উপকূলীয় ভাঙন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৯:০৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

উপকূলীয় ভাঙন (Coastal Erosion)  জোয়ারভাটা ও সামুদ্রিক তরঙ্গের ক্রিয়ার ফলে উপকূলীয় ভূমি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উপকূলীয় ভাঙন সংঘটিত হয়।  বঙ্গীয় বদ্বীপ অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি দুটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: নিষ্ক্রিয় অথবা পরিত্যক্ত গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি এবং সক্রিয় মেঘনা বদ্বীপীয় প্লাবনভুমি। এ দুটি ভূ-প্রকৃতির মধ্যে গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা প্লাবনভূমি অপেক্ষাকৃত প্রবীণ এবং মেঘনা বদ্বীপীয় প্লাবনভূমি ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে খুবই নবীন। মেঘনা বদ্বীপীয় প্লাবনভূমি পূর্বে চট্টগ্রাম উপকূল থেকে পশ্চিমে  তেঁতুলিয়া চ্যানেল পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ভূমিরূপবিশিষ্ট এ অঞ্চল অত্যধিক গতিশীল। মেঘনা মোহনা বদ্বীপীয় এলাকার চ্যানেল এবং দ্বীপাঞ্চলসমূহের ক্ষয়-বৃদ্ধি নিয়ে এযাবতকাল একাধিক সমীক্ষাকার্য পরিচালিত হয়েছে।

বাংলাদেশের  তটরেখা এবং তৎসংলগ্ন এলাকাসমূহ বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ভূত জোয়ারভাটা সৃষ্ট তরঙ্গের প্রতিসরণ ক্রিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। আন্তঃসাগরীয় গিরিখাত  সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড-এর কারণে এ প্রতিসরণ ক্রিয়া সংঘটিত হয়ে থাকে। প্রতিসরণ ক্রিয়ার ফলে গিরিখাতের উভয় পার্শ্বে জোয়ারভাটার উচ্চ পরিসর এবং গিরিখাতের সম্মুখদেশে জোয়ারভাটার নিম্ন পরিসর সৃষ্টি হয়ে থাকে। অধিকন্তু, মহাদেশীয় ভূভাগের দিকে সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেলে তটরেখার আকৃতি ফানেলের মতো হওয়ায় জোয়ারভাটার ক্রিয়ায় এর প্রভাব পরিদৃষ্ট হয় এবং এ অঞ্চলে জোয়ারভাটার পরিসর উচ্চ হয়ে থাকে। সক্রিয় বদ্বীপীয় অঞ্চলের অধিকাংশ এলাকায় মধ্যম-জোয়ারভাটা ক্রিয়াকলাপের প্রাধান্য বিস্তৃত থাকে এবং এ সকল এলাকায় জোয়ারভাটার গড় পরিসর ২ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে সন্দ্বীপের নিকটবর্তী ক্ষুদ্র এলাকায় উচ্চ-জোয়ারভাটা পরিলক্ষিত হয় এবং গড় পরিসর ৪ মিটারের অধিক হয়ে থাকে। ভরা-জোয়ারের সময় সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেল এলাকায় জোয়ার সৃষ্ট তরঙ্গের গতিবেগ ৩ মিটার/সেকেন্ড অতিক্রম করে থাকে। পশ্চিম শাহবাজপুর ও হাতিয়া চ্যানেল এলাকায় মৌসুমি ঋতুতে ভাটার সৃষ্ট গতিবেগ প্রায়ই ৩ মিটার/সেকেন্ড-এরও বেশি হয়ে থাকে। সন্দ্বীপের উত্তরাংশে ভরা-কটালের সময়  জলোচ্ছ্বাস সংঘটিত হয় এবং সে সঙ্গে সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেলের মধ্য দিয়ে আগত দুটি জলোচ্ছ্বাসের সংঘর্ষও পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন চ্যানেলের পললের বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, সন্দ্বীপ ও হাতিয়া চ্যানেলে কর্দম পরিবেশ এবং শাহবাজপুর ও তেঁতুলিয়া চ্যানেলে সূক্ষ্ম বালুকা পরিবেশ বিদ্যমান।

বিভিন্ন সময়ের মানচিত্রের তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায় বিগত দুশতক জুড়ে সমুদ্র অভিমুখে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবৃদ্ধি ঘটেনি। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র দ্বারা প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ  পলি সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গীয় বদ্বীপের এ অংশে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবৃদ্ধি ঘটেনি। তবে এ সময় ব্যবধানে মেঘনা মোহনা বদ্বীপীয় এলাকায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। সন্দ্বীপ ও সংলগ্ন দ্বীপ এলাকা, হাতিয়া দ্বীপ, ভোলা দ্বীপ এবং নোয়াখালী মূল ভূখন্ড সংলগ্ন তটরেখা এলাকার পরিবর্তনও লক্ষ্যণীয়। দুশো বছরের ব্যবধানে সন্দ্বীপ আয়তনে অনেক সংকুচিত হয়েছে। ১৭৬৪ থেকে ১৭৯৩ এর দিকে সন্দ্বীপ চ্যানেল প্রধান নদী ব্যবস্থা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। এ সময়ে হাতিয়া দ্বীপ যথেষ্ট পরিমাণে প্রবর্ধিত হয়েছে এবং অনেকাংশে দক্ষিণমুখী স্থানান্তরিত হয়েছে। ভোলা দ্বীপও উত্তর-দক্ষিণে বর্ধিত রূপ লাভ করেছে। সাধারণভাবে দ্বীপগুলির প্রায় ৫০ কিমি দক্ষিণাভিমুখী অগ্রসর লক্ষ্য করা গেছে।  মেঘনা নদী তার মূল গতিপথ পরিত্যাগ করে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রাকৃতিক ও মানবীয় কর্মকান্ডের পরিণতি হিসেবে নিম্ন মেঘনার একটি মৃতপ্রায় শাখা পলিভরাট হয়ে গিয়েছে এবং এর ফলে নোয়াখালীর মূল ভূখন্ডের সঙ্গে নতুন ভূভাগ সংযুক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম উপকূলরেখা  বিগত বছরগুলিতে চট্টগ্রাম উপকূলরেখা তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিল। তবে ফেনী নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে উত্তরে ভূমি পরিবৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত বর্তমান কালের প্রবাহ জালিকা থেকে সন্দ্বীপ চ্যানেলের প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। বর্তমানে সন্দ্বীপ চ্যানেলে জোয়ারভাটার প্রাধান্য বিরাজমান এবং শুধু মিহি পলিকণাই এখানে সঞ্চিত হতে পারে।

নোয়াখালী তটরেখা  বিগত বছরগুলিতে নোয়াখালী তটরেখার যথেষ্ট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এ পরিবর্তন পুরাতন নিম্ন মেঘনা নদীতলদেশে ভূমি পরিবৃদ্ধির ফলাফল হিসেবে সংঘটিত হয়েছে। দুটি আড়-বাঁধ দেওয়ার ফলে এ পরিবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে এবং ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সময়ে প্রায় ৫২,০০০ হেক্টর ভূমি পরিবৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। সংযোজিত এ ভূমির আয়তনকে শুধু নদীসমূহ দ্বারা পরিবাহিত বার্ষিক পলিরাশির পরিমাণের সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। যদিও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাভিমুখী নোয়াখালী তটরেখার বৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছে, তবে স্থানীয়ভাবে কিছু কিছু এলাকায় ভাঙনও পরিলক্ষিত হয়। যেমন, শাহবাজপুর চ্যানেলের উর্ধ্বভাগে নোয়াখালী তটরেখায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভাঙন সংঘটিত হয়েছে।

সন্দ্বীপ দ্বীপাঞ্চল  জোয়ারভাটা প্রবণ পূর্ব হাতিয়া চ্যানেল, সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং উড়িরচর সংযোগকারী চ্যানেল দ্বারা আবদ্ধ একটি এলাকা। ১৯১৩ সালের সন্দ্বীপের সঙ্গে ১৯৮৮ সালের সন্দ্বীপ দ্বীপাঞ্চলের তুলনা করলে দেখা যায় প্রায় ৭৫ বছর সময়ে ব্যবধানে সন্দ্বীপের পূর্বেকার আয়তন প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সন্দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে যথেষ্ট ক্ষয়কার্য এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভূমি পরিবৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালের পর থেকে সন্দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমাংশে ক্ষয়কার্য ত্বরান্বিত হয়েছে। ১৯১৩ সাল ও ১৯৬৩ সালের মধ্যে ক্ষয়কার্যের হার ছিল প্রতিবছর প্রায় ২০০ মিটার এবং ১৯৬৩ ও ১৯৮৪ সালের মধ্যে এ হার দাঁড়ায় প্রতিবছরে প্রায় ৩৫০ মিটার। উড়িরচরের আয়তন ১৯৬৩ সালের ৩ বর্গ কিমি থেকে ১৯৮১ সালে ৪৬ বর্গ কিমি দাঁড়িয়েছে।

হাতিয়া দ্বীপ  দক্ষিণ ও পশ্চিম হাতিয়া চ্যানেল এবং পূর্ব শাহবাজপুর চ্যানেল দ্বারা আবদ্ধ। পূর্ব শাহবাজপুর চ্যানেলটি একটি বন্যাপ্রবণ চ্যানেল এবং দক্ষিণ-পশ্চিম হাতিয়া চ্যানেলটি ভাটাপ্রবণ। ১৯৫২ সাল ও ১৯৮৭-৮৮ সালের মধ্যকার সময়ে হাতিয়া দ্বীপের উত্তরাংশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ  নদীভাঙন সংঘটিত হলেও একই সঙ্গে দক্ষিণাংশে যথেষ্ট পরিমাণে সঞ্চয়নও সংঘটিত হয়েছে। ১৯৬৩ সালের পূর্বে হাতিয়ার উত্তরাংশে সংঘটিত ক্ষয়কার্যের বার্ষিক হার ছিল খুবই নগণ্য, কিন্তু ১৯৬৩ সালের পর থেকে ১৯৮৪ সালের মধ্যে এ ক্ষয়কার্য বেড়ে গিয়ে বছরে ৪০০ মিটারে উপনীত হয় যা এতদঞ্চলে সংঘটিত ক্ষয়কার্যের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ভোলা দ্বীপ  উত্তরে তেঁতুলিয়া চ্যানেল এবং পূর্বে শাহবাজপুর চ্যানেল দ্বারা আবদ্ধ। আবদ্ধকারী চ্যানেলগুলি ভাটাপ্রবণ। ভোলা দ্বীপের উত্তর-পূর্ব তটরেখার অত্যধিক ভাঙন কবলিত অংশে ১৯৪০ সাল এবং ১৯৬৩ সালের মধ্যে ভাঙনের হার ছিল প্রতি বছর প্রায় ১৫০ মিটার। ১৯৬৩ এবং ১৯৮৯ সালের জরিপ থেকে দেখা যায়, একই সঙ্গে ক্ষয়কার্য ও সঞ্চয়নকার্য অব্যাহত থাকায় ভোলা দ্বীপের সংকোচন ও বৃদ্ধি সংঘটিত হয়েছে। প্রধানত উত্তর-পূর্বদিকে ক্ষয়কার্য এবং দক্ষিণে সঞ্চয়নকার্য সাধিত হয়েছে।

বদ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ার দুটি প্রধান বিপরীতমুখী শক্তি নদীজ (fluvial) ও সামুদ্রিক (marine) প্রক্রিয়ার আন্তঃক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে মেঘনা মোহনাজ বদ্বীপ অত্যধিক পরিবর্তনশীল আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। নদী প্রণালীসমূহ সমুদ্র অভিমুখে উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর পরিমাণে স্বাদুপানির প্রবাহ ও পলি সরবরাহ করে থাকে। অপরদিকে, সামুদ্রিক প্রক্রিয়া সুস্পষ্ট পাক্ষিক ব্যবধান সম্বলিত অর্ধ-আহ্নিক জোয়ারভাটা সংঘটিত করে থাকে। সন্দ্বীপ ও তৎসংলগ্ন এলাকার আঙ্গিক পরিবর্তন প্রাথমিকভাবে শক্তিশালী জোয়ারভাটা সৃষ্ট তরঙ্গের ফলাফল। পক্ষান্তরে, ভোলা দ্বীপের পরিবর্তনকে প্রাথমিকভাবে নদীজ স্রোতের ফলাফল হিসেবে দায়ী করা হয়ে থাকে। সুতরাং, ভোলার ভাঙন কর্মকান্ড অত্যধিক পরিমাণে ঋতুগত। হাতিয়া দ্বীপ এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় জোয়ারভাটা ও নদীজ প্রবাহ উভয় প্রক্রিয়াই সক্রিয়। তবে, কিছু কিছু এলাকায় যেমন, উড়িরচরের আঙ্গিকগত পরিবর্তন প্রক্রিয়া জোয়ারভাটার মিলন প্রক্রিয়ার প্রাধান্য দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে যা হাতিয়া ও সন্দ্বীপ চ্যানেলের মধ্য দিয়ে আগত দুটি জোয়ারের মধ্যবর্তী বিস্তার ও পর্যায়ের পার্থক্য দ্বারা সূচিত হয়।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

মানচিত্রের জন্য দেখুন উপকূলবর্তী দ্বীপ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ

গ্রন্থপঞ্জি  Barua K Dilip, ‘The Active Delta of the Ganges-Brahmaputra Rivers: Dynamics of its Present Formations’, Marine Geodesy, Special volume on the sea level problems of Bangladesh, 1997.