খ্রিস্টান মিশনারি

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:৫৬, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

খ্রিস্টান মিশনারি  খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের কাজে নিয়োজিত সংগঠন। প্রধানত প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রিস্টান মিশনারি উপনিবেশিক আমলে বাংলায় সক্রিয় থাকলেও তাঁদের সংযোগ স্থাপন শুরু হয় ষোলো শতকে। কথিত আছে যে, সেইন্ট টমাস ছিলেন প্রথম খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক যিনি ৫০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন এবং ৫৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মালাবার উপকূলে একদল লোককে খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। তখন থেকে সিরীয়, রোমান ক্যাথলিক ও বিশেষত জেসুইট সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রচারকগণ নানা সময় ভারত সফর করেন। কিন্তু খ্রিস্ট ধর্ম দক্ষিণ ভারতের উপকূলবর্তী এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে।

জেসুইট সম্প্রদায়ের প্রচারকদের মাধ্যমে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক দলের সাথে বাংলার সংযোগ স্থাপিত হয়; ১৫৭৬ সালে ফাদার অ্যান্টোনী ভাজ ও ফাদার পিটার ডায়াস এবং ১৫৮০ সালে রোমান ক্যাথলিক যাজকদের আগমন ঘটে। ওলন্দাজদের দ্বারা স্থাপিত শহর ব্যান্ডেল তাঁদের কর্মক্ষেত্রে পরিণত হয়। প্রারম্ভে জেসুইট ও রোমান ক্যাথলিকবৃন্দ একত্রে কাজ করেছেন এবং ১৫৯৯ সালে একটি গির্জা ও একটি মঠ স্থাপন করেন। ধর্ম শিক্ষার জন্য একটি কনভেন্ট স্কুল ও সেইন্ট পলের জেসুইট কলেজও প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬২২ সালে সেইন্ট পল কলেজের রেক্টর হিসেবে ফাদার পিটার গোমেজের নিয়োগের মধ্য দিয়ে ধর্মসংক্রান্ত শিক্ষা কার্যক্রম পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়। বি. রড্রিকস্, জেমস গোমেজ, সাইমন দি ফিগুরেডো ও আন্দ্রে ম্যাশাডো এটিকে শিক্ষাদান ও খ্রিস্টান ধর্মের সুসমাচার পৌঁছানোর একটি মহতী কেন্দ্রে পরিণত করেন। এক দশকের মধ্যে দশ হাজারের মতো ব্যক্তিকে ধর্মান্তরিত করা হয় বলে দাবি করা হয়।

১৬৩৩ সালে  শাহজাহানের এক  ফরমান এর মাধ্যমে গির্জার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু বিশেষ সুবিধাসহ ৭৭৭ বিঘা নিষ্কর জমি দান করা হয়। উনিশ শতকব্যাপী ব্যান্ডেল গির্জা শিক্ষাসংক্রান্ত ধর্মপ্রচার চালিয়ে যেতে থাকে, যদিও কোম্পানির সরকার ১৭৯৭ সালে ফরমানটি বাতিল করে। ১৯২৮ সালে ব্যান্ডেল গির্জাকে ডন বস্কোর সেইন্ট ফ্রান্সিস দি স্যালেসের অনুগামী রোমান ক্যাথলিক দলের নিকট ন্যস্ত করা হয়। উপনিবেশিক আমল ও তারও পরবর্তী সময়ে এটা বাংলার বিভিন্ন অংশে ডন বস্কো স্কুলের বিভিন্ন শাখা, অক্সিলিয়াম কনভেন্ট ও সেইন্ট পল’স স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু বাংলায় ব্রিটিশ (প্রোটেস্ট্যান্ট) ক্ষমতার আর্বিভাবের সাথে সাথে রোমান ক্যাথলিক ধর্মপ্রচার কাজ অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকগণ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকেন।

আঠারো শতকের শেষ দশকে ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের আগমনের সাথে সাথে বাংলায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার কাজ একটি সংগঠিত আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। সমসাময়িক ইংল্যান্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের পুনরুজ্জীবনের ফলে সকল দেশে খ্রিস্টের বাণী প্রচারের জন্য বেশ কয়েকটি ধর্মপ্রচারক সমিতি গঠিত হয়। এগুলির মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো ১৭৯২, ১৭৯৫ ও ১৭৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত যথাক্রমে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি ও চার্চ মিশনারি সোসাইটি। প্রথম দুটি ছিল নন্-কনফ্র্মিস্ট সংগঠন ও তৃতীয়টি ছিল অ্যাংলিকান (ইংল্যান্ডের সরকার কর্তৃক অনুমোদিত গির্জার প্রতিনিধিত্বকারী)। এর কয়েক দশক পর ১৮৩০ সালে আলেকজান্ডার  ডাফ (১৮০৮-১৮৭৮)-এর অধীনে স্কটল্যান্ডের গির্জা বাংলায় ধর্মপ্রচার কাজ শুরু করে। কিন্তু এ সকল গির্জা বাংলায় ধর্মপ্রচার কাজ চালানোর ক্ষেত্রে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হয়। ১৮৩১ সালে আন্তঃসম্প্রদায়গত ক্যালকাটা মিশনারি কনফারেন্স গঠন এ ধরনের সম্প্রদায়গত মননের উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ ইংল্যান্ডের প্রথম দিকের প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণা অনুসরণ করেছিলেন এবং ধর্মপ্রচার কার্যক্রমে ‘সামাজিক দিকসমূহের’ প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। স্কটিশ ধর্মপ্রচারকগণ ও আইরিশদের গির্জার যাজকীয় শাসনতন্ত্রের সমর্থকবৃন্দও এ কার্যক্রম অনুসরণ করেছিলেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা উনিশ শতককে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের বিশিষ্টতম শতকে রূপান্তরিত করে। এ শতক ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণেরও এক গুরুত্বপূর্ণ কাল বলে বিবেচিত। ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে পশ্চিমা বাণিজ্য ও সংস্কৃতি প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। এ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ বিদেশে ধর্মপ্রচার কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। জার্মানি, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক ইত্যাদি রাষ্ট্রসমূহ ধর্মপ্রচার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করে।

শুধু ব্রিটিশ প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকগণই অত্যুৎসাহী হয়ে ধর্মপ্রচারে প্রবল আগ্রহ প্রদর্শন করেন। ব্রিটিশ ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলা তাঁদের কার্যাবলির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। যাহোক, ব্রিটিশ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম দিকে তাঁদের সংগঠিত কাজের বিরোধিতা করে। ১৮০০ সালে যাজক উইলিয়ম কেরীর বাংলায় আগমনের পর তাঁর অধীনে বাংলায় প্রথম সংগঠিত ধর্মপ্রচার কাজ শুরু হয়। ওই বছর শ্রীরামপুরে (সে সময়ে ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে) কেরী প্রথম ব্যাপ্টিস্ট মিশন আরম্ভ করেন। তাঁর দুজন সহযোগী ছিলেন জোশুয়া মার্শম্যান (১৭৬৮-১৮৩৭) ও উইলিয়ম ওয়ার্ড (১৭৬৯-১৮২৩) এবং তাঁরা বিখ্যাত শ্রীরামপুর ত্রয়ীর সদস্য ছিলেন। লন্ডন মিশনারি সোসাইটিও ওলন্দাজদের শহর চুঁচুড়ায় ১৭৯৮ সালে ন্যাথানিয়েল ফোরসিথের অধীনে ধর্মপ্রচার কাজ শুরু করেন। কোম্পানির ১৮১৩ সালের সনদের মাধ্যমে ভারতে ধর্মপ্রচারকদের উদ্যোগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর চার্চ মিশনারি সোসাইটি ভারতে প্রবেশ করে; এদের প্রথম ধর্মপ্রচারকদ্বয় গ্রীনউড ও স্ক্রোয়েটার ১৮১৬ সালে কলকাতায় এসে পৌঁছান।

খ্রিস্টান ধর্ম ও উপমহাদেশের ধর্মসমূহের মধ্যকার সাংস্কৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ ইসলামের অনুসারীদের প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হন। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী হিসেবে মুসলমানগণ খ্রিস্টান ধর্মের ‘ত্রিত্ববাদী’ মতবাদকে গ্রহণ করতে পারেনি। শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি প্রেস থেকে ১৮০৯ সালে প্রচারিত একটি প্রচার পত্রে নবী মুহম্মদ (স.) সম্পর্কে কতিপয় প্রতিকূল মন্তব্য করা হলে তা মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। শ্রীরামপুর ত্রয়ী এ প্রকাশনাটিকে একটি অবিবেচনাপ্রসূত কাজ বলে রায় দেয় এবং এরপর আর কখনও এরকম কিছু প্রকাশ করেনি যা মুসলমানদের মনে আঘাত হানতে পারে। এখন থেকে মুসলমানদের মাঝে ধর্ম প্রচারের ব্যাপারে যাজকগণ অধিক সতর্কতা অবলম্বন করেন। সাধারণভাবে মুসলমান সমাজ খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রচেষ্টার আওতার বাইরে থেকে যায় এবং মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামীণ পূর্ব বঙ্গে অতি অল্প কয়েকটি ধর্মপ্রচার কেন্দ্র গড়ে ওঠেছিল।

বাংলায় প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের কর্মকান্ডকে মোটামুটি তিনটি সময়কালে ভাগ করা যায়: ১৭৯৩-১৮৩৪ এবং ১৮৩৪-১৮৫৭, এ দুটি যুগ যথাক্রমে কেরী ও ডাফের যুগ বলে পরিচিত, এবং সবশেষে ১৮৫৭ সাল থেকে শতকের সমাপ্তি পর্যন্ত।

প্রথম পর্যাঙেঅর্থাৎ কেরীর আমলে- প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রস্ত্ততিমূলক কাজ হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে দেশিয় ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতিসাধন এবং শিক্ষা বিস্তারের ওপর। শ্রীরামপুর ত্রয়ী কিছু হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আচারানুষ্ঠান, যেমন  জাতিভেদ প্রথ, সতী, শিশুহত্যা, অন্তর্জলি (রুগ্ন ব্যক্তিদের নদীর তীরে অনাবৃত অবস্থায় ফেলে রাখা), ইত্যাদি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ১৮০৪ থেকে ১৮২৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এ রকম কিছু আচারকে নিষিদ্ধ করতে আইন পাসে তাঁরা সহায়ক ছিলেন।

তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, শুধু খ্রিস্টানদের সত্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিক্ষাই এ সামাজিক ব্যাধিসমূহ দূর করতে পারে। প্রাথমিকভাবে মাতৃভাষার প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও শ্রীরামপুর ত্রয়ী গ্রাম্য পাঠশালার ওপর ভিত্তি করে বিরাজমান শিক্ষা ব্যবস্থায় খ্রিস্টান ধারণাসমূহ অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ জনগণের নিকট শিক্ষা পৌঁছে দিতে ‘সর্দার-পড়ো’র মতো দেশিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে কেরী জনগণের শিক্ষার একটি কার্যক্রম গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ১৮৩০-এর দশকে ইংরেজদের দ্বারা প্রচলিত রীতি হিসেবে চালু করা শিক্ষার ব্যাপারে ‘নিম্ন দিকে চোয়ানো তত্ত্বে’ (downward filtration theory) উইলিয়ম কেরীর কোনো আস্থা ছিল না এবং তিনি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিম্ন দিক থেকে গড়ে উপরের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। এ উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর সহযোগী জে. মার্শম্যান ১৮১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে মাতৃভাষা শিক্ষাদানকারী স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ‘স্থানীয় স্কুল সম্বন্ধে আভাস’ নামে পরিচিত একটি সম্পূর্ণ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেন। এতে জোর দেওয়া হয় যে, শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত জনগণের মাতৃভাষা। গ্রামের স্কুলসমূহের উচিত পাটিগণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ইতিহাস ও ভূগোলের মোটামুটি প্রধান অংশসমূহ, প্রাকৃতিক দর্শন, ধর্মশাস্ত্র ও নীতিশাস্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে ‘উন্নত’ পাঠক্রম অনুসরণ করা। এ কর্মপরিকল্পনা আপাতভাবে সাফল্যমন্ডিত হয়; ১৮১৮ সাল নাগাদ ৬,৭০৩ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ১০৩টি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ব্যাপ্টিস্টদের ‘নন্-কন্ফর্মিস্ট নীতি-বোধ’ প্রারম্ভে তাঁদেরকে কোনোপ্রকার রাষ্ট্রীয় সাহায্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে। আরেকটি ভিন্নমত পোষণকারী অঙ্গ-সংগঠন, লন্ডন মিশনারি সোসাইটি, ১৮১৪ সালে চুঁচুড়ায় রবার্ট মে’র অধীনে এর সমশ্রেণীর গ্রাম্য প্রাথমিক স্কুলসমূহের প্রথমটি স্থাপন করে। ১৮১৮ সালে এতে অন্তর্ভুক্ত ছিল ২,৬৯৫ জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ৩৬টি প্রাথমিক স্কুল।

একজন সত্যিকার ‘খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ’ হিসেবে কেরী তাঁর শিক্ষা পরিকল্পনায় সনাতন ও মাতৃভাষা সংক্রান্ত ধারণাসমূহকে সংযুক্ত করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ এর (১৮০০) অধ্যাপক এবং  এশিয়াটিক সোসাইটির (১৮০৬) সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে তিনি প্রাচ্যদেশীয় সনাতন বিদ্যাসমূহের অধ্যয়নকে উৎসাহিত করেছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ভারত ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপনের পথ সহজ করে তোলার জন্য বাইবেলকে সংস্কৃতি ও ফারসি ভাষায় অনুবাদ করা উচিত। যদিও মুখ্যত তিনি মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার একজন সমর্থক, তবু কেরী উচ্চ শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করেননি। ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্ট পাসের পর ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনি সরকারি অনুদানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার প্রণীত ভারতের দেশিয় অধিবাসীদের ইউরোপীয় বিজ্ঞান শিক্ষাদানের পরিকল্পনাকে (জুন, ১৮১৪) ভারতে প্রথম সর্বাত্মক শিক্ষাদানের প্রোগ্রাম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর ত্রয়ী এশীয় যুবাদের প্রাচ্যদেশীয় সাহিত্য ও ইউরোপীয় বিজ্ঞান সম্পর্কে পূর্ণ শিক্ষা দান করতে শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এর চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়দের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে তাঁরা খ্রিস্টানধর্ম শিক্ষা প্রদানে ধর্মপ্রচারক ও শিক্ষক হিসেবে ইউরোপীয়দের স্থান দখল করে নিতে পারে।

শ্রীরামপুর মিশন মুদ্রণ ও প্রকাশনা ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ ছিল। কেরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ। তাঁর নির্দেশনায়  শ্রীরামপুর মিশন প্রেস পূর্ণাঙ্গ বাইবেলের বাংলা, অহমীয়, উড়িয়া, হিন্দি, মারাঠি ও সংস্কৃত অনুবাদ ছাপায়। বাইবেলের অনুবাদ ছাড়াও ব্যাপ্টিস্টগণ ও তাঁদের ভারতীয় সহযোগীবৃন্দ (যেমন, রামরাম বসু ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার) রামায়ণ ও অন্যান্য ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের অংশ বিশেষ অনুবাদ করেন। তাঁরা বহুসংখ্যক গবেষণামূলক প্রবন্ধ অথবা প্রচারণমূলক পুস্তিকা (১৮২৯ সাল নাগাদ প্রায় ৩৩,০৫০টি) অনুবাদ, মুদ্রণ ও বিতরণ করেন। এ দৃষ্টান্ত কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটিকে (১৮১৭) ১৮২১ সাল নাগাদ বাংলায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করতে অনুপ্রাণিত করে। এ প্রকাশনাসমূহ সন্দেহাতীতভাবে বাংলা গদ্য সাহিত্যের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

শ্রীরামপুর থেকে অন্যান্য বাংলা প্রকাশনাসমূহের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল কেরীর কথোপকথন যা বাংলার সমকালীন সামাজিক জীবনকে প্রতিফলিত করে। ব্রিটিশ ব্যাপ্টিস্ট শিক্ষাবিদ জন ম্যাকের প্রিন্সিপল্স অব কেমিস্ট্রি (১৮২৪ সালে প্রকাশিত) রাসায়নিক শব্দাবলি ও চিন্তাধারা বাংলায় উপস্থাপিত করে। উইলিয়ম ওয়ার্ডের একাউন্ট অব দি রাইটিংস, রিলিজিয়ন অ্যান্ড ম্যানার্স অব দি হিন্দুস (১৮১১ সালে প্রকাশিত) হিন্দুদের বিশ্বাসসমূহ ও সমাজ সম্পর্কে ব্যাপ্টিস্টদের কৌতূহলের ইঙ্গিত দেয়।

শ্রীরামপুরের ধর্মপ্রচারকগণ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ ছিলেন। জে. সি. মার্শম্যানের দিগদর্শন, ম্যাগাজিন ফর ইন্ডিয়ান ইয়ুথ (ইংরেজি ও বাংলায়), সমাচার দর্পণ (১৮১৮ সালে প্রকাশিত) ও দি ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া (ঐ একই সালে প্রকাশিত) কতিপয় সমকালীন সামাজিক সমস্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে মিশনারি সোসাইটিসমূহ ব্যাপক বিন্যস্ত তথ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সম্প্রদায়গত সাময়িকীসমূহ প্রকাশ করা শুরু করে। দি ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান ইন্টেলিজেন্সার (চার্চ মিশনারি সোসাইটি সমিতি, ১৮৪০-১৮৬৫), দি ক্রিশ্চিয়ান স্পেক্টেটর, অরিয়েন্টাল ব্যাপ্টিস্ট ও মিশনারি হেরাল্ড (ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটি, ১৮৫৬-১৯১০) ছিল সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। প্রথম আন্তঃসম্প্রদায়গত সাময়িকী দি ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারভার  ক্যালকাটা মিশনারি কনফারেন্স-এর মতপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হয়। এটিকে অনুসরণ করে ইভ্যানজেলিক্যাল রিভিউ প্রকাশিত হয়। এটি ১৮৭৩ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। এ সমায়িকীসমূহের অধিকাংশই বঙ্গীয় সমাজের কিছু সমকালীন সমস্যাকে প্রতিফলিত করে এবং এগুলি প্রতিকারের জন্য পরামর্শ দেয়।

বিশিষ্ট স্কটিশ ধর্মপ্রচারক আলেকজান্ডার ডাফ (১৮০৬-১৮৭৮) এর কলকাতা আগমনের (মে, ১৮৩০) সাথে সাথে ধর্ম প্রচারের কাজে ‘অ্যাংলিক্যানিজম’ (ইংল্যান্ডে সরকার অনুমোদিত গির্জার রীতিনীতি) ‘অরিয়েন্টালিজম্’কে কোণঠাসা করে ফেলে। ইংরেজ জাতির সত্যিকারের উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে ১৮৩০ সালের ১৩ জুলাই তারিখে স্কটিশ চার্চ কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি বাঙালি যুবকদের পাশ্চাত্য জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণের সুযোগ সৃষ্টি করেন। ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষাদানকারী এ স্কুলটি (পরবর্তীকালে এটিকে কলেজে রূপান্তরিত করা হয়) যথার্থই খ্রিস্টান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করছিল। ডাফের বিশ্বাসমতে কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলেরা সাধারণ জনতার নিকট খ্রিস্টান জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে। ডাফের কলেজটি ‘উচ্চ বর্ণের’ হিন্দু যুবকদের ধর্মান্তরিত করার কাজে প্রধান মাধ্যমে পরিণত হয়।

ডাফ তিনটি পর্যায়ে ১৮৩০-৩৪, ১৮৪০-৪৯ ও ১৮৫৬-৬৩ কলকাতায় অবস্থান করেন। তাঁর শিক্ষাদান কার্যক্রম প্ররোচনায় গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে ১৮৩২ থেকে ১৮৪৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে কলকাতার একদল যুবক (মহেশ চন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণ মোহন ব্যানার্জী ও লাল বিহারী দে তাঁদের মধ্যে অধিক প্রসিদ্ধ) খ্রিস্টান হন। এ ধর্মান্তরকরণ কলকাতার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ডাফের প্রচেষ্টাকে  রামমোহন রায় উষ্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন, কিন্তু ধর্মান্তরকরণের পদ্ধতি  ব্রাহ্ম সমাজকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। উনিশ শতকব্যাপী এ প্রশ্নে দুদলের মধ্যে বিতর্ক চলতে থাকে। ইংরেজি শিক্ষা ক্ষেত্রে ধর্মপ্রচারকদের সাফল্য ছিল সীমিত। উড-এর শিক্ষা প্রস্তাব (১৮৫৪) বেসরকারি স্কুলসমূহের জন্য সরকারি অনুদান প্রবর্তন করার পর (১৮৫৫) বাংলা ভাষায় পরিচালিত স্কুলসমূহ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ধর্মপ্রচারকগণ সেগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। এ স্কুলগুলি মিশনারি স্কুলসমূহকে ইংরেজি শিক্ষা ক্ষেত্র থেকে প্রায় হটিয়ে দেয়। শেষোক্ত স্কুলগুলি সরকারি সাহায্য প্রাপ্তির ব্যাপারে প্রায়শ যোগ্য না হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্র থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। গির্জা ধর্মপ্রচারক সমিতি কর্তৃক পরিচালিত ক্যাথেড্রাল মিশন কলেজও (১৮৬৫ সালে স্থাপিত) প্রেসিডেন্সি কলেজ (১৮৫৫ সালে স্থাপিত) এবং মেট্রোপলিটান ও সিটি কলেজসমূহের (উভয়টিকেই ১৮৭৯ সালে ডিগ্রি কলেজ হিসেবে অধিভুক্তি দেওয়া হয়) সাথে প্রতিযোগিতা চালাতে ব্যর্থ হয়। ১৮৮০ সালে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এখন থেকে ধর্মপ্রচারকগণ সাধারণ জনগণের শিক্ষাকে অগ্রগতির পথে নিয়ে যেতে অধিক মনোনিবেশ করেন এবং ক্যালকাটা মিশনারি কনফারেন্সের মাধ্যমে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে শুরু করেন। এ কনফারেন্সের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব রেভারেন্ড জেমস  লং উচ্চতর শিক্ষাকে কিছুটা অবহেলা করেও গণশিক্ষাকে সম্মুখপানে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। এ কর্মপরিকল্পনাসমূহে মাঝে-মধ্যে বাংলার সাধারণ জনতার কল্যাণের জন্য ধর্মপ্রচারকদের আন্তরিক উদ্বেগ প্রকাশ পেত, যা প্রায়শ সরকারি নীতিকে প্রভাবিত করত। সাধারণ জনতার গণশিক্ষার প্রসারের জন্য হান্টার কমিশন এর (১৮৮৫) সুপারিশমালাকে ক্যালকাটা মিশনারি কন্ফারেন্স তাদের প্রচেষ্টার পরম বিজয় বলে গণ্য করে।

ক্যালকাটা মিশনারি কন্ফারেন্স বাংলার কৃষকদের পক্ষও সমর্থন করেছিল। বাংলার গ্রামের বাস্তব অবস্থার সাথে তাদের সংযোগ তাঁদেরকে উপনিবেশিক ভূমি রাজস্ব নীতি ও বিচার ব্যবস্থার অনিয়ম সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। বাংলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সংস্কারের অনুকূলে কন্ফারেন্স ইংল্যান্ড ও ভারতে জনমত গড়ে তুলতে চেয়েছিল। বাংলায় কর্মরত প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মপ্রচারকদের প্রথম সাধারণ সম্মেলন অনুষ্ঠানের (কলকাতা, ৪-৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৫) মধ্য দিয়ে তাঁদের প্রচেষ্টা শুরু হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং ভারত ও বাংলা সরকারের নিকট বেশ কয়েকটি আবেদনপত্রে (১৮৫২-১৮৫৯) ক্যালকাটা মিশনারি কন্ফারেন্স এ ব্যবস্থাটির প্রতিকারের জন্য অন্যান্য পরামর্শের পাশাপাশি বাংলায় ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনের পক্ষে ওকালতি করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, একটি ‘উদারবাদী খ্রিস্টীয়’ ইউরোপীয় সম্প্রদায় ভূমি ব্যবস্থার অপব্যবহার দূর করতে সমর্থ হবে। কিন্তু ১৮৫৯-৬০ সালের নীল চাষ প্রতিরোধ আন্দোলন চলাকালে এরূপ সম্প্রদায়ের ‘আশীর্বাদ’ সম্পর্কে তাঁদের পুরোপুরি মোহমুক্তি ঘটে। নীল সঙ্কটের পর বাংলায় কর্মরত ধর্মপ্রচারকগণ বিশ্বাস করেন যে, কেবল ‘বিচক্ষণ খ্রিস্টান শিক্ষা’ কৃষকদের দুর্দশা থেকে রক্ষা করতে পারে। সাধারণ গণশিক্ষার ওপর তারা ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ক্রিশ্চিয়ান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির (১৮৫৮ সালে লন্ডন প্রতিষ্ঠিত) বেঙ্গল কমিটির উদ্যোগে গৃহীত সাধারণ গণশিক্ষা কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়া পর্যন্ত, যেটি ধর্মপ্রাচারকদের বিশ্বাসমতে ভূমি ব্যবস্থার অনেকগুলি অনিয়মকে দূর করেছে, ক্যালকাটা মিশনারি কন্ফারেন্স কৃষকদের সমর্থক ছিল। এরপর থেকে বাংলায় কর্মরত ধর্মপ্রচারকগণ ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি’ পরিত্যাগ করেন।

খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণই ছিলেন প্রথম উদ্যোক্তা যারা ক্যালকাটা মিশনারি কন্ফারেন্সে নারী ধর্মপ্রচারকদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে লিঙ্গ ভেদাভেদকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। ১৮৭৭ সালে পুরুষের সমমর্যাদা ও অধিকার সহকারে নারী ধর্মপ্রচারকদের পূর্ণ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এরূপ আন্তঃসম্প্রদায়গত ধর্মপ্রচারকদের কন্ফারেন্স ১৮৪৫ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বোম্বে, মাদ্রাজ ও ব্যাঙ্গালোরে গঠন করা হয়, যেখানে নারীদের কন্ফারেন্সে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও তাদেরকে বক্তব্য রাখতে অথবা ভোট দিতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। ক্যালকাটা মিশনারি কন্ফারেন্সে নারী ধর্মপ্রচারকদের অন্তর্ভুক্তি ভারতীয় নারীদের শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদার কিছু কিছু লিঙ্গগত বিচার্য বিষয়াবলি সম্মুখে নিয়ে আসে।

১৭৯৬ সালের দিকেই বাংলায় কেরী এ বিচার্য বিষয়াবলিতে নারী ধর্মপ্রচারকদের সম্পৃক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ভারতীয় নারীদের পদমর্যাদা-হানিকর অবস্থা বিবেচনা করে ১৮২০ সালে উইলিয়ম ওয়ার্ড ইংরেজ নারীদের নিকট ধর্মপ্রচার কাজে যোগদানের আবেদন জানান। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রথম নারী ধর্মপ্রচারক মিস মেরী অ্যান কুক ১৮২২ সালে কলকাতা পৌঁছান। তবে মেয়েদের জন্য প্রথম মিশন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন রবার্ট মে (লন্ডন মিশনারি সোসাইটির) ১৮১৮ সালে চুঁচুড়ায়। ১৮২৩ সাল নাগাদ ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি সোসাইটির সাহায্য নিয়ে মিস কুক (পরবর্তীকালে মিসেস উইলসন) কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় ৩০০ ছাত্রী নিয়ে ১৫টি স্কুল স্থাপন করেন। এ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত স্কুলগুলির তদারকি করা কঠিন কাজ অনুভব করে তিনি স্থানীয় স্কুলগুলিকে একত্রিত করে ১৮২৮ সালে কলকাতায় ‘কেন্দ্রীয় স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। নবগঠিত ইউরোপীয় মহিলাদের প্রতিষ্ঠান লেডিস সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন (১৮২৪ সালে), যার সভানেত্রী ছিলেন গভর্নর জেনারেলের স্ত্রী লেডী আমহার্স্ট, তাঁকে এর ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। ব্যাপ্টিস্টরা কলকাতায় (১৮২৯ সালে) এবং ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি সোসাইটি বর্ধমানে (১৮৩২ সালে) এ ধরনের কেন্দ্রীয় স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ১৮২৩ থেকে ১৮৩৩ সালের মধ্যবর্তী দশকে ধর্মপ্রচারকগণ বাংলায় তাঁদের বিভিন্ন ধর্মপ্রচার আবাসস্থলে (যেমন কাটোয়া, সুরি, বহরমপুর, চুঁচুড়া, বর্ধমান, কালনা, বাঁকুড়া, কৃষ্ণনগর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ইত্যাদি) এ রকম আরও কয়েকটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মপ্রচারকদের স্ত্রীগণ সাধারণত তাঁদের নিজ নিজ ধর্মপ্রচার আবাসস্থলে এ স্কুলগুলির দায়িত্বভারও গ্রহণ করেন। এখানকার পাঠক্রম ছেলেদের স্কুলের পাঠক্রমের অনুরূপ ছিল। মেয়েদের দিকে স্কুলসমূহের সাফল্য নগন্য হওয়ায় ধর্মপ্রচারকগণ বোর্ডিং স্কুলের ওপর অধিক মনোযোগ দেওয়া শুরু করেন। প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এ স্কুলসমূহে অধিক ছাত্রী নিয়ে আসে। এ নিঃস্ব মেয়েদেরকে আশ্রয় ও খাদ্য প্রদান করা হত। সময় যত অতিবাহিত হতে থাকে এ স্কুলগুলি তত বেশি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিতকরণে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে থাকে।

১৮৫৫ সালের পর বাঙালিদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বালিকা বিদ্যালয়গুলি মিশন স্কুলসমূহের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয়। ১৮৮২ সালের ভারতীয় শিক্ষা কমিশন (হান্টার কমিশন) রিপোর্ট প্রদান করে যে, সমগ্র ভারতব্যাপী মেয়েদের ৭,০০০ মিশনারি স্কুলে যে ছাত্রীরা পড়াশোনা করে তাদের অধিকাংশই খ্রিস্টান। বোর্ডিং স্কুলগুলি শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান নারীদের শিক্ষার ‘নার্সারি’তে পরিণত হয়।

একই সাথে ধর্মপ্রচারকগণ ‘জেনানা ব্যবস্থায়’ (এ ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মপ্রচারকদের স্ত্রীগণ অপরের গৃহে গিয়ে শিক্ষা প্রদান করতেন) মনোনিবেশ করেন। উনিশ শতকে প্রথম দিকে প্রবর্তিত এ ব্যবস্থাটির কথা ১৮৫৪ সালের শিক্ষা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সাফল্যের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে ১৮৮২ সালের শিক্ষা কমিশন এ ব্যবস্থাটি চালু রাখতে বিশেষ অনুদানের সুপারিশ করে। কয়েকটি নেতৃস্থানীয় ব্রাহ্ম ও হিন্দু পরিবার (যেমন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মনোমোহন ঘোষকেশবচন্দ্র সেন এর পরিবার) এ ব্যবস্থাটিকে উৎসাহিত করেছিলেন। কারণ তাঁরা চাইতেন যে, তাঁদের পরিবারের নারী সদস্যরাও শিক্ষিত হোক। ১৮৭১ সালে অন্য প্রেসিডেন্সিসমূহ একত্রিত করলে যা হয়, বাংলায় তার চেয়েও অধিক ‘জেনানা’ শিক্ষার্থী ছিল।

১৮৬৬ ও ১৮৭২ সালে একেশ্বরবাদী নারী শিক্ষাবিদ যথাক্রমে মেরী  কার্পেন্টারঅ্যানেট সুসানা অ্যাক্রয়েড বেভারীজ এর কলকাতা এসে পৌঁছার সাথে সাথে ব্রাহ্ম/হিন্দু সংস্কারকগণ ও একেশ্বরবাদী খ্রিস্টানদের মধ্যে নারী শিক্ষা সম্পর্কে সহযোগিতার একটি পর্যায় শুরু হয়। তাঁদের উভয়েই ব্রাহ্ম নরমাল স্কুল ও হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। কিন্তু খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ নারী শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৩২ সালে ভারতের সাতটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের মধ্যে পাঁচটি ছিল খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠান এবং ১৫৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১০০ জনেরও অধিক ছিলেন খ্রিস্টান। উপনিবেশিক বাংলায় নারীদের আনুষ্ঠানিক ও পেশাগত শিক্ষা ক্ষেত্রে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ অবশ্যই পথিকৃৎ ছিলেন।

উনিশ শতকের বাংলায় খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকগণ উপজাতিদের প্রশ্নে একটি সমস্যামূলক বিষয়ে জড়িত হয়ে পড়েন। পূর্ব ভারতের সর্ববৃহৎ উপজাতি সাঁওতালদের ওপর তাঁদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বাংলার বহুত্ববাদী সমাজে উপজাতিদের ঐতিহ্যকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিবেচনা করে তাঁরা সাঁওতালদের দুর্বোধ্য জগতে প্রবেশ করেন এবং তাদের জীবন ও চিন্তাকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে চেষ্টা করেন। কতিপয় উপনিবেশিক আমলাকে বাদ দিলে ধর্মপ্রচারকগণই ‘উপজাতীয় গবেষণায়’ পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁরা এতে অমূল্য অবদান রাখেন। পি.ও বোডিংয়ের গবেষণাকর্ম এ সানতাল ডিক্সনারী (৫ খন্ডে, ১৯৩২-১৯৩৬ সালে প্রকাশিত) এবং এল.ও স্ক্রেফ্স্রাডের সাঁওতালি ও ইংরেজিতে প্রচুর পরিমাণ প্রমোদ-ভ্রমণ সংক্রান্ত বর্ণনা এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণায় বিশিষ্টতম স্থান দখল করে আছে।

ধর্মপ্রচারকগণ সাঁওতালদেরকে তাদের নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রদান করার পক্ষপাতী এবং খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা  দেওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে আগ্রহী ছিলেন। নর্দান চার্চের (প্রাক্তন ইন্ডিয়ান হোম মিশন) সাঁওতাল মিশন পরবর্তী সময়ে উপজাতিদের ধর্মান্তরিতকরণের সর্ববৃহৎ মিশনে পরিণত হয় এবং ভারতে ও বিদেশে অনেকটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চার্চ মিশন সোসাইটি এবং ব্যাপ্টিস্ট মিশন সোসাইটি ছিল এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সক্রিয় দুটি ধর্মপ্রচার সমিতি। চার্চ মিশন সোসাইটি ১৮৫৪ সালে এবং ব্যাপ্টিস্ট মিশন সোসাইটি ১৮৬৭ সালে কাজ শুরু করে। এর পূর্বে ১৮২৪ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত এ. লেসলি এবং ১৮২৬ টি. ক্রিশ্চিয়ানকে সালে সাঁওতালদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করতে পাঠানো হয়, কিন্তু এক বছরের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ানের মৃত্যু ঘটে এবং ‘জঙ্গল জ্বরে’ আক্রান্ত হয়ে লেসলিও তাঁর কর্মক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন। চার্চ মিশন সোসাইটির জার্মান ধর্মপ্রচারক ই. ডিরোয়েসে ১৮৫৪ সালে ধর্মপ্রচার কাজ শুরু করেন। এর অল্প কিছুকাল পর সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫ সালে সংঘটিত) চার্চ মিশনারি সোসাইটির সাঁওতাল মিশনে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করে। ‘শিক্ষার চরম অভাব’ ও ‘সাঁওতাল ধর্মীয় বিশ্বাসের অযৌক্তিকতা’ বিদ্রোহের জন্য দায়ী এ বিশ্বাস থেকে বাংলা সরকার সাঁওতালদের শিক্ষিত করে তুলতে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নে চার্চ মিশনারি সোসাইটিকে অনুরোধ করে এবং এ উদ্দেশ্যে আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে রাজি হয়। কলকাতাস্থ কমিটি কর্তৃক যে কর্মপরিকল্পনা দাখিল করা হয় তাতে আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষাসহ বৃত্তিগত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ভারত সরকার ১৮৫৬ সালে এ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে, কিন্তু ১৮৫৭ সালে  সিপাহি বিপ্লব শুরু হলে এর বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এ প্রারম্ভিক বাধায় হতোদ্যম না হয়ে চার্চ মিশনারি সোসাইটি ১৮৫৯ সালে ভাগলপুর মিশনের সাঁওতাল শাখা খোলে। ই. এল পাক্সলির অধীনে একটি স্বতন্ত্র একক হিসেবে সাঁওতাল মিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৮৫৬ সালে বাংলার কিছু এলাকাসহ নতুন সৃষ্ট সাঁওতাল পরগনার কিছু কিছু অংশে মিশনের কয়েকটি নতুন আবাসস্থল প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাঁওতাল মাঝিদের (প্রধান ব্যক্তি) সহযোগিতা নিয়ে পাক্সলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘সাঁওতালীকরণের’ প্রয়োজনীয়তার প্রতি জোর দিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সালে তিনি সাঁওতাল ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রোমান হরফে সাঁওতাল ভাষাকে একটি লিখিত আকৃতি প্রদান করেন। ১৮৬৬ সাল নাগাদ তিনি সাঁওতাল শব্দকোষ, সাঁওতাল অভিধান, বাইবেলের ইতিহাস, সেইন্ট ম্যাথিউর উপদেশাবলির অংশবিশেষ ও ইংল্যান্ডের সরকার অনুমোদিত গির্জায় ব্যবহূত প্রার্থনা পুস্তক রচনার কাজ সমাপ্ত করেন। পাক্সলির কার্যকলাপ ছিল সত্যিই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ১৮৬২ সালে ১০টি ‘অকেজো’ স্কুল নিয়ে শুরু করে ১৮৬৮ সালে তাঁর প্রত্যাবর্তনের সময় তিনি ৩৪৮ জন ছাত্র-ছাত্রীসহ ৩৬টি স্কুল রেখে যান। প্রশিক্ষণ স্কুলটি বিরাট সাফল্য বলে প্রমাণিত হয় এবং এটি ছিল ‘খ্রিস্টান ধর্মের দিকে চালিত করার’ একটি কেন্দ্র।

পাক্সলির সাফল্য ১৮৬৮ থেকে ১৮৭১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে একদল চার্চ মিশনারিকে (যেমন, জে. ব্রাউন, ই. টি কোল, এ. স্টার্ক, এইচ. ডেভিস ও এইচ. ডাব্লিউ শ্যাকেল) সাঁওতাল মিশনের প্রতি আকৃষ্ট করে। কলকাতা বাইবেল সোসাইটি কর্তৃক সাঁওতাল ভাষায় অধিকসংখ্যক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়। ধর্মপ্রচারকদের প্রচেষ্টা সাঁওতালদের মাঝে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে যেহেতু ধর্মপ্রচারকগণ তাদের মনে এ বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয় যে, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে শিক্ষাই হলো একমাত্র রক্ষাকবচ। ১৮৭১ থেকে ১৮৮১ সালব্যাপী খেরওয়ার আন্দোলনের (খেরওয়ার শব্দটি এসেছে ‘খায়ের’ শব্দ থেকে যার অর্থ ’মানুষ’। এটি ছিল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক পুনর্জাগরণের জন্য আন্দোলন) উদ্ভব ও অগ্রগতিও শিক্ষার প্রতি প্রবল উৎসাহের পেছনে ভূমিকা ছিল। একদল সাঁওতাল, যারা ইংরেজি শিক্ষার জন্য আগ্রহী ছিল, তারা এ জন্য খরচ চালাতে রাজি ছিল। সাঁওতাল পরগনাসমূহে ১৮৮০ সালে ৪০ জন সাঁওতাল ছাত্র-ছাত্রীকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করা হয়। সাঁওতাল মিশনে জর্জ ক্যাম্বেলের (১৮৭১ থেকে ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নর) গভীর আগ্রহ এবং সাঁওতালদের শিক্ষার প্রতি তাঁর বিশেষ অনুদান ধর্মপ্রচারকদের অনুপ্রাণিত করে। উনিশ শতকের শেষ নাগাদ সাঁওতালদের শিক্ষিত করে তোলার কাজ একচেটিয়াভাবে ধর্মপ্রচারক সমিতিগুলির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়।

খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের প্রধান উদ্দেশ্য, যা ছিল খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার মাধ্যমে বাংলার মানবগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করা, কখনও পূরণ হয়নি। বাস্তবিকপক্ষে, ধর্মপ্রচারকগণ নিজেরাই বাংলার মূল সমাজ থেকে বাইরে অবস্থান করছিলেন। ‘তাঁরা নিজেরা যেভাবে পরবাসী সম্প্রদায় হিসেবে মূলধারা থেকে বাইরে ছিলেন’, তদ্রূপ তাঁদের ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করত ‘জাতিচ্যুত ও উপজাতিদের’ ধর্মান্তরকরণের মাঝে। চার্চ ও ব্যাপ্টিস্ট মিশনসমূহের সর্বাধিক সংখ্যক ধর্মান্তরিতগণ আসত কর্তাভজাদের (ঈশ্বরের পূজারী) মধ্য থেকে, যারা ছিল ‘নিম্নতম’ পদমর্যাদার হিন্দু, যেমন চন্ডাল ও   নমঃশূদ্রদের মাঝে গড়ে ওঠতে থাকা একটি হিন্দু, সমতাবাদী ধর্মীয় সম্প্রদায়। কৃষ্ণনগর জেলায় চার্চ মিশনারি সোসাইটির আবাসস্থল) জলঙ্গি নদীর এক ব্যনার পর ১৮৩৮-৩৯ সালে প্রায় ৩,০০০ ‘কর্তাভজা’ স্বেচ্ছায় খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। ধর্মপ্রচারকদের নিকট থেকে বন্যার আক্রান্তদের ত্রাণকার্য সম্ভবত এ ‘বিরাট পরিবর্তন’কে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৮৪০-এর দশকে বরিশাল ও যশোহর (ব্যাপ্টিস্ট মিশনারি সোসাইটির আবাসস্থল) থেকে বৃহৎ সংখ্যক ‘কর্তাভজা’ও খ্রিস্টান হয়। উনিশ শতকে বাংলায় এটা ছিল খ্রিস্টান ধর্মের প্রতি সাধারণ জনতার পবির্তনের প্রথম ও সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা।

বিশ শতকে খ্রিস্টান গির্জাসমূহ কিছু নতুন ব্যবস্থা অবলম্বন করে যেগুলি ধর্মপ্রচারকাজে ’বিপ্লব’ বলে পরিগণিত হয়। সামাজিক কল্যাণ, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাগত ও চিকিৎসা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার ও শিক্ষাদানের পুরাতন পদ্ধতিসমূহকে প্রতিস্থাপিত করে। অ-খ্রিস্টান ধর্ম ও সংস্কৃতিসমূহের প্রতি অধিক যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নের সাথে সাথে তাঁরা এ নতুন ব্যবস্থাসমূহকে এ পৃথিবীতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য পূরণের ভিন্ন উপায় হিসেবে চিন্তা করতে শুরু করেন। ‘ধ্বংস সাধন নয়, বরং প্রতিপালন করা’  এ ঐশ্বরিক নির্দেশ তাঁদের অনেকের নীতিবাক্যে পরিণত হয়। ইউরোপ-কেন্দ্রিক অভিমত পরিত্যাগ করে তাঁরা আন্তর্জাতিক, আন্তঃগোত্রীয় ও আন্তঃসম্প্রদায়গত গির্জা গঠনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যান।

যখন থেকে উইলিয়ম কেরী ১৮১০ সালে ধর্মপ্রচারকদের বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব করেন তখন থেকে বাংলার ধর্মপ্রচারকদের একটি শাখা এ রকম একটি সংগঠন গড়ে তোলার কথা চিন্তা করছিলেন। ক্যালকাটা মিশনারি কনফারেন্স ছিল এ লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ। এ ধরনের চিন্তাধারা বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের প্রস্ত্ততিতে প্রণোদিত করে, যা ১৯১০ সালে এডিনবরায় ধর্মপ্রচারকদের বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠানের সাথে সাথে শুরু হয়।  [তৃপ্তি চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি MM ali, The Bengali Reaction to Christian Missionary Activities 1833-1857, Chittagong, 1965;  ED POHS, British Baptist Missionaries in India 1793-1837: The History of Serampore and its Missions, Cambridge, 1967; KP sengupta, The Christian Missionaries in Bengal 1793-1833, Calcutta, 1971; MA laird, Missionaries and Education in Bengal 1873 - 1937, Oxford, 1972;  B stanley, The History of the Baptist Missionary Society 1792-1992, Edinburgh, 1992; A Copley, Religions in Conflict : Ideology, cultural contact and conversion in late-colonial India, Delhi, 1997.