মঙ্গলকাব্য

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৫৭, ২ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মঙ্গলকাব্য  মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ ধারা। দেবমাহাত্ম্যমূলক সমাজচিত্রভিত্তিক এ কাব্যই বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও নিজস্ব কাহিনীকাব্য। এ কাব্য পাঠ বা শ্রবণ করলে সকল প্রকার অকল্যাণ নাশ ও সর্ববিধ মঙ্গল লাভ হয় এরূপ ধারণা থেকেই এর নাম হয়েছে মঙ্গলকাব্য। মঙ্গলকাব্য পালা হিসেবে গীত হতো, তবে এতে সুর অপেক্ষা কাহিনীই বেশি প্রাধান্য পেত।

প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে একেকজন দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এঁরা লৌকিক দেবতার সঙ্গে পৌরাণিক দেবতার সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাঙালির নিজস্ব দেবতা। বহিরাগত আর্যদেবতাদের বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করে এঁদেরকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হয়েছে। আর্যদেবতাদের বিরুদ্ধে এই বিজয়ের কারণে মঙ্গলকাব্যের ‘মঙ্গল’ শব্দটি ‘বিজয়’ অর্থেও গ্রহণ করা হয়। এমনকি কোনো কোনো মঙ্গলকাব্যের নামের সঙ্গে ‘বিজয়’ শব্দটি সংযুক্তও হয়েছে, যেমন বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়।

মঙ্গলকাব্যের প্রধান দেবতারা হচ্ছেন মনসা,  চন্ডী ও  ধর্মঠাকুর। এঁদের মধ্যে  মনসা ও চন্ডী এই দুই স্ত্রীদেবতার প্রাধান্য বেশি। এই তিনজনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলকাব্যের প্রধান তিনটি ধারা গড়ে উঠেছে মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল। কালক্রমে শিবঠাকুরও মঙ্গলকাব্যের বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং তৎকেন্দ্রিক কাব্যধারার নাম শিবায়ন বা শিবমঙ্গল।

মঙ্গলকাব্যের চারটি সাধারণ লক্ষণ আছে, যাকে কেন্দ্র করে এর বিষয়বস্ত্ত চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ বন্দনা। এখানে বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা করা হয়। শুধু তাই নয়, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকল শ্রেণীর উপাস্যদের প্রতিও এখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এটি মঙ্গলকাব্য রচয়িতাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বা সর্বধর্মসমন্বয় চেষ্টার এক নিদর্শন। দ্বিতীয় অংশে থাকে কবির আত্মপরিচয় এবং গ্রন্থ রচনার কারণ স্বপ্নাদেশ বা দৈবনির্দেশের বর্ণনা। তৃতীয় অংশ দেবখন্ড। এর আলোচ্য বিষয় পৌরাণিক দেবতার সঙ্গে লৌকিক দেবতার সম্বন্ধ স্থাপন। এ ক্ষেত্রে শিবের প্রাধান্য লক্ষণীয়। চতুর্থ অংশ নরখন্ড ও আখ্যায়িকা। এ অংশের মুখ্য বিষয় পূজাপ্রচারের উদ্দেশ্যে শাপভ্রষ্ট কোনো দেবতা বা স্বর্গবাসীর নরজীবন লাভ, নররূপে তাঁর কর্মকান্ড এবং অনেক দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের পর মানব সমাজে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিষয় হিসেবে থাকে নায়িকাদের বারমাস্যা,  চৌতিশা, সাজ-সজ্জা, রন্ধনপ্রণালী ইত্যাদির বর্ণনা। এটিই মঙ্গলকাব্যের প্রধান অংশ।

মঙ্গলকাব্যের উদ্ভবের সঙ্গে তখনকার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রসঙ্গের একটা সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হয়। বাংলায় তুর্কি-আক্রমণ হয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের সন্ধিক্ষণে সেন-রাজত্বের সময়। স্বল্প শক্তি নিয়ে  বখতিয়ার খলজী লক্ষমণসেনকে পরাজিত করে বাংলা দখল করেন। এই লঘু শক্তির কাছে কেন সেন রাজারা পরাজিত হলেন তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে, হয়তো ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক সেন রাজাদের প্রতি স্বল্প সংখ্যক উচ্চবর্ণের লোকদেরই সমর্থন ছিল; কিন্তু অবহেলা, উপেক্ষা ও অত্যাচারের কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দু প্রজাসাধারণের কোনো সমর্থন তাঁদের প্রতি ছিল না। তাই বৈদেশিক আক্রমণের সময় তারা রাজার সাহায্যে এগিয়ে যায়নি। আর পূর্বে ক্ষমতাচ্যুত বৌদ্ধরা হয়তো সেনদের বিরুদ্ধে আক্রমণকারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতাই করে থাকবে।

এভাবে যখন বাইরের মুসলিম শক্তি বাংলার শাসনক্ষমতা দখল করে, তখন ক্ষমতাচ্যুত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দর্প চূর্ণ হয়। তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং পরাজয়ের গ্লানি তাদের নিম্নশ্রেণীর সাধারণ মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসে। ফলে তাদের মধ্যে বহুদিনের যে সামাজিক দূরত্ব ছিল তা ঘুচে যায়। উচ্চশ্রেণীর লোকেরা তখন নিম্নশ্রেণীর লোকেদের ধর্মবিশ্বাসেরও মূল্য দিতে শুরু করে। আর পরাজয়ের কারণে তারা আত্মশক্তির প্রতি আস্থা হারিয়ে ক্রমাগত দৈবনির্ভর হয়ে পড়ে। দৈবই সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্যের কারণ, দৈব দ্বারাই সব কিছু সম্ভব, পৌরুষত্ব কিছুই নয় এরূপ বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে তারা লৌকিক দেবতার সঙ্গে পৌরাণিক দেবতার সমন্বয় ঘটিয়ে নতুন নতুন দেবতার সৃষ্টি করে এবং তাঁদের নিকট হূতশক্তি ফিরে পাওয়াসহ সকল প্রকার মঙ্গল কামনা করে। এভাবে এই নবসৃষ্ট দেবতারা তাদের নিকট মঙ্গলদেবতায় পরিণত হয় এবং তাঁদের কেন্দ্র করে রচিত আখ্যায়িকা অভিহিত হয় মঙ্গলকাব্য নামে। মঙ্গলকাব্যগুলিতে বহিরাগত দেবতাদের পরাজিত করে লৌকিক দেবতাদের বিজয় প্রতিষ্ঠার রূপকে আসলে বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে স্থানীয় হিন্দুদের বিজয় ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কাল্পনিক চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে। পরাজিত হিন্দুশক্তি তখন এরূপ কল্পনার আশ্রয় নিয়েই আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে।

মঙ্গলকাব্যের একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, এর নায়ক-নায়িকারা সাধারণত  বণিক সম্প্রদায়ের এবং অন্যান্য চরিত্রগুলি সমাজের নিম্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি; ব্রাহ্মণাদি উচ্চবর্ণের প্রাধান্য এতে কম। এর কারণ হয়তো এই যে, মঙ্গলকাব্যগুলি যেহেতু কোনো-না-কোনো দেবতার পূজা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে, সেহেতু এ কাজের জন্য সমাজের কোনো বিত্তশালী এবং শক্তিশালী ব্যক্তিরই প্রয়োজন ছিল। এটি একটি সমাজ-বাস্তবতার দিক। এছাড়া মঙ্গলকাব্যগুলি থেকে তৎকালীন সমাজের আরও অনেক চিত্র পাওয়া যায়। তখনকার নারী-পুরুষের বেশভূষা, বিদ্যাচর্চা, মুদ্রাব্যবস্থা, যুদ্ধবিগ্রহ, নাগরিক জীবন, সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ও চমৎকারভাবে মঙ্গলকাব্যগুলিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

মঙ্গলকাব্যে এক প্রকার মিশ্র ধর্ম-সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়। এর কারণ, দশম-একাদশ শতকের দিকে বাংলার আর্য-অনার্য এবং হিন্দু-বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ধর্ম-সংস্কৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল। তারা পারস্পরিক দূরত্ব ঘুচিয়ে একে অপরের সঙ্গে মিলনোন্মুখ হয়ে উঠেছিল। উভয় সম্প্রদায় তাদের অধ্যাত্মচিন্তা এবং ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে পৌরাণিক ও তান্ত্রিক ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল। এর ফলেই হিন্দু পৌরাণিক ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক ভাবধারাপুষ্ট এক মিশ্র ধর্ম-সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে, যার প্রকাশ ঘটেছে মঙ্গলকাব্যগুলিতে।

সাধারণভাবে মঙ্গলকাব্যগুলির রচনাকাল ধরা হয় চৈতন্যপূর্ব যুগ থেকে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের সময় পর্যন্ত। ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের সমকালে কিংবা অব্যবহিত পরে এর প্রথম রূপটি তৈরি হয়। তারপর একাদিক্রমে  ভারতচন্দ্র (১৭১২-১৭৬০) পর্যন্ত এ ধারা চলতে থাকে।

মনসামঙ্গল  মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে প্রাচীনতম। সর্পদেবী মনসার কাহিনী এর উপজীব্য। বাংলার লোকসমাজে বহু পূর্ব থেকেই সর্পপূজার প্রচলন ছিল। মনসা অনার্য দেবতা, তাই অনার্য দ্রাবিড় সভ্যতা থেকে এর আগমন ঘটেছে বলে মনে করা হয়। সর্পের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যেই দাক্ষিণাত্যবাসী দ্রাবিড়দের মধ্যে এই সর্পদেবীর পূজার প্রচলন হয়। বিষধর সাপ সাধারণত জঙ্গলেই থাকে, তাই সর্পদেবীর বিষহরী, জাঙ্গুলী, পদ্মাবতী ইত্যাদি নামও দেখা যায়।

মনসামঙ্গলের প্রচলিত কাহিনীটি হচ্ছে বণিক চন্দ্রধর বা চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মনসার দ্বন্দ্ব এবং শেষপর্যন্ত চন্দ্রধর কর্তৃক মনসার পূজা প্রদানের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি। চন্দ্রধর ছিলেন শিবভক্ত। মনসা চাইলেন চাঁদের মাধ্যমে লোকসমাজে তার পূজা প্রচার করতে। কিন্তু পূজা দেওয়া থাক দূরের কথা, চাঁদ তাকে দেবী বলেই স্বীকার করেন না। এতে চাঁদ এবং তাঁর পরিবারের ওপর নেমে আসে মনসার চরম অত্যাচার। ক্রোধবশত মনসা চাঁদের সপ্তডিঙ্গা সমুদ্রে ডুবিয়ে দেন এবং তাঁর সাত ছেলেকে সর্পদংশনে মেরে ফেলেন। অবশেষে কনিষ্ঠপুত্র লখিন্দরের সদ্য পরিণীতা স্ত্রী বেহুলার পতিভক্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অসীম মনোবল এবং কঠোর সাধনার কাছে দৈবশক্তি পরাভব মানে এবং চাঁদের সপ্তডিঙ্গাসহ সাত পুত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে  বেহুলা শ্বশুর বাড়ি ফিরে যায়।

মনসামঙ্গলের  এই কাহিনী মূলত নিগৃহীত মানবতার জীবনকথা। মানবিকতার সর্বময় পরাভব ও গ্লানিকর সেই যুগে চন্দ্রধর ও বেহুলা দুটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও প্রতিবাদী চরিত্র। উচ্চ-নীচ ভেদ, আর্য-অনার্য দ্বন্দ্ব ইত্যাদি তৎকালীন সমাজের বিষয়গুলি মনসা-চাঁদ-বেহুলার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। দেবতা ও মানুষের দ্বন্দ্বে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্য এবং চাঁদের সঙ্গে মনসার বিবাদে আর্য-অনার্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছে। কারণ চাঁদ ছিলেন শিবের ভক্ত। শিব অনার্যসম্ভূত হলেও আর্যদেবতাদের শ্রেণীভুক্ত। পরিণামে অবশ্য এই বিভেদ আর থাকেনি। বেহুলার ব্যক্তিত্বের কাছে দেবতাদের পরাজয় এবং চন্দ্রধর কর্তৃক মনসার পূজা দেওয়ায় সব বিভেদ দূর হয়ে যায়। এসব ঘটনা থেকে আরও একটি বিষয় পরিস্ফুট হয় যে, মানুষ প্রকৃতপক্ষে দৈবশক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং দৈবই মানুষের ওপর নির্ভরশীল; দৈব ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু মানুষ ছাড়া দৈবের কোন অস্তিত্ব নেই। তাই পূজা প্রচারের জন্য অন্যান্য দেবতার মতো মনসাকেও একজন মানুষ অর্থাৎ চন্দ্রধরের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। বেহুলা চরিত্র থেকে ভারতীয় নারী, বিশেষত বাঙালি নারীর পতিভক্তির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।

মনসামঙ্গলের  আদি কবি  কানা হরিদত্ত, কিন্তু তাঁর গ্রন্থ পাওয়া যায়নি। তিনি ১৩শ শতকে জীবিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। এরপর আর যাঁরা মনসামঙ্গল রচনা করেন তাঁরা হলেন পুরুষোত্তম, নারায়ণদেব (আনু. ১৫শ শতক),  বিজয়গুপ্ত এবং  বিপ্রদাস  পিপিলাই বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গলই (১৪৯৪) সর্বাপেক্ষা পরিচিত এবং সাহিত্যিক গুণসম্পন্ন। বিপ্রদাসের গ্রন্থ মনসাবিজয় পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে রচিত বলে গবেষকদের অনুমান।

চন্ডীমঙ্গল  মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। চন্ডীদেবীর কাহিনী এর উপজীব্য। এই চন্ডীদেবীও মূলত অনার্যসম্ভূতা, পরে বৌদ্ধ ও হিন্দু তন্ত্রের দেবকল্পনার প্রভাবে পর্যায়ক্রমে পৌরাণিক দেবতায় পরিণত হন। এর বিষয়বস্ত্ত দুটি সামাজিক কাহিনীকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে। প্রথমটি কালকেতু-ফুল্লরার জীবনকথা এবং দ্বিতীয়টি ধনপতি-লহনা-খুল্লনার কাহিনী। কালকেতু একজন দরিদ্র ব্যাধ। দেবী চন্ডীর কৃপায় দারিদ্র্যপীড়িত জীবন থেকে কালকেতু-ফুল্লরা বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়। কিন্তু ধনগর্বে গর্বিত কালকেতু-ফুল্লরা দেবীকে বিস্মৃত হলে আবার তারা অশেষ দুর্গতিতে পড়ে। অবশেষে দেবীর শরণাপন্ন হয়ে তারা পুনরায় ধন-সম্পদ ও সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করে।

দ্বিতীয় কাহিনী অনেকটা মনসামঙ্গলের মতো। ধনপতি একজন ধনবান ও বিলাসী সওদাগর। তিনি শ্যালিকা খুল্লনার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর লহনার তত্ত্বাবধানে খুল্লনাকে রেখে তিনি যান বাণিজ্যে এবং সেখানে বারবনিতায় আসক্ত হয়ে পড়েন। এই সুযোগে দাসীর প্ররোচনায় লহনা খুল্লনার ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। একদিন বনে ছাগল চরাতে গিয়ে খুল্লনা বিপদে পড়ে চন্ডীর মাহাত্ম্য জানতে পারে। তারপর চন্ডীর কৃপায় সে বিদেশ প্রত্যাগত স্বামীর সোহাগ-ভাগিনী হয়। আরেক দিন গর্ভবতী খুল্লনাকে বাড়িতে রেখে ধনপতি পুনরায় বাণিজ্যে যান। ধনপতি ছিলেন  শৈব, তাই চন্ডীবিদ্বেষ হেতু সেখানে তিনি কারারুদ্ধ হন। এদিকে খুল্লনার এক পুত্রসন্তান জন্মে। তার নাম রাখা হয় শ্রীমন্ত। শ্রীমন্ত বড় হয়ে চন্ডীর কৃপায় পিতাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে। এরপর ধনপতি চন্ডীমাহাত্ম্য স্বীকার করেন।

স্পষ্টই বোঝা যায় যে, চন্ডীর মাহাত্ম্য প্রচার ও পূজাপ্রচলনের উদ্দেশ্যেই উপর্যুক্ত কাহিনী দুটি সাজানো হয়েছে। তবে এর মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজের অনেক তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। সপত্নীবিদ্বেষ, পুরুষের ভোগলালসা ও রূপাসক্তি, নগর প্রতিষ্ঠা, ব্যাধসমাজের রীতি-নীতি ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, কালকেতুপীড়িত বন্য পশুদের চন্ডীর নিকট কাতর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে নির্যাতিত মানুষের দুঃখদুর্দশার রূপায়ণ ইত্যাদি বিষয় কাব্যে চিত্রিত হয়েছে। চন্ডীমঙ্গলের চরিত্রগুলি মানবীয় গুণাগুণসম্পন্ন এবং সমাজরসে পরিপুষ্ট। তাই সমালোচকদের দৃষ্টিতে চরিত্রকল্পনায় চন্ডীমঙ্গল শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত।

চন্ডীমঙ্গলের আদি কবি মাণিক দত্ত। তিনি মালদহের লোক ছিলেন বলে মনে করা হয় এবং তিনি ছিলেন চৈতন্যপূর্বযুগের কবি। তাঁর কাব্যের একটি অনুলিপির কাল ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দ। চন্ডীমঙ্গলের দুজন শ্রেষ্ঠ কবি হলেন দ্বিজ মাধব ও  মুকুন্দরাম। দুজনই ষোলো শতকের কবি এবং এঁদের হাতেই চন্ডীমঙ্গল মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুজনের কাব্যই বৈষ্ণব ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। দ্বিজ মাধবের কাব্যের রচনাকাল ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ। এতে চন্ডীমঙ্গলের কাহিনী সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছে এবং বৈষ্ণব পদাবলির অনুসরণে ছোট ছোট গীতিকবিতা সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

মুকুন্দরাম সমগ্র মঙ্গলকাব্যধারার শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। তাঁর কাব্যে ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপঞ্জি একটি সার্বজনীন রূপ লাভ করেছে। মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, লাঞ্ছনা-উপভোগ ইত্যাদি বিপরীতধর্মী বৃত্তিগুলির অপূর্ব মিশ্রণে তিনি বিরল সমন্বয়শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। এর ফলে চরিত্রগুলিতে যে জীবনমুখিতার সৃষ্টি হয়েছে তা সর্বকালের মানবপ্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

চন্ডীমঙ্গল ধারায় আরেকখানা গ্রন্থ আছে দ্বিজ রামদেবের অভয়ামঙ্গল। গ্রন্থটি চট্টগ্রাম অঞ্চলে রচিত এবং এতে ঐ অঞ্চলের ভাষার প্রভাব আছে। এতে ‘ফেরাঙ্গি’ শব্দের উল্লেখ থাকায় পোর্তুগিজ আগমনের পরে সতেরো শতকের মাঝামাঝি এটি রচিত হয়েছে বলে মনে করা হয়। কাব্যে দ্বিজ মাধবের প্রভাব আছে।

চন্ডীর বহু নামের মধ্যে একটি হলো ‘অন্নদা’। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র এ নামেই তাঁর বিখ্যাত কাব্য অন্নদামঙ্গল রচনা করেছেন। অবশ্য এটিকে কেউ কেউ মঙ্গলকাব্য বলতে চান না। এর কারণ মঙ্গলকাব্যের সঙ্গে এর পার্থক্য নানা দিক থেকে। যেমন, চন্ডীমঙ্গলের চন্ডীর যে চন্ডমূর্তি, অন্নদামঙ্গলে তা দেখা যায় না। এখানে তিনি অভয়া, বরদা ও অন্নপূর্ণারূপে যেন একজন স্নেহময়ী বঙ্গজননী। অন্যান্য চন্ডীমঙ্গলে পূজা পাওয়ার জন্য চন্ডীর যে কোপনা স্বভাব, এখানে তা নেই; এখানে তিনি দাক্ষিণ্যময়ী। হয়তো উদ্ভবের পর থেকে তিনশ বছর ধরে হিন্দুসমাজে চন্ডীর প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়েছে, তাই তাঁর মধ্যে উগ্রতা পোষণের আর প্রয়োজনীয়তা ছিল না। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আরেকটি বিষয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, নতুন করে কেউ কোথাও প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চাইলে সেখানে তাকে শক্তিপ্রয়োগ করতে হয় এবং প্রতিষ্ঠালাভ সম্পন্ন হলে অধীনস্থদের সর্ব প্রকারে প্রতিপালন করতে হয়। এমনিভাবে আরও অনেক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।

ভারতচন্দ্র ছিলেন আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ কবি এবং তাঁর অন্নদামঙ্গল এ সময়ের শ্রেষ্ঠ কাব্য। কাব্যটি তিন খন্ডে তিনটি স্বতন্ত্র কাহিনীতে পূর্ণতা লাভ করেছে। প্রথম খন্ডে শিবায়ন-অন্নদামঙ্গল, দ্বিতীয় খন্ডে বিদ্যাসুন্দর-কালিকামঙ্গল এবং তৃতীয় খন্ডে মানসিংহ-অন্নপূর্ণামঙ্গল কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। প্রথম উপাখ্যানের মূল ঘটনা পৌরাণিক। এতে সতীর দেহত্যাগ, পার্বতীর বিবাহ, শিবের সংসার ও কাশীতে দেবীর অন্নপূর্ণামূর্তি ধারণের বর্ণনা আছে। সেসঙ্গে যুক্ত হয়েছে হরিহোড়কে ছেড়ে দেবী কিভাবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের পিতৃগৃহে উপস্থিত হন সেই লৌকিক কাহিনী। দ্বিতীয়টি বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী। কালিকার কৃপায় কিভাবে সুন্দর বিদ্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন এবং মশান থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন সে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এখানে। তৃতীয় অংশটি অনেকটা ঐতিহাসিক। মানসিংহ কর্তৃক প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত ও বন্দিকরণ এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের নিকট থেকে ভবানন্দের ‘রাজা-ই-ফরমান’ লাভের ঘটনা এখানে বর্ণিত হয়েছে।

অন্নদামঙ্গল থেকে তৎকালীন বাঙালি সমাজের অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। দেবী ও ঈশ্বরী পাটনীর ঘটনা থেকে দেব-মানুষের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা জানা যায়। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’ দেবীর নিকট পাটনীর এই বর প্রার্থনার মধ্য দিয়ে অনুমান করা যায় যে, তখন ন্যূনপক্ষে দুধভাত খাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল বাঙালি জীবন-যাত্রার নিম্নতম স্ট্যান্ডার্ড। অন্নদামঙ্গলে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো এতে দৈবপ্রাধান্য কম, সে স্থান দখল করেছে মানুষ। এখানে দেবীর সন্তুষ্টিকামনা অপেক্ষা রাজার সন্তুষ্টিকামনা তীব্রতর। মূলত নদীয়ার রাজবংশের গৌরবময় ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে কবি সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে দৈব ঘটনা মিশিয়ে নগরসংস্কৃতিসুলভ একটি আদিরসাত্মক প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেছেন। এর সাহিত্যিক মূল্যও অসাধারণ। উপমাদি অলঙ্কার এবং ছন্দপ্রয়োগে তিনি যে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তাতে তাঁর মৌলিকত্ব প্রকাশ পেয়েছে।

ধর্মমঙ্গল  ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্যসূচক কাব্যধারা। ধর্ম অনার্য দেবতা এবং সূর্য কিংবা বুদ্ধের প্রতিরূপ হিসেবে কল্পিত। প্রাচীন বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে এঁর উদ্ভব ও পূজা সীমিত ছিল। ধর্মপূজা দীর্ঘকাল অন্ত্যজ শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত থাকায় সতেরো শতকের পূর্ব পর্যন্ত এতে কোন আর্যপ্রভাব পড়েনি এবং কোন আর্যপুরাণে ধর্মের কথা পাওয়াও যায় না। সতেরো শতকের পরে যুগপরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে ধীরে ধীরে পৌরাণিক ধর্মাদর্শের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে ধর্মঠাকুর পৌরাণিক দেবতার পর্যায়ভুক্ত হন।

ধর্মমঙ্গলের প্রচলিত কাহিনী লাউসেনের সংগ্রামী জীবনের কথা। রামপালের পুত্র যখন গৌড়ের রাজা তখন তাঁর শ্যালক মহামদ পাল ছিলেন রাজমন্ত্রী। মহামদের ভগ্নী রঞ্জাবতীর সঙ্গে বৃদ্ধ সামন্তরাজ কর্ণসেনের বিবাহ হয়। এদের পুত্রই লাউসেন। লাউসেনের সঙ্গে মহামদ ও ইছাই ঘোষের বিভিন্ন সময়ে দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বে ধর্মের কৃপায় লাউসেনের বিজয়, ধর্মের সঙ্গে বিবাদের ফলে মহামদের কুষ্ঠব্যাধি, লাউসেনের অনুরোধে ধর্ম কর্তৃক ব্যাধির নিরাময় এবং সবশেষে ধর্মপূজার মধ্য দিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি ঘটে।

ধর্মমঙ্গলের আদি কবি ময়ূর ভট্ট। তাঁর কাল খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক বা এর কাছাকাছি অনুমান করা হয়, কিন্তু তাঁর কাব্যের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তাঁর পরের কবি রূপরামের কাল ষোলো শতক এবং মাণিকরাম গাঙ্গুলির কাল সতেরো শতকের মধ্যভাগ ধরা হয়। ধর্মমঙ্গলের অপর একজন কবি সীতারাম দাসের কাব্য রচনার কাল ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দ মনে করা হয়। ধর্মমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। তাঁর কাব্যের রচনাকাল ১৭১১ খ্রিস্টাব্দ। কাব্যটি বীররসপ্রধান। এরপর আর যাঁরা ধর্মমঙ্গল রচনা করেছেন তাঁরা হলেন সহদেব (১৭৩৫), নরসিংহ (১৭৩৭), হূদয়রাম (১৭৪৯), গোবিন্দরাম (১৭৬৬?) প্রমুখ।

ধর্মমঙ্গলে রাঢ়ের জনজীবনের যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা অভিনব এবং তাতে বাঙালির জাতীয় মানসের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো এতে বাঙালি চরিত্র মেরুদন্ডহীন ও দৈবনির্ভররূপে চিত্রিত হয়নি, বরং রাজনৈতিক সঙ্ঘাত ও দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে দৃঢ়সংকল্প এবং অনমনীয় প্রতিশোধপরায়ণরূপে চরিত্রগুলি নির্মিত হয়েছে। মনসামঙ্গল ও চন্ডীমঙ্গলে কাহিনীর মূলকেন্দ্রে রয়েছে দেবতা, মানুষ সেখানে অনুষঙ্গ মাত্র; কিন্তু ধর্মমঙ্গলের মূল কাহিনী আবর্তিত হয়েছে মানুষকে কেন্দ্র করেই। এখানে আছে সামাজিক সঙ্ঘাত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দৈবঘটনার প্রাধান্য এখানে কম; বরং দৈবঘটনাকেই এখানে আনুষঙ্গিক বলা যায়। তৎকালীন রাঢ়ের রাজনৈতিক জীবনযাত্রা এবং সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষের গৌরবময় দেশাত্মবোধ ধর্মমঙ্গলকে অন্যান্য মঙ্গলকাব্য থেকে পৃথক করেছে এবং সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একে এক বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছে।

শিবায়ন বা শিবমঙ্গল  মৌলিক কোন ধারার মঙ্গলকাব্য নয়। মঙ্গলকাব্য রচনার যে উদ্দেশ্য কোন দেবতার পূজা প্রচার এ ক্ষেত্রে তাও লক্ষণীয় নয়। তবে শিব চরিত্রটি প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের মধ্যেই একটি অপরিহার্য যোগসূত্ররূপে উপস্থিত। হয়তো বাঙালির জীবনযাত্রার প্রতীকরূপেই শিব-পার্বতীর গার্হস্থ্য জীবন, তাঁদের দারিদ্র্যপীড়িত দাম্পত্য জীবনের মান-অভিমান ইত্যাদি সমস্ত মঙ্গলকাব্যের দেবখন্ডে মূল আখ্যানের ভূমিকারূপে চিত্রিত হয়েছে। এতে অবশ্য মঙ্গলকাব্যের জনপ্রিয়তাই বেড়েছে এবং এ অনুপ্রেরণা থেকেই শিবের নামে প্রচলিত সমস্ত লৌকিক ও পৌরাণিক কাহিনী সংগ্রহ করে একটি কোষগ্রন্থ প্রণীত হয়, যা পরবর্তীকালে শিবায়ন  বা শিবমঙ্গল  নামে পরিচিতি লাভ করে। তাই এতে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের মতো শিবের পূজা প্রচারের কোন প্রচেষ্টা লক্ষিত হয় না। অবশ্য তার আবশ্যকতাও নেই, কারণ শিব অন্যতম প্রাচীন দেবতা এবং সমাজে তিনি সুপ্রাচীনকাল থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। হয়তো এমনও হতে পারে যে, মনসা, চন্ডী ইত্যাদি নতুন দেবদেবীর আগমনে যাতে আদিদেবতা হারিয়ে না যান, তাঁর মর্যাদা যাতে অটুট থাকে সে উদ্দেশ্যেই শিবায়নের  সৃষ্টি।

শিবায়ন ধারার প্রথম কবি রামকৃষ্ণ রায় সতেরো শতকের প্রথম পাদে তাঁর কাব্য রচনা করেন। এতে প্রধানত পৌরাণিক শিবের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। শিবের সংসারের অভাব-অনটন এবং তা নিয়ে শিব-পার্বতীর মনোমালিন্য এখানে গতানুগতিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে ছন্দোবৈচিত্র্য, ভাষার সংযম এবং কিছু সাহিত্যিক গদের প্রয়োগ একে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। আঠারো শতকের প্রথম দিকে রচিত রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়নই সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয়। এতে শিবের লৌকিক চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে। শিবকে এখানে কৃষিকার্যরত, গার্হস্থ্যকর্মে উদাসীন এবং ভোজনরসিকরূপে দেখানো হয়েছে। এর ফলে কৃষকপ্রধান বাঙালি সমাজে শিব যেন একেবারে ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছেন; তাঁর রূপকে যেন বাঙালি চরিত্রই মূর্ত হয়ে উঠেছে। শিবের কৃষিচর্চার মধ্য দিয়ে তৎকালীন কৃষকজীবনের নানা সমস্যার কথাও জানা যায়।

এগুলি ছাড়া বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে আরও অনেক মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছে। যেমন, চৈতন্যের জীবনী অবলম্বনে ষোলো শতকে রচিত জয়ানন্দ ও লোচনদাসের  চৈতন্যমঙ্গল, আঠারো শতকে বিভিন্ন দেবদেবীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত সূর্যমঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, শীতলামঙ্গল, লক্ষ্মীমঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল, সরস্বতীমঙ্গল, রায়মঙ্গল, কালিকামঙ্গল, সারদামঙ্গল, গৌরীমঙ্গল, দুর্গামঙ্গল ইত্যাদি। এগুলিতে সমসাময়িক সমাজের রীতিনীতি, সংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস, জীবন-জীবিকা ইত্যাদির বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। [দুলাল ভৌমিক]