গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ

Nasirkhan (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৬:১৬, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Text replacement - "\[মুয়ায্যম হুসায়ন খান\]" to "[মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]")
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ  বাংলার সুলতান। তিনি ছিলেন সুলতান শামসুদ্দিন ফিরূয শাহের পুত্র এবং মসনদে তাঁর উত্তরাধিকারী। ফিরূয শাহের শাসনকালেই গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরসহ তাঁর তিন পুত্র পূর্ণ রাজকীয় খেতাবসহ লখনৌতির টাকশাল থেকে নিজেদের নামে মুদ্রা জারি করেন। গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর ৭১০ হিজরি (১৩১০ খ্রি) থেকে ৭১৩ হিজরি (১৩১৩ খ্রি) পর্যন্ত সময়ে নিজ নামে মুদ্রা জারি করেন। পিতার সঙ্গে পুত্রদের যুগপৎ মুদ্রা জারি বস্ত্তত ছিল শাহজাদাদের প্রশাসনে সম্পৃক্তকরণ এবং পুত্রদের সঙ্গে পিতার সার্বভৌম ক্ষমতার অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা। তা সত্ত্বেও উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গে আধিপত্য বিস্তারে পুত্রদের মধ্যে সম্ভাব্য প্রতিযোগিতাকে কিন্তু কোনোভাবেই নাকচ করা যায় না। মনে হয়, এ প্রতিযোগিতায় বাহাদুর শাহ ১৩১৭ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় পূর্ব বাংলায় সরে যেতে বাধ্য হন এবং সেখানে তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এ অঞ্চল শাসন করতে থাকেন। তিনি ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁয়ের টাকশাল থেকে নিজ নামে মুদ্রা জারি অব্যাহত রাখেন। পিতার মৃত্যুর পর বাহাদুর শাহ লখনৌতির মসনদ দখল করেন এবং আত্মগোপনে থাকা নাসিরউদ্দিন ইবরাহিম ব্যতীত অপর সব ভাইদের হত্যা করেন। বাহাদুর শাহ 'আল-সুলতানুল আযম গিয়াস-উদ-দুনিয়া ওয়াদ-দ্বীন আবুল মুজাফফর বাহাদুর শাহ আল-সুলতান বিন আল-সুলতান' উপাধি গ্রহণ করেন।

নিরাপত্তার প্রশ্ন ও রণকৌশল হিসেবে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ একটি নতুন সুরক্ষিত নগরের পত্তন করেন। তাঁরই নামে এই নগরের নামকরণ হয় কসবা গিয়াসপুর। এই নগর থেকে তিনি ৭২২ হিজরিতে (১৩২২ খ্রি) মুদ্রা জারি করেন। কসবা গিয়াসপুরের অবস্থান বর্তমান ময়মনসিংহ শহরের ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গ্রাম এনায়েতপুরের সঙ্গে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। এই এনায়েতপুর গ্রামটি স্থানীয় লোকদের নিকট এখনও খায়াসপুর নামে পরিচিত। দক্ষ যোদ্ধা ও রাজনীতিক বাহাদুর শাহ দিল্লি সুলতানের তরফ থেকে বিপদের আশঙ্কা অাঁচ করতে পারেন। তিনি বুঝতে পারেন যে, লখনৌতি নগরের দুর্ভেদ্য রক্ষাব্যুহ সত্ত্বেও পশ্চিমাঞ্চল থেকে আক্রমণকারী কোনো শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই নগর সামরিক দিক দিয়ে মোটেও উপযোগী নয়। বরং গিয়াসপুর থেকে একদিকে লখনৌতি ও সোনারগাঁ এবং অন্যদিকে তাঁর পিতা  ফিরূয শাহ কর্তৃক সিলেটের বিজিত অংশের উপর নজর রাখা সহজতর।

লখনৌতি ও সোনারগাঁ অঞ্চলের একচ্ছত্র অধিপতি গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহকে লখনৌতিতে তাঁর ক্ষমতা লাভের দুই বছরের মধ্যেই দিল্লি সুলতানের আক্রমণের মোকাবিলা করতে হয়। দিল্লির সুলতান  গিয়াসউদ্দিন তুগলক ত্রিহুত ও বাংলা বিজয়ের লক্ষ্যে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে এক অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে অযোদ্ধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন এবং কুশি নদী পার হয়ে শিবির স্থাপন করেন। এখানে তিনি প্রায় দুই মাস কাল অবস্থান নেন। এখানে সুলতান ফিরূয শাহের পুত্র নাসিরউদ্দিন ইবরাহিম লখনৌতির কতিপয় অভিজাত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁর ভাই বাহাদুর শাহকে উৎখাত করার জন্য সুলতানের নিকট সামরিক সাহায্য চান। সুলতান তাঁর পরাক্রমশালী সেনাপতি তাতার খানের সার্বিক নেতৃত্বে অবিলম্বে লখনৌতি অভিমুখে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। তাতার খান এক বিশাল বাহিনী নিয়ে নাসিরউদ্দিন ইবরাহিমসহ লখনৌতি অভিমুখে অগ্রসর হন এবং অচিরেই লখনৌতির উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করেন।

এদিকে দিল্লির রাজকীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রার সংবাদ পেয়ে বাহাদুর শাহ দ্রুত লখনৌতি পৌঁছে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন। তাতার খানের অধীনে শাহী বাহিনী লখনৌতির উপকণ্ঠে পৌঁছতেই বাহাদুর শাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন।

পরদিন বাহাদুর শাহের বাহিনীর অবস্থানস্থলের কাছাকাছি দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। বাহাদুর শাহ প্রথম আক্রমণ পরিচালনা করেন। আক্রমণের প্রাক্কালে তিনি স্বগতোক্তি করেন: ‘আজকের এই দিনটি যেন আমার নিকট ঈদ-উৎসবের দিন, কেননা এদিনে আমি দিল্লির বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করছি। এমন দক্ষতার সঙ্গে আমাকে অসি চালনা করতে হবে যাতে আমার রণনৈপুণ্যের খ্যাতি  দিগবিদিক ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে আমাকে সুনাম অর্জন করতেই হবে, কেননা একজন যোদ্ধার নাম ওই যোদ্ধার চেয়েও লোকের নিকট বেশি পরিচিত।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে মধ্য ব্যুহ থেকে যালচির অধীনে শাহী বাহিনীর উপর ত্বরিত আক্রমণ চালান। ডান ব্যুহ থেকে তাতার জাশগোরী দ্রুত যালচির সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং তারা যৌথভাবে আক্রমণ প্রতিহত করেন। এরপর বাহাদুর শাহ শত্রু বাহিনীর বাম অংশের উপর এমন প্রবল আক্রমণ চালান যে, নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ও শাহীন আখুর বেগের বাহিনী পশ্চাদপরণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু শাহী বাহিনী অচিরেই তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করে বাহাদুর শাহের বাহিনীর উপর এমন প্রচন্ড আক্রমণ চালায় যে, তাদের মধ্যে সংশয় ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বাহাদুর শাহ যখন তাঁর সৈন্যদের মধ্যে শোরগোল শুনতে পান তখন তাঁর পশ্চাদপসরণ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। বাহাদুর শাহ পিছু হটে কিছুদূর যাওয়ার পরই শাহী সৈন্যরা একযোগে তাঁর সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালায়। স্বল্পকাল প্রতিরোধের পর তাঁর সৈন্যরা রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। শাহী সৈন্যরা পলায়নপর সৈন্যদের ধাওয়া করে এবং পেছন থেকে হুড়কা ছুড়ে তাদের অনেকের গলায় ফাঁস লাগিয়ে আটকে ফেলে।

বাহাদুর শাহ স্থলপথে পূর্ব বাংলার দিকে পশ্চাদপসরণ করেন। তিনি তাঁর দুর্ভেদ্য নগর গিয়াসপুরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাতার খান তখন হাবিবউল্লাহ খান কাসুরির নেতৃত্বে একটি সেনাদল বাহাদুর শাহকে অনুসরণের জন্য পাঠান। একটি নদী পার হওয়ার সময় বাহাদুরের ঘোড়ার পা কাদায় আটকে যায় এবং তিনি ঘোড়াসহ নদীতে পড়ে যান। অনুসরণকারী শাহী সৈন্যরা তাঁকে আটক করে তাতার খানের নিকট নিয়ে যায়। তাতার খান তাঁকে বন্দী করে যুদ্ধে অধিকৃত সব হাতীসহ কুশি নদীর তীরে সুলতানের শিবিরে হাজির করেন।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলক দিল্লি ফেরার প্রাক্কালে নাসিরউদ্দিন ইবরাহিমকে লখনৌতির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি সোনারগাঁ ও সাতগাঁ অঞ্চল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে তাতার খানকে এ অঞ্চলের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। বাহাদুর খানকে বন্দী অবস্থায় দিল্লিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

দিল্লির পরবর্তী তুগলক সুলতান মুহম্মদ তুগলক ছিলেন খুবই বিচক্ষণ ও কূটকৌশলী। সিংহাসনারোহনের পরই সম্ভবত তিনি বাংলায় তাতার খান ও সুলতান নাসিরউদ্দিন ইবরাহিমের পক্ষ থেকে কোনো বিরোধিতার সম্ভাবনা অাঁচ করেন, কেননা এরা দু’জনই ছিলেন তাঁর নিহত পিতা কর্তৃক নিযুক্ত শাসক এবং তাঁর পক্ষীয় লোক। বাংলার এই দুই শাসনকর্তার উচ্চাভিলাষ প্রশমনের লক্ষ্যে তিনি প্রতিরোধ ও ভারসাম্য রক্ষার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহকে কারাগার থেকে মুক্ত করে (১৩২৫) উচ্চ রাজকীয় মর্যাদায় ভূষিত করেন এবং সোনারগাঁয়ে ফেরত পাঠান। বাহাদুর শাহের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয় যে, সুলতানের প্রতিনিধি হিসেবে তাতার খানের সহযোগিতায় একজন অধীনস্থ শাসক হিসেবে তিনি সোনারগাঁ অঞ্চল শাসন করবেন। বাহাদুর শাহ সুলতানের প্রতি অনুগত থাকার এবং তাঁর পুত্র মুহম্মদ ওরফে বারবতকে সুলতানের দরবারে প্রতিভূ হিসেবে প্রেরণের অঙ্গীকার করেন। প্রথমদিকে বাহাদুর শাহ তাঁর জারিকৃত মুদ্রায় দিল্লি সুলতানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন, কিন্তু তিনি তাঁর পুত্রকে প্রতিভূ হিসেবে সুলতানের দরবারে প্রেরণে বিরত থাকেন। বাহাদুর শাহ ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দ (৭২৮ হিজরি) পর্যন্ত নিজের ও মুহম্মদ তুগলকের যৌথ নামে সোনারগাঁ টাকশাল থেকে মুদ্রা জারি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু সোনারগাঁয়ের শাসনকার্য পরিচালনায় সুলতান কর্তৃক শাহী সেনানায়ক তাতার খানকে তাঁর সঙ্গে যুক্ত করার মতো কুটনৈতিক অবিশ্বাসকে তিনি কোনোক্রমেই সহজভাবে মেনে নিতে পারেন নি।

মুলতানে কিসলু খানের বিদ্রোহ দমনে সুলতান মুহম্মদ তুগলকের ব্যস্ততার সুযোগে সোনারগাঁয়ের শাসক বাহাদুর খান সমগ্র বাংলায় আধিপত্য বিস্তারে প্রয়াসী হন, এবং ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে (৭২৮ হিজরি) সোনারগাঁ টাকশাল থেকে স্বীয় নামে মুদ্রা জারি করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাতার খান প্রাথমিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন এবং দিল্লি থেকে তাঁর সাহায্যে দিলজাই তাতারের অধীনে এক বাহিনী এসে পৌঁছার পর তিনি বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধে বাহাদুর শাহ পরাজিত হয়ে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন। শাহী বাহিনী তাঁর পশ্চাদনুসরণ করে। পলায়নকালে একসময় নদী অতিক্রমকালে তাঁর ঘোড়ার পা কাদায় আটকে গেলে তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শাহী সৈন্যরা নদী থেকে তাঁকে আটক করে তাতার খানের নিকট হাজির করে।

জীবন্ত অবস্থায় বাহাদুর শাহের দেহের চামড়া ছুলে তাতে খড়কুটা পুরে তৈরি করা হয় কুশপুত্তলিকা। আর সেই কুশপুত্তলিকা পাঠিয়ে দেয়া হয় দিপালপুরে সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলকের দরবারে। কিসলু খানের বিদ্রোহ দমন করে সুলতান তখন দিপালপুরে অবস্থান করছিলেন। সুলতানের নির্দেশে বাহাদুর খান ও কিসলু খানের কুশপুত্তলিকা দিপালপুর দুর্গের দেয়াল প্রাকারে পাশাপাশি লটকিয়ে দেয়া হয়। সুলতান তখন নিজেই কৌতুকভরে মন্তব্য করেন, ‘এযে একই নারকেলের খোলে যুগল শাঁস।’

এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটে বাহাদুর শাহের দুর্ধর্ষ জীবন চরিতের, আর তাঁরই সাথে অবসান হয় বাংলায় স্বল্পকালীন নব্য মামলুক শাসনের। তাঁর প্রথম ক্ষমতা লাভের সন তারিখ পুরোপুরি অস্পষ্ট রয়ে গেলেও একজন স্বাধীন নরপতি হিসেবে বাহাদুর শাহের শাসনের সূচনাকাল ১৩১৭ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারণ করা যায় এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটে ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে। সোনারগাঁ ও লখনৌতিতে তাঁর মোট শাসনকাল এগারো বছর।  [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]

গ্রন্থপঞ্জি Muazzam Hussain Khan, Thousand Years of Sonargaon, Dhaka, 2009.