাদকে তাসাওউফ বলা হয়, যার অর্থ আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান। তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বুঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) এবং ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়িভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাওউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ-প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশ্শাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়। বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি দর্শন অনুযায়ী সুফি আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে।

হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর মতে মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়। জেনে রাখো এটি হলো কল্ব বা হূদয়। আল্লাহর জিকর বা স্মরণে কল্ব কলুষমুক্ত হয়। সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কল্বকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য। যাঁরা তাঁর প্রেমার্জন করেছেন, তাঁদের তরিকা বা পথ অনুসরণ করে ফানাফিল্লাহর মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ অর্জন করাই হলো সুফিদর্শন।

সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি-দরবেশ, কবি-সাহিত্যিক এবং দার্শনিকগণ নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা-পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত ওলীদের অবলম্বন করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে চারটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে: ১. বড় পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (র.) প্রতিষ্ঠিত  কাদেরিয়া তরিকা, ২. সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতি (র.) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা, ৩. হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (র.) প্রতিষ্ঠিত নক্শবন্দিয়া তরিকা এবং ৪. হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানী সারহিন্দী (র.) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা। এছাড়া সুহ্রাওয়ার্দিয়া তরিকা, মাদারীয়া,  আহমদিয়া ও  কলন্দরিয়া নামে আরও কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে।

বাংলাদেশে সুফিবাদের আবির্ভাবকাল সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে এগারো শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত এদেশে ইসলামের সর্বাধিক প্রচার ও প্রসার হয়েছে বলে জানা যায়। আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা এসে বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন। খ্রিস্টীয় এগারো-বারো শতাব্দীতে যেসব সুফি-সাধক এদেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:শাহ সুলতান রুমী (র.),  বাবা আদম শহীদ (র.),  শাহ সুলতান বলখী (র.), শাহ নিয়ামতুল্লাহ বুতশেকন (র.), শাহ মখদুম রূপস (র.), শেখ ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জ(র.),  মখদুম শাহ দৌলা শহীদ (র.) প্রমুখ। এঁরা গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলেও কথিত হয়। এঁদের অসাধারণ জ্ঞান, বাগ্মিতা ও মানবপ্রেমের কারণে এদেশের সাধারণ মানুষ সুফিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এভাবে ক্রমশ বঙ্গদেশে সুফিবাদ প্রসার লাভ করে।

১২০৪-৫ খ্রিস্টাব্দে  বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলাদেশ বিজিত হলে ইসলামের শরীআত ও মারিফত উভয় ধারার প্রচার ও প্রসার তীব্রতর হয়। শাসকশ্রেণীর সঙ্গে বহু পীর-দরবেশ এদেশে আগমন করে ইসলাম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। মুসলিম বিজয়োত্তর যে কয়জন সুফি-দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাঁদের মধ্যে শেখ জালালুদ্দীন তাব্রিজি (র.), শাহ জালাল (র.), শেখ আলাউল হক (র.), খান জাহান আলী (র.), শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা (র.), শাহ ফরিদউদ্দীন (র.) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এঁরা সুফিবাদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব চমৎকারভাবে তুলে ধরে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেন, ফলে বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এই মতবাদ প্রসার লাভ করে।

সুফি সাধকদের আগমনের পূর্বে বঙ্গদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরা বসবাস করত। এই দুই ধর্মের গুরু-সাধকগণ আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে দীক্ষা দান করতেন। সুফিগণ ইসলামের মহাসত্যের প্রতি মানুষকে আহবান করেছেন প্রেমের মাধ্যমে। মানবপ্রেম তথা সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের মূল আদর্শ। সুফিগণ নিজেদের আদর্শ জীবন এবং সুফিবাদের প্রেম-ভ্রাতৃত্ব-সাম্যের মধুর বাণী প্রচার করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে এদেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ কিংবদন্তি-পুরুষে পরিণত হয়েছেন। অনেকের মাযার-মাকবারা আছে, যেগুলির প্রতি আজও সব শ্রেণীর মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে; পবিত্র ও পুণ্য স্থান বিবেচনায় এমন কি কেউ কেউ দোয়াদরূদ পাঠসহ নিয়মিত যিয়ারত করে ও পার্থিব কামনা-বাসনায় মানত করে।

সৃষ্টির প্রতি প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের এই আদর্শের দ্বারা বৈষ্ণবধর্ম, লৌকিক মরমিবাদ, বাউল ধর্মমত ও অন্যান্য ভক্তিবাদ কমবেশি প্রভাবিত হয়। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সুফিদের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় মাঝিরা বদর পীরের নাম স্মরণ করে। শুধু তাই নয়, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পীর-আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। লৌকিক ধারার মুর্শিদি-মারফতি গান,  গাজীর গান, গাজী কালু ও চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমীসাহিত্য, মাদার পীর ও সোনা পীরের মাগনের গান ইত্যাদি বিভিন্ন পীর-দরবেশকে কেন্দ্র করে রচিত। এভাবে বাংলাদেশে মানুষের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈষয়িক জীবনের নানা ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রয়েছে। [আ.ন.ম রইছউদ্দিন]

গ্রন্থপঞ্জি  TW  Arnold, The Preaching of Islam, Lahor, 1956; গোলাম সাকলায়েন, পূর্ব পাকিস্তানের সুফি সাধক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৬১; Sidney Spenser, Mysticism in World Religion, Harmondsworth, 1963; Muhammad Enamul Haq, A History of Sufism in Bengal, Asiatic Society of Bangladesh, Dacca, 1975.