আহ্ছানউল্লা, খানবাহাদুর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৯:৩৭, ২২ জুন ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা

আহ্ছানউল্লা, খানবাহাদুর (১৮৭৩-১৯৬৫)  শিক্ষাবিদ, শিক্ষাসংস্কারক, সাহিত্যিক, ধর্মবেত্তা, সুফি, সমাজসেবক। ১৮৭৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা মুনশী মোহাম্মদ মুফিজউদ্দীন এবং মাতা আমেনা খাতুন। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তিনি নলতা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় ও টাকি গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। তিনি কলকাতার এলএমএস ইনস্টিটিউশন (লন্ডন মিশনারি স্কুল) থেকে ১৮৯০ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি লাভ করেন। তিনি হুগলি কলেজ থেকে ১৮৯২ সালে এফএ, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯৪ সালে বিএ এবং ১৮৯৫ সালে দর্শনশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এ সময় তিনি কলকাতার রিপন কলেজে আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন।

১৮৯৬ সালে আহ্ছানউল্লা তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সুপারনিউমারারি শিক্ষক হিসেবে। এখানে কয়েক মাস চাকরির পর তিনি ফরিদপুরের অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুল পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৮৯৮ সালে তিনি ডেপুটি ইন্সপেক্টরের স্থায়ী পদে নিযুক্ত হন। ১৯০৪ সালে তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯০৭ সালে তিনি ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। এরপর ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সি বিভাগের অতিরিক্ত ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হলে তিনি চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা চলে যান। তবে চট্টগ্রামে চাকরিকালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের (IES) অর্ন্তভুক্ত হন। অতঃপর তিনি শিক্ষাবিভাগের সহকারি ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। তিনি কিছুদিন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদ ডিরেক্টর হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯২৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।

আহ্ছানউল্লা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর এবং প্রায় দশ বছর সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ১৯১১ সালে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে। ওই বছর ২৮ জুন শিক্ষার প্রসারে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লন্ডনের ‘রয়্যাল সোসাইটি ফর দি এনকারেজমেন্ট অব আর্টস, ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড কমার্স’-এর সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তিনি এম.আর.এস.এ উপাধি লাভ করেন এবং ‘হুজ হু ইন ইন্ডয়া’ গ্রন্থে তাঁর জীবনী প্রকাশিত হয়।

সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরের চাকরিজীবনে আহ্ছানউল্লা একদিকে ছিলেন আদর্শবাদী ও কর্তব্যনিষ্ঠ, অন্যদিকে ছিলেন অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষা সম্প্রসারণে অত্যন্ত তৎপর। তিনি মুসলমানদের শিক্ষার উন্নয়নে নানাবিধ কল্যাণমুখী ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেন। তিনিই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচির মানোন্নয়ন করে মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষালাভের পথ উন্মুক্ত করেন। তিনি স্কুল ও কলেজে হিন্দু পন্ডিতের সমতুল্য মৌলবিপদ সৃষ্টি ও টেকস্টবুক কমিটিতে মুসলিম সদস্যপদ রাখার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া তিনি মক্তবের জন্য পৃথক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, মুসলিম ছাত্রদের জন্য মুসলিম গ্রন্থকারদের পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন ও বৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি, শিক্ষা বিভাগে কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মুসলমানদের বিশেষ সুবিধা প্রদান এবং শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানদের অগ্রগতির জন্য নানা বাস্তবমুখী প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। নিউ স্কিম মাদ্রাসা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অসামান্য।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা তাঁর সমগ্র জীবনকালে যেমন নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনি কলকাতার বিখ্যাত বেকার হোস্টেলসহ কলকাতা ও কলকাতার বাইরে অনেক ছাত্র-হোস্টেল স্থাপনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯২১ সালে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে উত্থাপিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পর্যালোচনার জন্য গঠিত স্পেশাল কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন আহ্ছানউল্লা।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা ছিলেন একজন সুফি ও নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং একটি উদার মুসলিম জীবনবাদী দর্শনের প্রবক্তা। তিনি ১৯১১ সালে কলকাতায় ‘মখদুমী লাইব্রেরী’ নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ লাইব্রেরি থেকেই বাংলা ভাষায় মুসলিম লেখক রচিত উপন্যাস  বিষাদ-সিন্ধু, আনোয়ারা ও মনোয়ারা প্রকাশিত হয়। ‘সষ্ট্রার এবাদত সৃষ্টির সেবা’ তথা সমগ্র মানব সমাজের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক সেবার মহান ব্রত নিয়ে তিনি ১৯৩৫ সালের ১৫ মার্চ স্বীয় গ্রাম নলতায় প্রতিষ্ঠা করেন  আহ্ছানিয়া মিশন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা (১৯৫৮), চট্টগ্রাম (১৯৫৯) ও হবিগঞ্জে (১৯৬১) আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। বর্তমানে দেশে-বিদেশে আহ্ছানিয়া মিশনের তিন শতাধিক রাখা রয়েছে।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, আত্মজীবনী, ধর্ম ও সৃষ্টিতত্ত্ব, রাসুলের (স.) জীবনী এবং পাঠ্যপুস্তকসহ ৭৯টি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত আমার জীবনধারা (১৯৪৬) বাংলা ভাষায় আত্মজৈবনিক রচনাসমূহের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তাঁর ভাষা প্রাঞ্জল ও হূদয়গ্রাহী। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো: পদার্থ বিদ্যা (১৯০৫), বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য (১৯১৮), ইসলাম ও আদর্শ মহাপুরুষ (১৯২৬), হেজাজ ভ্রমণ (১৯২৯), হজরত মোহাম্মদ (স.) (১৯৩১), শিক্ষাক্ষেত্রে বঙ্গীয় মোছলমান (১৯৩১), History of the Muslim World (১৯৩১), ইছলামের ইতিবৃত্ত (১৯৩৪), মোস্তফা কামাল (১৯৩৪), ভক্তের পত্র (১৯৩৬), তরিকত শিক্ষা (১৯৪০), বাঙ্গালা সাহিত্য (১৯৪৮), ভারতের ইতিহাস (ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্বলিত) (১৯৪৯), ইসলামের মহতী শিক্ষা (১৯৪৯), ইছলামের দান (১৯৫৮) ইত্যাদি। রায়সাহেব শ্রী অচ্যুতনাথ অধিকারী সহযোগে রচিত তাঁর Teachers Manual (১৯১৫) শিক্ষাদান পদ্ধতির এক আকরগ্রন্থ।

খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা সমাজসেবা, মানবকল্যাণ ও ইসলাম ধর্ম প্রসারের জন্য এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য যেমন প্রভূত অবদান রেখেছেন, তেমনি তৎকালীন সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গেও নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। তিনি একই সময়ে  বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি এবং বাংলা সাহিত্য সমিতির ১৯১৭-১৮ সালের নির্বাহী পরিষদের সহসভাপতি ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ সালে তিনি বাংলা একাডেমীর ফেলো মনোনীত হন। তাঁর নামে ঢাকাসহ দেশের নানা স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত হাসপাতাল। ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরা জেলার নলতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  [শফিউল আলম]