নুড়িপাথর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:০০, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

নুড়িপাথর (Gravel)  অসংহত, ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন আকৃতির শিলাখন্ডের প্রাকৃতিক সঞ্চয়ন, প্রধানত বালি কণা (২ মিমি এর চেয়ে বড় আকৃতির) থেকে বৃহত্তর আকারের শিলাচূর্ণ যেমন বোল্ডার, কোবল, পেবল, গ্রানিউল অথবা এসকলের যেকোন সমন্বয়। এটি মূলত অসংহত পিন্ডজ শিলার (conglomerate) সমার্থক। অর্থনৈতিক ভূতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে, নুড়িপাথর বলতে সাধারণত নুড়িপাথরের আধিক্য বিশিষ্ট যেকোন পলিজ সঞ্চয়নকে বোঝানো হয়ে থাকে, তবে এই প্রক্রিয়ায় নুড়ি সঞ্চয়নে বালি এবং কর্দমও অন্তর্ভুক্ত থাকে। নির্মাণ উপকরণ হিসেবে সরাসরি অথবা কংক্রিটের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিলিত উপাদান হিসেবে নুড়িপাথর ব্যবহূত হয়ে থাকে।

নুড়িপাথর,জাফলং সিলেট

বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের বিস্তীর্ণ এলাকা নুড়িপাথরের স্তর দ্বারা আবৃত। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সর্বউত্তরে বৃহত্তর রংপুরের দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা, পাটগ্রাম, ডালিয়া, চাপানি ও কালিগঞ্জ এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের তেঁতুলিয়া, ভজনপুর, বোয়ালমারী প্রভৃতি এলাকায় নুড়িপাথর উন্মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ সকল নুড়ি সাধারণত গোলাকার, ডিম্বাকার কিংবা লম্বাটে আকৃতির হয়ে থাকে এবং সর্বোচ্চ ৩০ সেমি পর্যন্ত দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নুড়িপাথরের উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে। এই নুড়ি মোটা দানাদার বালির সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় পাওয়া যায়।

মসৃণপৃষ্ঠ ও সুগঠিত বর্তুলাকৃতিবিশিষ্ট এ সকল নুড়িসমূহ মূলত কোয়ার্টজ, কোয়ার্টজাইট, গ্রানাইট, নাইস এবং সিস্ট দিয়ে গঠিত। এ সকল নুড়ির গঠন হিমালয়ের ডালিং স্তরক্রমের সমরূপ। নুড়িপাথর শিলার এ সকল স্তর নবীন প্লাইসটোসিন স্তরক্রমের পঞ্চগড় বালুকাময়-নুড়ি স্তরগ্রুপ হিসেবে বিদ্যমান। হলোসিন স্তরক্রমের পলল এবং কখনও কখনও মিহি বালি, পলি ও কর্দম দ্বারা গঠিত ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সর্বনিম্ন অর্ধ-মিটার থেকে কোন কোন স্থানে ৫ মিটার বা তারও বেশি গভীরতায় এই নুড়িস্তর বিদ্যমান থাকে। পঞ্চগড় বালুকাময়-নুড়িস্তর সঞ্চয়ন পরিবেশের ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস খুবই চিত্তাকর্ষক। শেষ বরফযুগের সময় (বর্তমান সময়কাল থেকে প্রায় ১৮ হাজার বছর পূর্বে) হিমালয় পর্বতসারি ছিল বেশ উঁচু এবং হিমবাহ দ্বারা আবৃত। হিমবাহের আবরণ পর্বত পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ে। সে সময় জলবায়ু ছিল শুষ্ক এবং বরফ গলা পানি বঙ্গীয় সমভূমির উপর দিয়ে সরু ও গভীর খোদিত নদীপ্রণালী হিসেবে প্রবাহিত হতো। নবীন প্লাইসটোসিন যুগের সমাপ্তিক্ষণে অর্থাৎ শেষ হিমবাহ যুগের শেষ দিকে মৌসুমি বৃষ্টিপাত প্রবল হয় এবং হিমবাহসমূহ গলতে শুরু করে। বরফ গলা পানি এবং সেই সঙ্গে সংযুক্ত বৃষ্টির পানি প্রবল প্রবাহ রূপে বঙ্গীয় সমভূমির উপর দিয়ে সবেগে প্রবাহিত হতে থাকে। পূর্বের সৃষ্টি হওয়া সংকীর্ণ নদী ধারাগুলি অতি প্লাবিত হয়ে পড়ে এবং বরেন্দ্রভূমির উপর দিয়ে অতিরিক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার ফলে বরেন্দ্র ভূভাগ কর্তিত হয় এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত কতগুলি লোহিত ভূভাগবিশিষ্ট দ্বীপের সৃষ্টি হয় যা বর্তমান কালের বরেন্দ্রভূমির ভূরূপতত্ত্বে দেখা যায়। হিমালয় থেকে প্রবল বেগে নেমে আসা পানির সঙ্গে নুড়িপাথরও পরিবাহিত হয়। এ সকল নুড়িপাথর পঞ্চগ্রাম-দহগ্রাম-ডালিয়া এলাকায় পর্বত পাদদেশীয় সঞ্চয়ন হিসেবে বিস্তৃত হয়।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের জৈন্তিয়াপুর-ভোলাগঞ্জ এলাকায় নুড়িপাথরের উত্তম মজুত বিদ্যমান রয়েছে। এই অঞ্চলে নুড়িপাথরসমূহ দুটি শিলাস্তরীয় উপ-এককে বিভক্ত: অধিকতর পুরানো উপ-একক (উচ্চ সোপানভূমি) এবং নবীনতর উপ-একক (নিচু সোপানভূমি)। অধিকতর প্রবীণ উপ-এককটি জৈন্তিয়াপুর এলাকায় এবং বিন্দা টিলার চূড়াদেশে বিস্তৃত। এই নুড়ি সঞ্চয়নকে সোনা টিলা নুড়িপাথর স্তর নামে নামকরণ করা হয়েছে। একইভাবে, ভোলাগঞ্জ এলাকা এবং বর্তমান নদীপ্রণালীর নদীতলদেশে সঞ্চিত নুড়িপাথর স্তরের নবীনতর উপ-একককে ভোলাগঞ্জ নুড়িপাথর স্তর নামে নামকরণ করা হয়েছে। নুড়িপাথর সঞ্চয়নের উভয় উপ-এককই ডিহিং স্তরসমষ্টির অন্তর্ভুক্ত। সোনা টিলা নুড়িপাথর স্তর প্রবীণ প্লাইসটোসিন সিরিজের সমতুল্য এবং মধুপুর কর্দম স্তরসমষ্টির অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, ভোলাগঞ্জ নুড়িপাথর স্তর নবীন প্লাইসটোসিন থেকে হলোসিন সিরিজের সমতুল্য। প্রথম উপ-এককটি বিচূর্ণিত (weathered) যেখানে খাসিয়া-জৈন্তা পর্বতসারি থেকে উৎপন্ন পরবর্তী উপ-এককটিতে বিদ্যমান নুড়িপাথরসমূহ অবিচূর্ণিত, কঠিন এবং উচ্চ মানসম্পন্ন। নুড়িপাথরের উভয় স্তরই আগ্নেয় এবং রূপান্তরিত উৎস থেকে উৎপন্ন। দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণ এবং দীর্ঘ সময় নুড়িজাত পললেরল সঙ্গে ঘর্ষণের শিকার হওয়ায় এসকল নুড়িপাথর উচ্চ বর্তুলাকৃতি এবং গোলাকৃতি গুণ অর্জন করেছে। নদীজ সঞ্চয়ন থেকে এসকল নুড়িপাথর গঠিত।

নুড়িপাথরের এসকল সঞ্চয়ন ছাড়াও পার্বত্য এলাকা থেকে সমভূমিতে নেমে আসা অসংখ্য পাহাড়ি স্রোতধারা তাদের সমভূমি প্রবাহে নুড়িপাথরের সঞ্চয়ন গড়ে তুলেছে। প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়ি নদীসমূহ পর্বত থেকে নুড়িপাথর বহন করে পর্বত পাদদেশে নদীতলদেশে নুড়িপাথরের স্তর গঠন করেছে। টেকনাফ-কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মাদারবুনিয়া ছড়া এবং রাজার ছড়া এলাকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে নুড়িপাথরের সাতটি পৃথক মজুত রয়েছে। এসকল নুড়িপাথর পাললিক উৎস থেকে উৎপন্ন এবং অধিকাংশই সুরমা ও টিপাম শিলাদলের অন্তর্ভুক্ত। দেশে বিদ্যমান নুড়িপাথরের মজুতসমূহ থেকে যথাযথভাবে নুড়িপাথর উত্তোলন করা হলে তা রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ, ভেড়িবাঁধ ও পাকা ঘর-বাড়ী নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় নুড়িপাথর চাহিদার অনেকাংশ পূরণে সক্ষম হবে।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]

আরও দেখুন  কঠিন শিলা