আদমশুমারি

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৭:১৮, ১৫ জুন ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

আদমশুমারি একটি দেশের জনসংখ্যার সরকারি গণনা হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে আদমশুমারি একটি জনগোষ্ঠীর বা দেশের  জনসংখ্যা গণনার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় তথ্য সংগ্রহ। তথ্য একত্রীকরণ এবং জনমিতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথ্যাদি প্রকাশ করা বোঝায়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী আদমশুমারিতে নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ থাকা প্রয়োজন (১) প্রতিটি ব্যক্তির তথ্য গণনা, (২) একটি চিহ্নিত এলাকায় সামষ্টিক গণনা, (৩) একই সঙ্গে সারাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা এবং (৪) নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অনুষ্ঠান। আদমশুমারির জন্য সুপারিশকৃত প্রয়োজনীয় বিষয়াদির মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, প্রয়োজনীয় ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য: আদমশুমারির সময় যেখানে পাওয়া গেছে অথবা যেখানে বাস করেন, জন্মস্থান, বর্তমান বাসস্থানে কতদিন যাবত বাস করছেন, পূর্বের বাসস্থান, কর্মস্থান; দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত এবং বাড়ি সংক্রান্ত তথ্যাদি: লিঙ্গ, বয়স, বাড়ির প্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক, পরিবার প্রধানের সঙ্গে সম্পর্ক, বৈবাহিক অবস্থা, বিবাহের মেয়াদকাল, বিবাহক্রম, মোট জীবিত জন্মগ্রহণকারী সন্তান সংখ্যা, বর্তমানে জীবিত সন্তানসংখ্যা, নাগরিকত্ব, শিক্ষা, স্কুলের উপস্থিতি এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা, শিক্ষাগত অর্জন, জাতীয়/নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, ভাষা, ধর্ম এবং তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য কর্মের ধরন, পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবন ধারণের প্রধান উৎস্য। উপরিউক্ত বিষয়সমূহের উপর ভিত্তি করে আরো কিছু তথ্য আদমশুমারির জন্য প্রয়োজনীয়। ১) ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ: জনসংখ্যার সমষ্টি, এলাকা-শহর, গ্রাম, (২) ব্যক্তিগত এবং বাড়িসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য: পরিবারের গঠন, বাড়িতে বসবাসকারী সদস্যদের গঠন, (৩) অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য: আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নির্ভরতা ইত্যাদি। আইনত (Dejure) অথবা কার্যত (De facto) পদ্ধতিতে আদমশুমারির প্রতিটি মানুষকে আবাসিক অথবা কোনো একটি এলাকায় উপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রাচ্য অথবা প্রতিচ্যের মধ্যযুগীয় সরকারসমূহ  কর অথবা সামরিক বাহিনীতে জনসাধারণের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনে কখনো কখনো আদমশুমারির আশ্রয় নিতেন। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম উইলিয়ম ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দে ডুমস ডে বুক অথবা ডোমসডে বুক নামে জমি অথবা জমিতে বসবাসকারী মানুষের একটি  জরিপ পরিচালনা করেন। এটি ইতিহাসের সর্বপ্রথম নথিভুক্ত আমদশুমারি হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আদমশুমারি পরিচালিত হয় ১৭৯০ সালে এবং পরবর্তীকালে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে ১৮০১ সালে আদমশুমারি পরিচালিত হয়।

১৫৮২ সালে ভারতবর্ষের প্রথম জরিপ ও ভূমি জরিপ সম্রাট  আকবরের রাজত্বকালে পরিচালিত হয়। সেই জরিপে মৌজাভিত্তিক অধিসত্ত্ব গ্রহণকারীদের গণনা করা হয় বিস্তারিতভাবে। এই জরিপ ইতিহাসে টোডরমলের বন্দোবস্ত হিসেবে পরিচিত। এই জরিপে কৃষিজমি, উৎপাদনভিত্তিক জমির বিবরণ, অধিসত্ত্বগ্রহণের ধরন, অধিসত্ত্ব গ্রহণকারীদের তথ্য ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়। যদিও সেই সময়ে পুরো অবিভক্ত বাংলা সম্রাট আকবরের নিয়ন্ত্রণে ছিল না, টোডরমল তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের সরকার বা প্রদেশসমূহের জরিপও অন্তর্ভুক্ত করেন।

আঠারো শতকে আদমশুমারির আধুনিক যুগ শুরু হয়। ১৭৯০ সালে প্রথম আধুনিক আদমশুমারি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হয়। ১৮০১ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে প্রথম প্রতি দশকে একবার করে আদমশুমারি শুরু হয়। সেই সময় থেকে আর্থ-সামাজিক গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে শুমারি বিজ্ঞান একটি নতুন ধারার কার্যক্রম সূচনা করে। বাংলার জেলাসমূহের উপরও ১৮০১ সালে আদমশুমারি অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়াও কালেক্টর, ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিচারকদের তাদের নিজ নিজ এলাকার জনসংখ্যার অনুমিত হিসাব দিতে হতো। প্রতিটি বাড়িতে গড়ে পাঁচ জন ধরে জেলাওয়ারি জনসংখ্যার গণনার পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। ১৮৪০ এবং ১৮৫০-এর দশকে, কর-প্রদানকারী ও করমুক্ত এস্টেট এবং বাংলার জনসংখ্যার হিসাবের জন্য বেশকিছু নমুনা জরিপ ও শুমারি পরিচালিত হয়।

থাকবস্ত জরিপ (১৮৪০ এবং ১৮৫০-এর দশক) প্রথমবারের মতো বাংলার গ্রামের সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ করে। এই জরিপে প্রতিটি মৌজার মানচিত্র তৈরি করা হয় এবং জনসংখ্যা গণনা করা হয়। এই মানচিত্রে প্রতিটি মৌজার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিবরণ যেমন, বাড়ির সংখ্যা, জনসংখ্যা, পেশা ও ধর্মের শ্রেণিবিন্যাস দেখানো হয়েছে। এছাড়াও পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্যাদি যেমন গবাদিপশু, কৃষিজমি, পতিত জমি, বনজঙ্গল, জলাভূমি, নদী ও খালবিল, সেতু ও কালভার্ট ইত্যাদির বিবরণও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এ সকল তথ্য ছিল ডবি-উ ডবি-উ  হান্টার প্রণীত স্ট্যাটিসটিক্যাল একাউন্ট অব বেঙ্গল (লন্ডন, ১৮৭৬) শীর্ষক ২০ খন্ডের বেঙ্গল গেজেটিয়ার প্রকাশের মৌলিক উপাদান।

১৮৭২ সালে বাংলার প্রথম আদমশুমারি পরিচালিত হয়। কিন্তু মানুষের সন্দেহ ও দ্বিধার কারণে প্রথম আদমশুমারি লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে পারেনি। লক্ষ্য অর্জনে সফল না হলেও এই আদমশুমারি থেকেই বাংলা একটি মুসলিম প্রধান রাজ্যরূপে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী আদমশুমারিসমূহ ১৮৮৯ এবং ১৮৯১ সালে অনুষ্ঠিত হয় যা গুণগতভাবে ১৮৭২ সনের আদমশুমারির তুলনায় অনেক উন্নতমানের ছিল। জনমিতি বিশারদদের মতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুইটি আদমশুমারি গুণগতভাবে যথেষ্ট ভালো ছিল।

১৯৩১-এর আদমশুমারি আংশিকভাবে এবং ১৯৪১-এর আদমশুমারি ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারায় তথ্যের ইচ্ছাকৃত বিকৃতির কারণে। হিন্দু ও মুসলমান, উভয় ধর্মের মানুষই তাদের স্ব স্ব ধর্মের পক্ষে মিথ্যা তথ্য প্রদান করে। অন্যদিকে পূর্ববাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) প্রথম আদমশুমারি একটি ভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে। ভারতবর্ষ ও পূর্ববাংলার মধ্যে দ্বি-মুখী ব্যাপক মাইগ্রেশনের কারণে বিভিন্ন জেলার লোকসংখ্যার গণনা দুরূহ সমস্যায় পড়ে। সেই তুলনায় ১৯৬১-এর আদমশুমারি ১৯০১ পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।

১৯৫১ এবং পরবর্তী আদমশুমারিসমূহের বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো: (১) এক বা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের সংখ্যা প্রতিটি আদমশুমারিতেই কম দেখানো হয়েছে। (২) ১৯৫১-এর আমদশুমারি সুবিন্যস্তভাবে পরিচালিত হয়নি এবং জাতীয়ভাবে শুমারি পরবর্তী নিরীক্ষা জরিপও পরিচালিত হয়নি। ১৯৫১-এর আদমশুমারিতে শহর এলাকায় ৫% মানুষ কম গণনা করা হয়েছে ধরা হলেও বাস্তবে তা আরো অনেক বেশি বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে, জাতীয় পর্যায়ে ৪% মানুষ ১৯৫১-এর আদমশুমারিতে কম ধরা হয়েছে অনুমান করে মোট জনসংখ্যার নতুন হিসাব দেখানো হয়। এই আদমশুমারির মোট জনসংখ্যা যে কারণে প্রভাবিত হয়েছিল তারমধ্যে ছিল যথা: প্রথমত, ১৯৪১ পরবর্তী সময়ে বিপুল সংখ্যক নেট মাইগ্রেশন (বহির্গমন বেশি, আগত কম); দ্বিতীয়ত, ১৯৪১ সালের জনসংখ্যা বেশি দেখানো এবং তৃতীয়ত, ১৯৪৩-এর দুর্ভোগ। (৩) সাধারণভাবে ১৯৬১-এর আদমশুমারিতে খুব ভালোভাবে পরিচালিত বলা হলেও বাদপড়া মানুষের সংখ্যা ৮.৬২% ধরে মোট জনসংখ্যা পূণর্বিন্যাস করা হয়। (৪) ১৯৭৪-এর শুমারি পরবর্তী নিরীক্ষা জরিপের ভিত্তিতে ৪টি প্রধান শহরাঞ্চলে বাদপড়া মানুষের সংখ্যা ১৯.৩% ধরা হয়, অন্যান্য অঞ্চলে তা ৬.৫% ধরা হয়। মোট জনসংখ্যা ৬.৮৮% বাদপড়া মানুষের জন্য পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। (৫) ১৯৮১ এর আদমশুমারিতে মোট জনসংখ্যার ৩.১% গণণা করা হয়নি ধরে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়। (৬) ১৯৯১-এর আদমশুমারিতে মোট জনসংখ্যার ৪.৬% গণনা করা হয়নি বলে ধরা হয় (গ্রামাঞ্চলে ৪%, ৮.৬% পৌর এলাকায় এবং ৫% অন্যান্য শহর এলাকায়)। (৭) ২০০১-এর আদমশুমারিতে মোট জনসংখ্যার ৪.৯৮% গণনার আওতায় আনা যায়নি বলে ধরা হয় (৪.৫৪% গ্রামাঞ্চলে, ৫.৮১% পৌর এলাকায়, ৩.৭৩% অন্যান্য শহর এলাকায় ও ৭.৬৭% এসএমএ সমূহে অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায়)।

১৮৭২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আদমশুমারিভিত্তিক জনসংখ্যা নিচের সারণিতে দেখানো হলো:

বৎসর অবিভক্ত বঙ্গদেশ বাংলাদেশ এলাকা
১৮৭২ ৩৪, ৬৯১, ৭৯৯ ---
১৮৮১ ৩৭, ০২০, ৫৬৩ ---
১৮৯১ ৩৯, ৮১২, ১৬৫ ---
১৯০১ ৪২, ৮৮৮, ১৯৪ ২৮, ৯২৭, ৭৮৬
১৯১১ ৪৬, ৩১২, ২৬২ ৩১, ৫৫৫, ০৫৬
১৯২১ ৪৭, ৫৯৯, ২৩৩ ৩৩, ২৫৪, ০৯৬
১৯৩১ ৫১, ০৮৭, ৩৩৮ ৩৫, ৬০৪, ১৭০
১৯৪১ ৬০, ৩০৬, ৫২৬ ৪১, ৯৯৭, ২৯৭
১৯৫১ --- ৪৪, ১৬৫, ৭৪০ (৪২, ০৬২, ৬১০)
১৯৬১ --- ৫৫, ২২২, ৬৬৩ (৫০, ৮৪০, ২৩৪)
১৯৭৪ --- ৭৬, ৩৯৮, ০০০ (৭১, ৪৭৯, ০৭১)
১৯৮১ --- ৮৯, ৯১২, ০০০ (৮৭, ১২০, ১১৯)
১৯৯১ --- ১১১, ৪৫৫, ১৮৫ (১০৬, ৩১৪, ৯৯২)
২০০১ --- ১৩০, ৫২২, ৫৯৮ (১২৪, ৩৫৫, ২৬৩)
২০১১ --- ১৪২,৩১৯,০০০

নোট গণনাকৃত জনসংখ্যা ব্র্যাকেটে দেখানো হয়েছে।

উৎস Census of India (1931, 1941); Bangladesh Population Census, 1991, 2001, 2011

আদমশুমারির প্রয়োজনীয়তা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত জাতীয় পরিকল্পনার কারণে। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতির কারণে (পপুলেশন মোমেন্টাম)। এই বৃদ্ধি আগামী চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বৎসর ধরে ঘটতে থাকবে। এই চলমান প্রক্রিয়ায় শিশু জনসংখ্যার হার দ্রুত হ্রাস পাবে, কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার দ্রুত বৃদ্ধি পাবে, জনসংখ্যার নির্ভরতা (Dependency Ratio) অনেক কমে যাওয়ায় নীতি নির্ধাকদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ আসবে উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত জাতীয় আয় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার। পপুলেশন মোমেন্টাম চলাকালীন সময়ে দেশের বৃদ্ধ মানুষের আনুপাতিক হারও ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং পরবর্তীকালে জনসংখ্যার নির্ভরতার হারও বৃদ্ধি পাবে। ওই সময়ে আরো একটি প্রক্রিয়া বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় প্রচন্ড প্রভাব ফেলবে এবং তা হলো ব্যাপক গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশন। ওই মাইগ্রেশনের ফলে খুব দ্রুত বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই ভবিষ্যত জনসংখ্যা সম্পর্কে ধারণা পেতে হলেও আদমশুমারির নির্ভুল গণনার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জনসংখ্যার বৃদ্ধির কারণে জনমিতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিণতি সম্পর্কে ধারণা পেতে হলেও বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার সঠিক গণনা প্রয়োজন। [এম. আতাহারুল ইসলাম]