খ্রিস্টান আইন

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:৫৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

খ্রিস্টান আইন  খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২, বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৮৬৯ এবং উত্তরাধিকার আইন ১৯২৫ সমন্বয়ে সঙ্কলিত আইনবিধান। এ আইন এখনও এদেশে বলবৎ রয়েছে এবং এ আইন দ্বারা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ ও উত্তরাধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মুসলমান ও হিন্দুদের বিবাহ ও উত্তরাধিকারের বিষয়গুলো তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থের বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যদিও এগুলি রাষ্ট্রীয় আইনে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।

বিবাহ বাংলাদেশের খ্রিস্টান নাগরিকদের বিবাহ খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২-এর বিধান মোতাবেক সম্পন্ন হয়ে থাকে। বিবাহে পাত্রপাত্রীর একজন বা উভয়ে খ্রিস্টান হলে তাদের বিবাহে এমন এক ব্যক্তি পৌরোহিত্য করেন যিনি বিশপের দীক্ষা পেয়েছেন কিংবা যিনি স্কটিশ চার্চের একজন যাজক বা এ আইনের আওতায় অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো ধর্মযাজক। কোনো বিবাহ-নিবন্ধক বা এ আইনের আওতায় নিযুক্ত/লাইসেন্সপ্রাপ্ত অপর কোনো ব্যক্তির উপস্থিতিতে বিবাহ সম্পন্ন হতে হবে। বিবাহে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে কোনো ধর্মযাজকের নিকট উপস্থিত হয়ে এ মর্মে ঘোষণা দিতে হয় যে, এ বিবাহে তার (পুরুষ/নারী) কোনো জ্ঞাতিগত, কিংবা অন্য কোনো আইনগত প্রতিবন্ধকতা নেই এবং যুগপৎ তাকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদিসহ ধর্মযাজকের কাছে একটি নোটিশও দিতে হয়। ধর্মযাজক অতঃপর নোটিশ প্রাপ্তি সম্পর্কে একটি প্রত্যয়নপত্র দেন। এ ধরনের প্রত্যয়নপত্র প্রদানের পর প্রত্যয়নপত্রে উল্লিখিত ব্যক্তিদ্বয়ের বিবাহ দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে ধর্মযাজক কর্তৃক যথার্থ বিবেচিত রীতি বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিষ্পন্ন হতে পারে। দেশিয় খ্রিস্টান ব্যতিরেকে ধর্মযাজক কর্তৃক সম্পাদিত অন্য সকলের বিবাহের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। অন্ততপক্ষে দু’জন সাক্ষীর উপস্থিতিতে নোটিশ প্রদানের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে বিবাহ-নিবন্ধক খ্রিস্টান বিবাহ সম্পন্ন করতে পারেন। বিবাহ-নিবন্ধক নাবালক পাত্রপাত্রীর (দু’জনের একজন সাবালক হলেও) তাদের অভিভাবকের সম্মতি ছাড়া বিবাহ সম্পাদন করতে পারেন না। যাজক বা ধর্মযাজক বা বিবাহ-নিবন্ধক কর্তৃক সম্পন্ন দেশিয় খ্রিস্টানদের বিবাহ পৃথক নিবন্ধন বহিতে নিবন্ধিত হয়ে থাকে। দেশিয় খ্রিস্টানদের বিবাহের একটি বয়ঃসীমা রয়েছে। অধিকন্তু, কোনো দেশিয় খ্রিস্টানের স্বামী/স্ত্রী জীবিত থাকলে ওই ব্যক্তি অপর কোনো দেশিয় খ্রিস্টানকে বিবাহ করতে পারে না।

বিবাহ বিচ্ছেদ  আদালতের ডিক্রি ছাড়া বিবাহিত নারী পুরুষের কোনো এক পক্ষের ঘোষণা অথবা উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে খ্রিস্টানদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যায় না। আদালতের ডিক্রিবলে খ্রিস্টান বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান ১৮৬৯ সালের বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ আইনের আওতায় স্ত্রী ব্যভিচারের অপরাধে অপরাধী এ কারণ দর্শিয়ে স্বামী জেলা জজের আদালতে বা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন দাখিল করতে পারে। অনুরূপভাবে, স্ত্রী উল্লিখিত দুই আদালতের যে কোনো একটির কাছে নিম্নোক্ত যেকোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন পেশ করতে পারে : (১) স্বামী বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হলে এবং আরেক স্ত্রী গ্রহণ করলে; (২) স্বামী ব্যভিচারে অপরাধী হলে; (৩) স্বামী ব্যভিচার সহ দ্বিতীয় বিবাহ করলে; (৪) স্বামী আরেক জনকে বিবাহ করলে ও ব্যভিচারে অপরাধী হলে; (৫) স্বামী ধর্ষণ, পায়ুকাম বা পাশবিকতার অপরাধে অপরাধী হলে; (৬) স্বামী ব্যভিচারসহ নিষ্ঠুরতার অপরাধে অপরাধী হলে; (৭) স্বামী কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া দুবছর বা তদধিককাল স্ত্রীকে পরিত্যাগ ও সে সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত থাকলে।

যদি আদালত এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে অভিযোগ সম্পর্কে প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সঠিক এবং অভিযোগকারীর আবেদন যোগসাজশমূলক নয় অথবা ব্যভিচারের অভিযোগ উপেক্ষাযোগ্য বা মার্জনীয় নয়, তাহলে আদালত বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি মঞ্জুর করেন। হাইকোর্ট বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে একজন জেলা জজ বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি নিশি মঞ্জুর করতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারকের একটি বেঞ্চ অভিযোগের শুনানি অথবা আরও তদন্ত বা আরও সাক্ষ্য গ্রহণ করার পর সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের ভিত্তিতে এ ধরনের ডিক্রি নিশি অনুমোদন করতে পারেন। জেলা জজ বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন খারিজ করলে আবেদনকারী হাইকোর্ট বিভাগে অনুরূপ আবেদন পেশ করতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে রায় দিতে পারেন।

পূর্বোক্ত যেকোন আদালত নিম্নোক্ত কারণগুলোর যেকোন একটির দরুন বিবাহ বিচ্ছেদের রায় প্রদান করতে পারেন : দুপক্ষের একজন যৌন মিলনে অক্ষম; দুপক্ষের মধ্যে বিবাহ-অযোগ্য রক্তসম্পর্ক বা আত্মীয়তা বিদ্যমান; দুপক্ষের একজন বিবাহের সময় উন্মাদ ছিল; দুপক্ষের একজনের সাবেক স্বামী/স্ত্রী পরবর্তী বিবাহকালে জীবিত ছিল এবং বিবাহ তখনও বলবৎ ছিল। অধিকন্তু, স্বামী বা স্ত্রী পূর্বোক্ত যেকোন আদালত থেকে ব্যভিচার, নিষ্ঠুরতা বা যুক্তিসঙ্গত অজুহাত ছাড়াই দুই বা ততোধিক বছরের জন্য পরিত্যাগজনিত কারণে আইনসিদ্ধ পৃথকবাসের রায় পেতে পারে। কিন্তু আদালত এ কারণে পৃথকবাসের ডিক্রি পালটে দিতে পারেন যে, স্ত্রী বা স্বামীর অনুপস্থিতিতে এ ডিক্রি দেয়া হয়েছিল এবং অভিযোগে বর্ণিত পরিত্যাগের যুক্তিসঙ্গত কারণ বিদ্যমান ছিল। পরিত্যক্ত স্ত্রীর সম্পত্তি রক্ষার জন্য আদালত একটি আদেশও জারি করতে পারেন। একইভাবে, স্বামী বা স্ত্রী কোনো রকম যুক্তিসঙ্গত অজুহাত ছাড়াই অন্যের সঙ্গ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলে আদালত দাম্পত্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ডিক্রি প্রদান করতে পারেন।

উত্তরাধিকার বাংলাদেশের একজন খ্রিস্টান নাগরিকের সম্পত্তিতে উইলবিহীন ও উইলভিত্তিক উত্তরাধিকারের বিষয়াদি ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, কোনো খ্রিস্টান উইল সম্পাদন না করে মৃত্যুবরণ করলে তার সম্পত্তি জীবিত স্বামী/বিধবা স্ত্রী, নিকট উত্তরপুরুষ বা জ্ঞাতির ওপর বর্তাবে। বিবাহপূর্ব সম্পাদিত বৈধ চুক্তিবলে একজন বিধবা মৃত স্বামীর ভূসম্পত্তির অংশভাগ থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পারে। কোনো খ্রিস্টান উইল সম্পাদন না করে বিধবা স্ত্রী/স্বামী ও নিকট উত্তরাধিকারী রেখে মারা গেলে স্বামী/স্ত্রী পাবে সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ এবং দুই-তৃতীয়াংশ পাবে বংশধরেরা। কোনো খ্রিস্টান উইল সম্পাদন না করে কেবল স্ত্রী/স্বামী ও জ্ঞাতি রেখে মারা গেলে সম্পত্তির অর্ধাংশের অধিকারী হবে স্ত্রী/স্বামী এবং বাকি অর্ধাংশ পাবে জ্ঞাতি। দেশিয় খ্রিস্টান নয় এমন খ্রিস্টান স্বামী/স্ত্রী উইল সম্পাদন না করে মারা গেলে এবং তাদের কোনো বংশধর না থাকলে উক্ত জীবিত স্বামী/স্ত্রী ৫০০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের সম্পত্তি এবং মৃতের সম্পত্তির অবশিষ্ট কিছু থাকলে তার অংশভাগ পাবে। কেউ উইল সম্পাদন না করে এক সন্তান রেখে মারা গেলে তার সম্পত্তি সে জীবিত সন্তান পাবে এবং জীবিত সন্তান একাধিক হলে তারা সম্পত্তির সমান অংশের উত্তরাধিকারী হবে। কেউ উইল সম্পাদন না করে মারা গেলে এবং তার কোনো জীবিত সন্তান না থাকলে কিন্তু এক বা একাধিক পৌত্র/পৌত্রী থাকলে তার সম্পত্তি জীবিত পৌত্র-পৌত্রীরা পাবে। পৌত্র বা পৌত্রী একজন থাকলে সে সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, একাধিক থাকলে ওই সম্পত্তিতে তাদের সমান অধিকার বর্তাবে।

কোনো খ্রিস্টান উইল সম্পাদন না করে শুধু প্রপৌত্র-প্রপৌত্রী কিংবা দূরসম্পর্কের বংশধর রেখে মারা গেলে, যেভাবে তার কোনো সন্তান বা সন্তানাদি থাকলে সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার লাভ করত সেভাবেই উল্লিখিত জীবিত বংশধররাও আত্মীয়তার ঘনিষ্ঠতাক্রমে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির অংশভাগ লাভ করবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি উইল সম্পাদন না করে এক বা একাধিক সন্তান বা মৃত সন্তান বা সন্তানদের পৌত্র-পৌত্রী (এক বা একাধিক) রেখে মারা গেলে জীবিত বংশধরদের সকলেই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবে, যেন মৃত ব্যক্তির মৃত্যুকালে উক্ত মৃত সন্তান বা সন্তানগণ জীবিত ছিল। উইল সম্পাদন ব্যতীত কোনো বংশধর না রেখে কেউ মারা গেলে ও তার পিতা জীবিত থাকলে এ সম্পত্তির ওপর তার পিতার পূর্ণ অধিকার বর্তাবে। উইল সম্পাদন না করে প্রয়াত ব্যক্তির পিতা জীবিত না থাকলে এবং তার মা, ভাই ও বোন বেঁচে থাকলে তারা সমান অংশে ওই ব্যক্তির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে, তবে উক্ত মৃত ব্যক্তির কোনো ভাই বা বোন তার আগেই মারা গিয়ে থাকলে ও তাদের সন্তান থাকলে তারাও তাদের পিতামাতার প্রাপ্য অংশ পাবে। উইল সম্পাদন ব্যতীত মৃত ব্যক্তির কেবল মা বেঁচে থাকলে এবং কোনো ভাই, বোন বা ভাইবোনের ছেলেমেয়ে না থাকলে তার মা সম্পূর্ণ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। উইল সম্পাদন না করে মারা গেলে এবং প্রয়াত ব্যক্তির কোনো নিকট উত্তরাধিকারী না থাকলে, বাবা/মা না থাকলে, তার সম্পত্তি সমান অংশে তার ভাইবোন এবং তার জীবদ্দশায় মৃত ভাইবোনের সন্তানদের ওপর সমান অংশে বর্তাবে, মৃত ভাইবোন বেঁচে থাকলে যেমন অংশ পেতেন। উইল সম্পাদন না করে মৃত ব্যক্তির কোনো উত্তরাধিকারী, বাবা মা বা ভাইবোন না থাকলে তার সম্পত্তি সমান অংশে তার নিকটতম আত্মীয়রা পাবে।

একজন খ্রিস্টান তার নিজ সম্পত্তির বিলিবন্টনের জন্য উইল সম্পাদন করে যেতে পারে। ১৯২৫ সালের উত্তরাধিকার আইনে উইল সম্পাদন, প্রত্যয়ন, বাতিল এবং উইলের পরিবর্তন, পুনর্বহাল ও ব্যাখ্যা সম্পর্কে বিধিবিধান সন্নিবেশিত রয়েছে। এ আইনে মৃতের সম্পত্তির উইলের প্রামাণিকতা, পরিচালনাদেশ এবং সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার বিধিবিধানও সন্নিবেশিত আছে। [কাজী এবাদুল হক]