বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:২৪, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড  পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের সকল নদী, জলপথ ও ভূগর্ভস্থ পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান।

সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৫৪, ১৯৫৫ এবং ১৯৫৬ সালে পর পর তিন বছর উপর্যুপরি বন্যার কারণে দেশের খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলে মারাত্মক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করে সে পরিস্থিতি কোনো রকমে সামাল দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও সে বছর খাদ্য সামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রচুর। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার জাতিসংঘের কারিগরি সহায়তার জন্য অনুরোধ জানায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব জে.এ ক্রুগ-এর নেতৃত্বে একটি মিশন গঠন করা হয়। ১২ নভেম্বর ১৯৫৬ তারিখে কাজ শুরু করে ‘ক্রুগ মিশন’ এবং ৩ জুন ১৯৫৭ তারিখে প্রতিবেদন দাখিল করে। তাদের সুপারিশ অনুসারে ১৯৫৯ সালে এক সরকারি অধ্যাদেশ অনুসারে পূর্ব পাকিস্তানের পানি এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল বিষয় পরিচালনার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ইপিওয়াপদা) নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এ সংস্থার ওয়াটার উইং এবং পাওয়ার উইং নামে দুটি উইং ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে ইপিওয়াপদা বিলুপ্ত করা হয় এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো) নামে দুটি ভিন্ন সংস্থা গঠন করা হয়। এ সময়ে বাপাউবো-এর কার্যাবলি ইপিওয়াপদার ওয়াটার উইং-এর অনুরূপ রাখা হয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)-এর কর্মকান্ড পরিচালনার দায়িত্ব একজন চেয়ারম্যান এবং পাঁচজন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত বোর্ড-এর ওপর ন্যস্ত করা হয়।

উনিশ শতকের নববয়ের দশকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকান্ডে গতিশীলতা সৃষ্টি এবং এটি স্ব-শাসিত সংস্থা হিসাবে পুনর্গঠন করার জন্য দাতা সংস্থাসমূহ ক্রমাগত চাপ প্রদান করে। এ প্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন-২০০০’ পাশ হয়। বোর্ড পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ১৩ সদস্যের পরিষদ গঠন করা হয়। বোর্ডের প্রশাসন সহ সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য একজন মহাপরিচালক এবং তাঁকে সহায়তা করার জন্য পাঁচজন অতিরিক্ত মহাপরিচালককে নিয়ে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী বর্তমানে বাপাউবো পরিচালিত হচ্ছে।

আইন অনুসারে ‘পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা’-এর মাধ্যমে সকল নদী, জলপথ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা বাপাউবো-এর উপর অর্পণ করা হয়। জাতীয় পানি নীতি এবং জাতীয় পানি পরিকল্পনার আলোকে পানি সম্পদ সেক্টরের প্রকল্প প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, পরিচালন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম গ্রহণের দায়িত্বও এ সংস্থাকে দেওয়া হয়। সংস্থাটির কার্যক্রম দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়। প্রথম কাঠামোগত কার্যাবলী এবং দ্বিতীয় অকাঠামোগত ও সহায়ক কার্যাবলী। তবে এই দুই শ্রেণির কার্যাবলী পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। বোর্ডের কাঠামোগত কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে: ১. নদী ও নদী অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারেজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যে কোনো কাঠামো নির্মাণ; ২. সেচ, মৎস্য চাষ, নৌপরিবহণ, বনায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশ উন্নয়নের নিমিত্ত পানি প্রবাহের উন্নয়ন বা পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য জলপথ, খালবিল ইত্যাদি পুনঃখনন; ৩. ভূমি সংরক্ষণ, ভূমি পরিবৃদ্ধি ও পুনরুদ্ধার এবং নদীর মোহনা নিয়ন্ত্রণ; ৪. নদী তীর সংরক্ষণ এবং নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে শহর, বাজার, হাট এবং ঐতিহাসিক ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ সংরক্ষণ; ৫. উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ; ৬. লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ এবং মরুকরণ প্রতিরোধ এবং ৭. সেচ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও পানীয় জল আহরণের লক্ষ্যে বৃষ্টির পানি ধারন। এছাড়া এর অকাঠামোগত ও সহায়ক কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে : ১. বন্যা ও খরা সম্পর্কে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ; ২. পানি বিজ্ঞান সম্পর্কে অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা এবং এ সম্পর্কিত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণ; ৩. পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের নিমিত্ত নিজস্ব জমিতে বনায়ন, মৎস্য চাষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং বাঁধের উপর রাস্তা নির্মাণ; ৪. বোর্ডের কার্যাবলির উপর মৌলিক ও প্রয়োগিক গবেষণা; ৫. সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রকল্পের সুফল অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে তাঁদেরকে সংগঠিত করা ও প্রকল্পের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে তাঁদের উৎসাহিত করা এবং ৬. প্রকল্প রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন এবং প্রকল্প ব্যয় পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন কলাকৌশল ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উদ্ভাবন, বাস্তবায়ন ও পরিচালন।

দেশে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিমাণ প্রায় ১১৭ লক্ষ হেক্টর। এর বিপরীতে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৫৮.৯১ লক্ষ হেক্টর এলাকা বন্যা প্রতিরোধ কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। দেশের সেচযোগ্য প্রায় ৮২ লক্ষ হেক্টর জমির বিপরীতে বাপাউবো-এর নিজস্ব  ব্যবস্থাপনায় ১৪.১৪ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২.৯০ লক্ষ হেক্টর হাওর এলাকায় একটিমাত্র ফসল বোরো ধান চাষের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বাপাউবো। বোর্ড ২০০৮-২০০৯ আর্থিক বছরে বিভিন্ন আকৃতির ১০,২২৪ কিমি বাঁধ নির্মাণ করেছে এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হাওর এলাকায় বোরো ফসল আকস্মিক বন্যা থেকে রক্ষার জন্য ১,৮২৬ কিমি খর্বাকৃতি (dwarf) বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময়ে সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা ছোটবড় মিলিয়ে ৭১৪টি। দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রকল্পে মোট ১৯,৭২৬টি পানিধারক কাঠামো, স্লুইসরেগুলেটর, সেতু, কালভার্ট, ৪টি ব্যারেজ এবং ১৯টি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। বোর্ড প্রদত্ত সুবিধাদির মাধ্যমে বার্ষিক প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার  কৃষিজপণ্য উৎপাদন করা হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রায় ৮ কোটি মানুষ উপকৃত হয় যার সিংহভাগই পল্লী এলাকার কৃষি ও মৎস্যজীবী এবং দিনমজুর শ্রেণির মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যক্রমের অন্যতম প্রত্যক্ষ সুফল হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অধীন গ্রামীণ অবকাঠামো বন্যার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পায় এবং উপকূলীয় এলাকাসহ দেশের অভ্যন্তরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ স্থল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে ব্যবহূত হয়।

জলবায়ুর পরিবর্তন, নদীর পানিপ্রবাহ হ্রাস পাওয়া, নদী ভাঙ্গনে বহুসংখ্যক মানুষ নিঃস্ব হওয়া, নদীতে ক্রমাগত পলি জমা হয়ে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়া, পুরানো সেচ প্রকল্পের কার্যক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, উপকূলীয় এলাকায় উপর্যুপরি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো অকার্যকর হওয়ার ফলে জনজীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি হওয়া, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা এবং জলাবদ্ধতা ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, দীর্ঘ প্রতিক্ষিত গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ করা পানি সম্পদ সেক্টরে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ। বাপাউবো এসব চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  [মো আবু তাহের খন্দকার]