রায়চৌধুরী, হেমচন্দ্র

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৫৫, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

রায়চৌধুরী, হেমচন্দ্র (১৮৯২-১৯৫৭)  ঐতিহাসিক। হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী ১৮৯২ সালের ৮ এপ্রিল বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) জেলার পোনাবালিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পোনাবালিয়ার জমিদার মনোরঞ্জন রায়চৌধুরী ও তরঙ্গিনী দেবীর পুত্র হেমচন্দ্র বরিশালের ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশনে প্রথম জীবনের শিক্ষালাভ করেন। তাঁর বিশাল শিক্ষাগত উৎকর্ষের অনুকূল পূর্বলক্ষণ প্রথম প্রতিভাত হয় যখন তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের সকল পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (১৯০৭) উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। General Assembly's Institution (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট আর্টস পরীক্ষায় পাস করেন। তিনি ১৯১১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ঐ বছরের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্নাতক সম্মান পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ইতিহাসে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এজন্য তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ ‘এশান বৃত্তি’ প্রদান করা হয়। দুবছর পর (১৯১৩) তিনি ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পান। স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তাঁর কৃতিত্বের জন্য তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ’গ্রিফিথ পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয় (১৯১৭)। এরপর ১৯২১ সালে ডক্টরেট প্রোগামে ভর্তি হয়ে তিনি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি-এইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

Political History of Ancient India শীর্ষক তাঁর পি-এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটা তাঁকে ভারতীয় ইতিহাস-রচয়িতাদের মাঝে সম্মানিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে। এ গ্রন্থটির বিস্ময়কর সাফল্য এবং এটি যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পন্ডিতদের উপর স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করে তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মিলে এ ঘটনা থেকে যে, লেখকের জীবৎকালে গ্রন্থটির আটটি এবং তাঁর মৃত্যুর পর আরও দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পরিক্ষিতের সিংহাসনারোহণ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে মগধে হর‌্যঙ্ক বংশের উত্থান পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক বিকাশের একটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনা উপস্থাপন করা এবং অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতক থেকে উত্তর ভারতে পরাক্রমশালী গুপ্ত সাম্রাজ্যের সমাপ্তিকাল খ্রিস্টীয় ছয় শতক পর্যন্ত রাজনৈতিক ইতিহাস কিভাবে পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত তার বিবরণ পেশ করা। বিবিধ ধরনের লিখিত সূত্রের ওপর তাঁর বিস্ময়কর দখল দ্বারা তিনি দক্ষতার সাথে প্রমাণ করেছেন যে, ভারতের যুদ্ধোত্তর সময়ের নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক  বিবরণ  উপস্থাপন  করা  সম্ভব।

হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী

একথা ছিল ভিনসেন্ট স্মিথ প্রণীত বহুল পঠিত পাঠ্যপুস্তক Early History of India থেকে স্পষ্টরূপে বৈসাদৃশ্যমূলক। স্মিথ আলেকজান্ডারের আক্রমণের পূর্বে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস লেখার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। স্মিথ আলেকজান্ডারের আক্রমণকে ভারতীয় কালানুক্রম গণনার প্রধান অবলম্বন বলে মনে করতেন।

গ্রন্থটির দ্বিতীয় অংশে তিনি অপ্রতুল ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অভিলেখ, লিখিত গ্রন্থাদি ও মুদ্রায় বিধৃত তথ্যের ভিত্তিতে প্রায় বারো শত বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন। তবে প্রত্যেক ভারতীয় প্রদেশের রাজনৈতিক অথবা বংশানুক্রমিক ইতিহাস রচনা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, বরং ঐসব রাজ্য ও সাম্রাজ্যের প্রতি তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন যারা প্রাদেশিক সীমারেখা অতিক্রম করে ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাসমূহের সামগ্রিক অগ্রগতিকে প্রভাবিত করেছিল। স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রতি আসক্তি ও সাম্রাজ্যের ঐক্যের প্রতি আগ্রহ প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস এ দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে তিনি এ বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে এর প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। অন্যভাবে বলতে গেলে, তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, অতীত ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে ভারত রাজনৈতিক সংহতি ও ঐক্যের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। মনে হয় এ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।

তাঁর প্রধান কীর্তি ছাড়াও রায়চৌধুরী প্রণীত Materials for the study of the Early History of the Vaisnava Sect গ্রন্থখানি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয় (প্রথম সংস্করণ ১৯২০, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৩৬)। এটি প্রাচীন ভারতে বৈষ্ণববাদের ওপর অন্যতম প্রধান নির্ভরযোগ্য আকর-গ্রন্থ হিসেবে এখনও সমাদৃত। তাঁর প্রবন্ধসমূহের সঙ্কলনগ্রন্থ Studies in Indian Antiquities কম বিখ্যাত নয় (প্রথম সংস্করণ ১৯৩২ ও দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৮৫)। শেষোক্ত গ্রন্থখানিতে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ঐতিহাসিক গবেষণায় ভৌগোলিক ব্যাপ্তি-স্থানের ধারণা সময়ের ধারণার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অসংখ্যবার পুরাণের মূল পাঠের ভিত্তিতে ভারতের ঐতিহাসিক ভূগোল ও প্রাচীন ভারতে সৃষ্টির গঠনতত্ত্বমূলক ধারণাসমূহের গভীর অধ্যায়নের দ্বারা তিনি তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উৎসমূহের ব্যবহারের ব্যাপারে সব সময় সমালোচক রায়চৌধুরী পুরাণের মূল পাঠের অনেক কাল্পনিক ভৌগোলিক ধারণাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। তাঁর অন্যান্য অবদানের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় রমেশচন্দ্র মজুমদার কর্তৃক সম্পাদিত History of Bengal, প্রথম খন্ড (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২) তাঁর লিখিত অধ্যায় এবং জি ইয়াজদানী সম্পাদিত Early History of the Deccan-এ তাঁর লিখিত অধ্যায় দ্বয়। বহুল পঠিত An Advanced History of India-র তিনি একজন যৌথ লেখক, অন্য দুজন হলেন আর.সি মজুমদার ও কে.কে দত্ত।

ইতিহাসবিদ রায়চৌধুরী অত্যন্ত সম্মানিত শিক্ষকতা জীবনেরও অধিকারী। স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পাস করার অব্যবহিত পর তিনি ইতিহাসের প্রভাষক হিসেবে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে যোগ দেন (১৯১৩-১৪)। এরপর তিনি তিন বছর প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতা করেন (১৯১৪-১৬) এবং প্রভাষক হিসেবে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে নিযুক্ত ছিলেন। অতঃপর তাঁর শিক্ষকতা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় আসে যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নব প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে যোগদান করেন (১৯১৭)। ১৯৩৬ সালে তিনি ঐ একই বিভাগে কারমাইকেল প্রফেসর নিযুক্ত হন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণ রা পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯২৮ সালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি ইতিহাস বিভাগের রীডার ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেন।

তাঁর পান্ডিত্যের জন্য সর্বজনীনভাবে শ্রদ্ধেয় রায়চৌধুরী বহু সম্মান অর্জন করেছেন। তাঁকে বাংলার এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো নিযুক্ত করা হয় এবং ১৯৫১ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির বিসি ল স্বর্ণপদক প্রদানের মাধ্যমে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি কংগ্রেসের হায়দ্রাবাদ সেশনে (১৯৪১) তাঁকে বিভাগীয় সভাপতি এবং পরবর্তীতে ঐ অ্যাকাডেমিক সংগঠনটির নাগপুর সেশনে (১৯৫০) মূল সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।  [রণবীর চক্রবর্তী]