পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:৫৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আইনগত সমস্যার বিচার নিষ্পত্তি সম্পর্কিত অধ্যাদেশ। ১৯৮৫ সালে এ অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ইসলামী আইন, হিন্দু আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ প্রভৃতি সমন্বয়ে পারিবারিক আদালতের বিচার্য বিষয়ের আইন সংকলিত হয়েছে। এ আইন রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও পার্বত্য এলাকার জেলাসমূহ ছাড়া সারা দেশে প্রযোজ্য। এ আইন বলে দেশের সকল মুন্সেফ আদালত পারিবারিক আদালত হিসেবে গণ্য হবে এবং মুন্সেফগণ এ আদালতের বিচারক হবেন। পারিবারিক আদালত মূলত পাঁচটি বিষয়ে বিচারকার্য নিষ্পন্ন করে থাকে। এগুলি হচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, মোহরানা, ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব।

বিবাহ বিচ্ছেদ (তালাক)  মুসলিম আইনের ৩০৭ ধারায় বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে বিবাহ চুক্তি ভঙ্গ এবং ৩০৮ ধারায় তালাক দ্বারা বিবাহ চুক্তি ভঙ্গের কথা বলা আছে। স্বামী ও স্ত্রী স্বেচ্ছায় আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া এবং যেকোন পক্ষ আদালতের আশ্রয় নিয়ে বিবাহ নাকচ করতে পারে। আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বামীর ইচ্ছানুসারে যখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তখন তাকে বলে তালাক। তালাক মৌখিক বা লিখিত যেকোন প্রকার হতে পারে। মৌখিক তালাকে স্বামী তালাকের নির্দিষ্ট বাক্য সুস্পষ্টভাবে স্বজ্ঞানে উচ্চারণ এবং তদনুসারে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক সম্পন্ন হয়। মৌখিক তালাকের লিখিত দলিল হচ্ছে তালাকনামা। কাযীর উপস্থিতিতে বা স্ত্রীর পিতা অথবা অন্য কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষীর উপস্থিতিতে তালাকনামা সম্পাদিত হলেই তালাক কার্যকর হয়। মুসলিম আইনে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্ত্রীরও তালাক দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে; যেমন (১) চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে; (২) দুবছর পর্যন্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ না দিলে; (৩) সাত বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য স্বামীর কারাদন্ড হলে; (৪) স্বামীর পুরুষত্বহীনতা; (৫) স্বামী উন্মাদ বা সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে; (৬) স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করলে; (৭) স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া পুনরায় বিয়ে করলে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করে ডিক্রি প্রাপ্তি সাপেক্ষে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন। আর কাবিননামায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে (তালাকে তৌফিজ) স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করতে পারেন।

দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার কোনো বৈধ কারণ ব্যতীত স্ত্রী স্বামীর সংসার ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিলে এবং স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বর্জন করলে স্বামী পারিবারিক আদালতে স্ত্রীকে ফেরত পাওয়ার জন্য মামলা করতে পারেন। তবে এ মামলা শুধু বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থাতেই করতে পারেন। বিয়ে ভেঙে গেলে বা তালাক হয়ে গেলে তা করা যাবে না।

মোহরানা  বিয়েতে মোহরানা বা দেনমোহর নির্ধারণ মুসলিম আইনে অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। কাবিননামায় দেনমোহরের পরিমাণ উল্লেখ থাকে। দেনমোহর নির্ধারিত হবে কনের রূপ-গুণ এবং সামাজিক মর্যাদার দিকে লক্ষ্য রেখে। দেনমোহরের পরিমাণ সর্বোচ্চ কত হবে তার কোনো সীমারেখা নেই, তবে সর্বনিম্ন ১০ দিরহামের নিচে নয়। যত বেশি দেনমোহর নির্ধারিত হোক না কেন স্বামীকে অবশ্যই তা পরিশোধ করতে হবে। দেনমোহর সকল অবস্থায় স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ। দেনমোহরের দাবিতে বিধবা স্ত্রী তার মৃত স্বামীর পুরো সম্পত্তি নিজের দখলে রাখতে পারে যতক্ষণ না তার দেনমোহর শোধ করা হয়।

ভরণপোষণ  (নাফাফা) ইসলামী আইনের পরিভাষায় ভরণপোষণকে ‘নাফাফা’ বলা হয়। নাফাফার আওতায় পড়ে খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থান। তিনটি কারণে মানুষের ওপর নাফাফার দায়িত্ব বর্তায়। প্রথম কারণ বিবাহ, দ্বিতীয় কারণ আত্মীয়তা এবং তৃতীয় সম্পত্তির উত্তরাধিকার। যতদিন পর্যন্ত পুত্র সাবালক না হয় এবং কন্যার বিবাহ না হয় ততদিন পিতা সন্তানদের ভরণপোষণ করতে বাধ্য। বিধবা এবং তালাকপ্রাপ্তা মেয়েদের ভরণপোষণের দায়িত্ব পিতার। পিতা অক্ষম ও দরিদ্র হলে মা সন্তানের ভরণপোষণ করবে। বাবা-মা দুজনেই অক্ষম হলে পিতামহের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায়। ভরণপোষণের প্রথম ও প্রধান হকদার স্ত্রী। স্ত্রী সর্বাবস্থায় স্বামীর কাছে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। স্বামীর সঙ্গতি থাক বা না থাক স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে স্বামী বাধ্য। স্ত্রী ধনী এবং সম্পদশালী হলেও ভরণপোষণের অধিকার বাতিল হয় না। বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিন মাস পর্যন্ত ‘ইদ্দকালীন’ সময়ে স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য। হিন্দু ও খ্রিস্টান আইনে ভরণপোষণকে বলে খোরপোষ।

অভিভাবকত্ব  স্বাভাবিক অবস্থায় পিতা নাবালক সন্তানের দেহ ও সম্পত্তির আইনসম্মত অভিভাবক। পিতার অবর্তমানে এ দায়িত্ব মায়ের ওপর বর্তায়। মায়ের অবর্তমানে বা অপারগতায় নাবালকের মাতাপিতার নিকটতম আত্মীয় অভিভাবক হতে পারেন। এমনকি প্রয়োজনে সরকারও নাবালকের দেহ ও সম্পত্তির অভিভাবক নিযুক্ত হতে পারে। তবে পিতার অবর্তমানে নাবালকের দেহ ও সম্পত্তির অভিভাবকত্ব সরাসরি সরকারের কাছে চলে আসে। পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ জারি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জেলা জজ নাবালকের দেহ ও সম্পত্তির অভিভাবক নিযুক্ত হতেন। বর্তমানে এ দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতের সহকারি জজের ওপর অর্পিত হয়েছে। কোনো নাবালকের দেহ বা সম্পত্তি অথবা উভয়ের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য ১৮৯০ সালের গার্জিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট অনুযায়ী আদালতে আবেদন করতে হয়। তবে ইসলামী আইনানুসারে নাবালকের অভিভাবক হওয়ার অধিকারী ব্যক্তি আদালতের আদেশ পাওয়ার আগেই অভিভাবক হিসেবে কাজ করতে পারেন।

বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, মোহরানা, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব এ পাঁচটি বিষয় থেকে উদ্ভূত সমস্যার মামলা পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তি করা হয়। পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করার জন্য বাদিপক্ষের আরজির কোর্ট ফি দিতে হয় মাত্র ২৫ টাকা। পারিবারিক আদালতের বিচারক নিজেই রায় ও ডিক্রি প্রদান করেন। পারিবারিক আদালতের রায় ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে জেলা জজের আদালতে আপিল করা যায়। তবে আদেশের যেসব বিষয়ে আপিল করা যাবে না তা হলো (ক) ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের ২(৮) ধারায় বর্ণিত বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ; (খ) পাঁচ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে নয় এমন মোহরানার ক্ষেত্রে রায় ডিক্রি বা আদেশ জারির ৩০ দিনের মধ্যে আপিল দায়ের করতে হয়। এ আইন অনুযায়ী মোকদ্দমা পরিচালনায় সুবিধার জন্য হাইকোর্ট বিভাগ যেকোন আদালতে মামলা স্থানান্তর করতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে মুন্সেফ আদালতকে জেলা জজ আদালতের মর্যাদা দেওয়া যায়।

এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইনের ওপর প্রাধান্য পাবে; তবে কোনো ব্যক্তিগত আইন তথা সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় আইনকে প্রভাবিত করবে না। যে সকল ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদ স্বীকৃত সেসব ধর্মের অনুসারীদের বেলায় এ আইন প্রযোজ্য হবে। প্রত্যেক ধর্মের বিধানুসারে এ আদালতে বিচারকার্য সম্পাদন ও রায় প্রদান করা হবে। তবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পরিবার আইনের কোনো বিধান এবং বিধিমালা এ অর্ডিন্যান্স দ্বারা প্রভাবিত হবে না।  [সাহিদা বেগম]