পাকিস্তান আন্দোলন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:০৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

পাকিস্তান আন্দোলন  সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয় যে, ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে শুরু হয়। কখনও বলা হয় যে, পাকিস্তানের সূচনা হয়েছে ১৯০৫ সালে। এ সময় মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের দাবি তোলেন। এ দাবি ১৯০৯ সালে মোর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। ১৯১৬ সালের লক্ষ্ণৌ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেসও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলি এ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়।

দার্শনিক-কবি ইকবাল ১৯৩০ সালে সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের এলাহাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে প্রথম বারের মতো ভারত উপ-মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। তিনি তখন দেশ বিভাগের কথা ভাবেননি, বরং ভারত ফেডারেশনের অধীন উপ-মহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিয়ে একটি স্বশাসিত অঞ্চলের স্বীকৃতি চাচ্ছিলেন মাত্র। মুসলিম অধ্যুষিত বাংলা প্রদেশের জন্য অনুরূপ স্বায়ত্তশাসিত এলাকার কথা তাঁর মনে জাগেনি। চৌধুরী রহমত আলীকে পাকিস্তান ধারণার প্রথম প্রবক্তা বলে অভিহিত করা যায়। ১৯৩৩ এবং ১৯৩৫ সালে লিখিত ‘এখনই সময়’ (Now or Never) নামে দুটি প্রচার পুস্তিকায় তিনি জাতীয় মর্যাদা সম্পন্ন এক পৃথক নতুন রাষ্ট্রের দাবি করেন এবং এর নামকরণ করেন পাকিস্তান (পাঞ্জাব, আফগান প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান)।

লাহোর প্রস্তাব ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর যে জোর দেওয়া হয় তা বাতিল করে দেয়। প্রস্তাবে এটা দাবি করা হয় যে, ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মতো যে সব অঞ্চলে মুসলিমগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সে অঞ্চলসমূহ স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চল একত্রে শ্রেণীভুক্ত হওয়া উচিত এবং শ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রগুলি হবে স্ব-শাসিত ও সার্বভৌম। লাহোর প্রস্তাবের মধ্যে বাংলার মুসলিমগণ তাদের পরিচয় খুঁজে পায়। এ অর্থে যে, তারা আর একটি সম্প্রদায় নয়, বরং নির্দিষ্ট ভূ-খন্ডসহ একটি জাতি। এভাবে লাহোর প্রস্তাব বাংলার মুসলিমদের মনে জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয় এবং তখন থেকে তারা হিন্দুদের অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করে সরাসরি পৃথক রাজনৈতিক অস্তিত্বের দাবি তোলে।

হিন্দুদের প্রচার মাধ্যম লাহোর প্রস্তাবকে ‘পাকিস্তান দাবি’ রূপে আখ্যা দেয়। ১৯৪০ সালের প্রস্তাবে কোথাও পাকিস্তানের উল্লেখ নেই এবং ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’সমূহের দাবিতে লীগের মুখপাত্রদের কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। হিন্দু প্রচারণা মুসলিম নেতৃবৃন্দকে বাস্তব স্লোগান সরবরাহ করে যা তাদেরকে অনতিবিলম্বেই একটি রাষ্ট্রের ধারণা দেয়। লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা এবং এর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য মুসলিমদেরকে বোঝাতে মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনেক সময় লেগেছিল। এ ক্ষেত্রে হিন্দু প্রচারণা তাদের সহায় হয় এবং তাদের বহু বছরের শ্রম কমিয়ে দেয়। হিন্দু পত্র-পত্রিকা এটিকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ বলে চিত্রিত করায় এর সার্বিক গুরুত্ব স্বল্প সময়ে মুসলিম জনসাধারণের নিকট ব্যাপকভাবে প্রতিভাত হয়। পাকিস্তান দাবির উপর গুরুত্ব আরোপ করে হিন্দু প্রচারণাসমূহ শব্দবহুল শব্দে ও অস্পষ্টভাবে বর্ণিত জিন্নাহর ফর্মুলাকে জনদাবিতে রূপান্তর করতে সক্ষম হয়।

১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিলের মাদ্রাজ অধিবেশনে তথাকথিত ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’কে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের শাসনতন্ত্রে মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এর বিগঠন না হওয়া পর্যন্ত এটি লীগের নীতি হিসেবে অব্যাহত ছিল। বাস্তবিক পক্ষে ১৯৪০ সাল থেকে ভারত উপ-মহাদেশের স্বাধীনতার বিতর্কে পাকিস্তান প্রশ্নটি একটি প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল।

পাকিস্তান দাবি ভারতের মুসলিমদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এর পিছনে অনেক সুস্পষ্ট কারণ ছিল। বাংলা ও পাঞ্জাবের কৃষকদের নিকট ‘পাকিস্তান’কে হিন্দু জমিদার ও মুৎসুদ্দির শোষণের অবসান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ১৯৪৩ সালের নভেম্বর থেকে বেঙ্গল মুসলিম লীগের সচিব আবুল হাশেম ১৯৪৪ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে জমিদারি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করে স্বীয় দলের প্রগতিশীল ভাবমূর্তি তুলে ধরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল যে, প্রস্তাবিত পাকিস্তান ভারতের অংশ বিশেষকে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীদের প্রভাব বলয় থেকে পৃথক করবে বলে অঙ্গীকার করে। এতে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ এবং নতুন গড়ে উঠা মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ চাকরি গ্রহণ করতে পারবে। তুলনামূলকভাবে বড় মুসলিম পুঁজিপতিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ১৯৪৭ সালের পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে বড় ধরনের কোন শিল্পকারখানা ছিল না বললেই চলে। অবশ্য এতদ্অঞ্চলে উন্নত কৃষি ব্যবস্থার সাথে জড়িত ক্ষুদ্র মাপের কিছু উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটে। প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বড় পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতার কবল থেকে রক্ষা করে পাকিস্তান এ সকল লোকের জন্য আর্থিক সুবিধাদি লাভের ব্যবস্থা করে দেয়।

বাংলা এবং পাঞ্জাবের হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায় লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক পাকিস্তান এলাকা থেকে হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা ও পাঞ্জাবের অংশ পৃথক করার শর্তে ভারত উপ-মহাদেশ পৃথককরণ নীতিকে বেশি পছন্দ করে। তাদের অভিপ্রায় অনুসারে এ অংশদ্বয় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের সাথে সংযুক্ত হওয়া উচিত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভবনায় এ সাম্প্রদায়িক শ্রেণিসমূহ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই পরবর্তীকালে পাকিস্তান রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অবশেষে ব্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়।  [মোহাম্মদ শাহ]