হাওর ও জলাভূমি
হাওর ও বিল (Haors and Beels) জলাশয় সমূহ বর্ষা আসার পরপরই বাংলাদেশের প্লাবনভূমির একটা বিরাট অংশ পানিতে ডুবে যায় এবং প্রায় চার থেকে ছ’মাস পানিতে ডুবে থাকে। যেসকল স্থান সারাবছর পানির নিচে থাকে যথা নদী, হাওর, বাওড় এবং বিল, এগুলি তার অতিরিক্ত। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ নিম্নভূমিগুলির একেকটি হাওর নামে পরিচিত। এই এলাকা ভূতাত্বিক ’ডাউকী চ্যুতি’র কারণে ক্রমশঃ বসে গিয়ে নিচু হয়ে গেছে। সুদূর অতীতে বঙ্গোপসাগরের তীর মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে এসে ঠেকতো। ব্রহ্মপুত্র নদ এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের নদীগুলি দিয়ে বয়ে আসা পলি এই নিম্নভূমিকে ভরাট করছিলো, কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদ তার প্রবাহ পথ পশ্চিম দিকে সরিয়ে নিয়েছে। হাওর এবং ঐসকল নিম্নভূমিগুলি শীতকালে শুকিয়ে যায়, কিন্তু এদের মধ্যে অনেক বিল আছে, যেগুলি জলাশয় হিসেবে সারা বছর পানিতে ভরা থাকে। বাওড়গুলি হচ্ছে গঙ্গা নদীর বড় বড় শাখানদী যথা ভৈরব, কালিগঙ্গা, গড়াই ও কুমার নদের পরিত্যক্ত বাঁক। এই বাওড়গুলির সাথে অতীতে তাদের মূল নদীর প্রবাহের নিষ্কাশন সংযোগ ছিলো। কিন্তু ঐ মূল নদীগুলির মৃত্যুর কারণে অধিকাংশ বাওড় এখন সংযোগ হারিয়ে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে।
বিল নামের নিম্নভূমিগুলি সারা দেশে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, বিশেষ করে বড় নদীগুলোর প্লাবনভূমিতে এবং তাদের বদ্বীপ অঞ্চলে। গঙ্গা নদীর তার গতিপথ পরিবর্তন করে তিনটি বিশাল নিম্নভূমি এলাকা রেখে গেছে, এর একটি উত্তর পশ্চিমে (চলন বিল), অন্যটি মধ্য অঞ্চলে (আড়িয়াল বিল), এবং অন্যটি দক্ষিণ পশ্চিমে (গোপালগঞ্জ এলাকা)। নদীগুলোর গতি পরিবর্তন এবং ভূমি বসে যাওয়া উভয় কারণেই নিম্নভূমিগুলি গঠিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদীর গতি পরিবর্তন মেঘনা নদীর গতিপথের দু’ধারে নিম্নভূমি রেখে গেছে। এইসকল এলাকা বর্ষা ও শরৎকালে পানির তলায় চলে যায়। উপকূলীয় নিম্নভূমিগুলির অধিকাংশ বেড়ী বাঁধ দিয়ে ঘিরে পোল্ডার করা থাকে। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমে সুন্দরবন অবস্থিত যা’ দেশের সবচেয়ে বড় জলাভূমি এলাকা। এখানে অজস্র খাল এবং নদী ছড়িয়ে আছে, যারা জোয়ারের সময় সাগরের লোনা পানি বয়ে নিয়ে আসে। এখানে নানা ধরনের গাছপালা ও গুল্ম জন্মায় যারা লোনা পানি সহ্য করতে পারে। এখানে সাগর এবং খাড়ি উভয় পরিবেশের মাছ পাওয়া যায়, এবং কিছু কিছু জাতের মাছ কেবল এখানেই পাওয়া যায়।
জাতীয় পানিনীতি হাওর, বাওড়, এবং বিলগুলি একসময় মাছে পরিপূর্ণ ছিলো এবং জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীর সমাহারে এই দেশে এক বিশেষ প্রকৃতি ও প্রতিবেশ তৈরী করতো। কিন্তু মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এগুলি নিষ্কাশিত করে চাষযোগ্য করা হয়েছে, এবং আগাম বন্যায় ফসল যাতে না ডুবতে পারে সেজন্যে চারপাশে বাঁধ দিয়ে ঘেরা হয়েছে। এসব প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করেছে, মাছ হারিয়েছে, পাখী এবং জলজ জীবন হারিয়েছে। এই ব্যবস্থা অনেক দু®প্রাপ্য পাখী ও জলজ প্রাণীর বংশ নিশ্চিহ্ন করেছে। বাংলাদেশ সরকার তার জাতীয় পানি নীতি ১৯৯৯ এর ৪.৯ ধারায় হাওর ও জলাভূমির যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের রামসার, ইরান এর জলজপাখী বিষয়ক ঐকমত্য এবং ১৯৯২ সালের রিও, ব্রাজিল এর জীববৈচিত্র বিষয়ক ঐকমত্য এর প্রতি সম্মতি দেয়ায় হারিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী এবং নিবেদিত। জাতীয় পানি নীতির ৪.১৩ ধারায় হাওর, বাওড় এবং বিলগুলির গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, এবং এগুলি সংরক্ষণের জন্যে সরকারের নীতি বিবৃত করা হয়েছে।
মৌসুমী জলাভূমি বাংলাদেশে গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত বৃষ্টিপাতের কম বেশীর কারণে এর জলাভূমিগুলি আকারও সারাবছর মৌসুমওয়ারী কম বেশী হতে থাকে। শীত ও বসন্তে বৃষ্টিপাত সবচেয়ে কম; তাই মার্চ মাসের মধ্যে সারাদেশের নিম্নভূমি ও হ্রদগুলো থেকে পানি নিষ্কাশিত হয়ে একেবারে তলায় চলে যায়। এপ্রিল মাসে কালবৈশাখীর বৃষ্টিতে আবার এসব নিম্নভূমিগুলি ভরাট হতে শুরু করে। এই মৌসুমে কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত হলে উত্তর পূর্বের নদীগুলোতে আগাম বন্যা দেখা দেয়। যেহেতু হাওর এলাকাগুলির ভূমির উচ্চতা অনেক কম, তাই আগাম বন্যা যে সকল স্থানে বাঁধ নেই সেসকল স্থান ভরাট করে ফেলে। যদি বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে যায়, তাহলে অল্প উচ্চতার বাঁধগুলি ডুবে যায়, এবং বাঁধের ভেতরের বোরো ফসল ডুবে যায়, এভাবে দেশের সমূহ ক্ষতি হয়ে যায়। মৌসুমী বন্যা আসে বাংলাদেশের দু’টি বড় নদী, গঙ্গা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানির উচ্চতা বাড়লে। এটি হয় বর্ষা ও শরৎকালে। যদিও বন্যা প্রতিরোধ বাঁধ দেশের বিশাল এলাকা রক্ষা করে, নদীর পানির স্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া বাঁধের বাইরের জমিকে ডুবিয়ে দেয়, যা’ দেশের প্রায় ২০% এলাকা। এভাবে বর্ষা ও শরৎ কালে মৌসুমী জলাভূমি ১০% স্থায়ী জলাভূমির সাথে মিলে দেশের স্বাভাবিক জলাভূমি দাঁড়ায় ৩০% এলাকা।
প্রধান জলাভূমিসমূহ দেশের প্রধান জলাভূমিগুলি সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত, যেখানে টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সবচেয়ে নিচু এলাকা। সুনামগঞ্জ জেলার অন্যান্য জলাভূমিগুলির নাম হচ্ছে, সাংগাইর, জেয়ালডোবা, কালনার, খাই, দেখার, নান্দাইর, নলুয়ার, চাপতির, কালিকোটা, ভরমোহনা, হালির, পাগনার, আঙ্গুরালি, করচার, শনির, মাতিয়ান, গুরমের, কানামাইয়া, পশুয়া এবং রুই হাওর। সিলেটের প্রধান জলাভূমি হচ্ছে, হাইলকার, জিলকার, পাথরচাউলি, জৈনকার, চাউলধানি, বালাই, মুরিয়া, এরালি এবং দামরির হাওর। মৌলবীবাজার জেলার প্রধান জলাভূমি হচ্ছে, হাকালুকি, কাওয়াদিঘি, কারাইয়া এবং হাইল হাওর। হবিগঞ্জ জেলার প্রধান জলাভূমি হচ্ছে, গুইঙ্গাজুরি, মকর, সোনাডুবি এবং আমাদির হাওর। নেত্রকোণা জেলার প্রধান জলাভূমি হচ্ছে, ঘোড়াডোবা, সিঙ্গের, ডিঙ্গাপোতা, মূরালী, এবং করমোহুরী হাওর। কিশোরগঞ্জ জেলার প্রধান জলাভূমি হচ্ছে, বড় দিঘা, ঢাকির, গোপ দিঘী, বাদলা, সোনাবান্ধা, ধনপুর এবং হুমাইপুর হাওর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রধান জলাভূমি হচ্ছে, মেদির, পত্তন এবং আকাশি শাপলা হাওর। হাওর ছাড়াও দেশব্যাপী বেশ কিছু বড় বিল আছে যথা, চাঁদপুরে ঘুঘুরাজলা, খুলনার বিল ডাকাতিয়া, সাতক্ষীরার মথুরা বিল, বাগেরহাটের কেন্দুয়া বিল, গোপালগঞ্জের বাঘিয়া বিল, পিরোজপুরের চাতার বিল, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভেওয়া বিল, রাজশাহী ও নাটোরের চলন বিল, সিরাজগঞ্জের লাউতরার পাথার, পাবনার ঘুঘুদহ বিল ও গন্ডহস্তী বিল এবং ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জের আড়িয়াল বিল।
জলাভূমির মাটি মৌসুমী জলাভূমিগুলি যেহেতু নদীর প্লাবনভূমি, তাই এগুলি বালিমাটি বা পলিমাটি বা উভয়ের মিশ্রিত মাটিতে পূর্ণ থাকে। এর কোন কোন অংশে কাদামাটি থাকে যা’ নদীবাহিত হয়ে কোন অংশে এসে জমে। কিন্তু বছরব্যাপী জলাভূমিতে থাকে জৈব উপাদানে পরিপূর্ণ কাদামাটির পুরু স্তর। এর কারণ নদী দূরবর্তী উৎস থেকে সুক্ষ্ম কণা ও কাদা বহন করে এনে নদী থেকে দূরে অভ্যন্তরীণ নিম্নভূমিতে জমা করে। বছরব্যাপী জলাভূমিতে আরও জমে ভাসমান জৈব পদার্থ এবং জলজ উদ্ভিদের মরা ফসিল। যে সকল মাটিতে ফসিলের পরিমাণ বেশী সেসকল মাটিকে পিট কয়লা মিশ্রিত মাটি বলা হয়। এগুলি মরা গাছপালার অর্ধকার্বনিকৃত অশক্ত স্তর, যার মধ্যে ৬০% কার্বন এবং ৩০% অক্সিজেন থাকে। দেশের দু’টি এলাকা, যথা, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল, খুলনা, বাগেরহাট এবং পিরোজপুর এলাকা এবং সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ এলাকায় পিট কয়লার মাটি ভূমির কাছাকাছি কয়েক মিটার গভীরেই পাওয়া যায়। পিট কয়লার মাটি কখনো অন্যান্য জলাভূমিগুলির চারপাশেও কিছুটা পলি বা বালিমাটির তলায় পাওয়া যায়। এগুলি হয় যখন পার্শ্ববর্তী নদী তার প্রবাহপথ ত্যাগ করে নিকটে আসে, এবং বন্যার সময় বালি ও পলি বহন করে এনে ফসিল মাটিকে চাপা দেয়।
জলাভূমির উদ্ভিদ হাওর এলাকার উদ্ভিদ এরকম যে, তারা পানির তলায় বাঁচতে পারে, অথবা দীর্ঘ বন্যায় টিকে থাকতে পারে। কিছু কিছু উদ্ভিদ দেশের অন্যান্য এলাকার নিম্নভূমিতেও পাওয়া যায়। ডুবে যাওয়া উদ্ভিদগুলি হচ্ছে, পানিকোলা, ঘেচু; ভাসমান উদ্ভিদ হচ্ছে, কচুরিপানা, কুরিপানা; শিকড় গাড়া উদ্ভিদ হচ্ছে, শাপলা, পানিফল, মাখনা; প্লাবনভূমির উদ্ভিদ হচ্ছে, বিন্না, খাগ, নলখাগড়া; জলাভূমির বন হচ্ছে, হিজল, করচ, বরুণ ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল আছে, যেসব স্থান জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে ডুবে যায়। এর অধিকাংশ এলাকা বাঁধ দিয়ে ঠেকানো হয়েছে। যেসকল এলাকা ঠেকানো নেই সেখানে বাদাবন আছে। দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন এই রকমই একটি বন।
জলাভুমির পাখি উত্তর পূর্বাঞ্চলের জলাভুমিগুলি পরিযায়ী পাখিদের আবাস স্থল হিসেবে বিশ্ব বিখ্যাত। এই বিখ্যাত জলাভূমিগুলি হচ্ছে, টাঙ্গুয়ার হাওর, পশুয়া বিল, গুরমের হাওর, কাকালুকি হাওর, খালিয়াজুরি এলাকা, কোম্পানীগঞ্জ এলাকা, বড় হাওর, কাওয়াদিঘী হাওর এবং বালাই হাওর। রামসার কনভেনশন যা’ জলজ পাখির আবাসস্থল হিসেবে জলাভূমিগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে, তা’ ছিলো ১৯৭১ সালে ইরানের রামসারে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সভার ফল। এই কনভেনশন জলাভূমিতে পাখি গণনার এটি বিশেষ সীমা চূড়ান্ত করে যার ভিত্তিতে কোনগুলিকে আন্তর্জাতিক গুরুত্ব দেয়া যায়। এগুলি হলো যখন কোন জলাভূমি নিয়মিতভাবে ২০,০০০ জলজ পাখি ধারন করে; অথবা নিয়মিতভাবে কয়েকটি পরিবারের বহু সংখ্যক পাখি ধারন করে, যা’ ঐ জলাভূমির গুরুত্বের লক্ষণ, বৈচিত্র এবং ক্ষমতা বিষয় নির্দেশ করে; অথবা যেখানে পাখির গণনা করা হয়, এবং দেখা যায় ঐ জলাভূমি কোন জলজ পাখি পরিবারের ১% পাখির নিয়মিত আবাসস্থল। ফ্লাড একশন প্লান করার সময় (ফ্যাপ ৬) উত্তর পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় ফেব্র“য়ারী-মার্চ ১৯৯২ এবং এপ্রিল-মে ১৯৯২ দু’টি পাখি গণনা করা হয়। দেখা যায়, কেবলমাত্র দু’টি এলাকা যথা, টাঙ্গুয়ার হাওর এবং হাকালুকি হাওর ২০,০০০ এর বেশী জলজ পাখি ধারন করে। টাঙ্গুয়ার হাওর এবং সুন্দরবনকে সংরক্ষণ করার জন্য বর্তমানে তারা রামসার সাইট হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০০ সালে হাকালুকি হাওরকে এর জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য Environmentally Critical Area হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
Bangladesh Birds Club ১৯৮৭ সাল থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পাখি এলাকায় পাখি গণনা করে। এরা ২০০২ থেকে ২০০৪ সালে মোট ৬১টি এই ধরনের সাইটে পাখি গণনা করে যা’ ২০০৭ সালে Wetlands International, Malaysia এর Asian Waterbird Census শীর্ষক বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই ৬১টি সাইটের মধ্যে ২৭টি বরিশাল, ১০টি চট্টগ্রাম, ৭টি ঢাকা, ২টি খুলনা, ৫টি রাজশাহী এবং ১২টি সিলেট বিভাগে অবস্থিত। বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব ২৯৪,৮০৮টি পাখি ২০০২ সালে ৩৩টি সাইটে, ৪২৮,৬৭৪টি পাখি ২০০৩ সালে ৩০টি সাইটে এবং ৫৭০,৮৯৩টি পাখি ২০০৪ সালে ৪২টি সাইটে গণনা করে। তারা এই গণনায় ১০৫টি প্রজাতির জলজ পাখি, ৭টি প্রজাতির মাছরাঙ্গা এবং ১১টি প্রজাতির শিকারী পাখির সন্ধান পায়। তারা দেখে, জলজ পাখিদের প্রধান হুমকিগুলি হচ্ছে অগ্রসরমান কৃষি, জলাভূমির নিষ্কাশন, দেশীয় গাছপালা বিদায় করে দিয়ে বিদেশী গাছপালা লাগানো এবং অবৈধভাবে পাখি ধরা এবং মারা।
জলাভূমির ফসল বাংলা পঞ্জিকা একটি স্পষ্ট ফসলী পঞ্জিকা, যা’ চার মাস করে আউশ, আমন এবং রবি নামের তিনটি ফসলী মৌসুমে ভাগ করা আছে। ঐতিহ্যগতভাবে আউশ ফসল উঁচু ভূমিতে চাষ হয়। আমন ফসল চাষ হয় জলাভূমিগুলির আশে পাশে যেসব এলাকা বন্যার সময় ডুবে যায়। নিম্নভূমিগুলির তলা এবং জলাভূমিগুলিতে জৈব উপাদান জমা হওয়ায় প্রচুর উর্বর থাকে। যে সকল ধান শীতকালে হাঁটুপানির জলাভূমি এলাকায় আবাদ করা হয় তাদেরকে বোরো ধান বলা হয়। জলাভূমিগুলি নিষ্কাশিত করে এবং সেখানকার জমি আবাদযোগ্য করে বোরো ধান করার এলাকা বৃদ্ধি করা যায়। এভাবে, বিভিন্ন উচ্চ ফলনশীল জাতের আউশ ধানকেও বাছাই করে রবি মৌসুমের শেষে অথবা আউশ মৌসুমের পূর্বেই লাগানো হয়ে থাকে। এই ধরনের চাষকে এখন বোরো ধানের চাষ হিসেবেই গণ্য করা হয়। এসব ধানে ভূগর্ভস্থ জল তুলে অথবা পার্শ্ববর্তী নদী থেকে পানি তুলে সেচ দেয়া হয়। সমস্যা হলো, যদি দেরী হয়ে হয়ে যায় তা’হলে এই বোরো ধান গ্রীষ্মের আগাম বন্যায় মার খেতে পারে।
বোরো মৌসুমে যেসকল ধান উৎপন্ন হয়, তাদের মধ্যে হাসি (বিআর-১৭), শাহজালাল (বিআর-১৮) এবং মঙ্গল (বিআর-১৯) প্রজাতির ধান হাওর এলাকায় চাষের জন্যে শ্রেয়। এইসকল প্রজাতির ধানের জীবনকাল কম; তাই, বসন্ত শেষ হবার কালে সম্ভাব্য আগাম বন্যার আগেই কেটে নেয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে বিআর-১৪, বিআর-২৬, বিআর-২৯, ইত্যাদি প্রজাতির কিছু ধান হাওর এলাকায় প্রবেশ করানো হয়েছে, যাদের ফলন অনেক বেশী। কিন্তু এসব ধান চাষে অন্যদের চেয়ে বেশী বন্যার ঝুঁকি নিতে হয়, কারণ তাদের জীবনকাল বেশী। বোরো ধান চাষে উৎপাদন বেশী হয়, যথা এর বর্তমান গড় উৎপাদন ৩.৫৮ টন প্রতি একর, যেখানে আউশ ও আমনের গড় ২.০৬ টন প্রতি একর। এই উৎপাদন ৪.০ থেকে ৫.০ টন প্রতি একর করা যায়, যদি অধিকতর জমিতে বোরো চাষ বিস্তৃত করা যায়, এবং ভালো পানি ব্যবস্থাপনার সাথে প্রতি হেক্টরে বেশী সার দেয়া যায় (৩০০ থেকে ৩৫০ কেজি)। আমাদের দেশে জমিতে সার দেবার বর্তমান গড় পরিমাণ ৬০ কেজি প্রতি হেক্টর।
জলাভূমি সংরক্ষণ নদীসমূহের উজানে অবস্থিত জলাভূমি ঐ নদীর জলের উৎস এবং আধার। এইসব জলাভূমির নিষ্কাশন পথ থাকে যা’ নদীদের উৎপত্তি স্থল। সকল নদীমুখে একটি তলানি প্রবাহ থাকে, যা’ এত কম হতে পারে যে তা’ নদীর তলদেশের মাটির তলা দিয়েও প্রবাহিত হতে পারে, এবং ভাটিতে কোথায়ও গিয়ে তা’ বেরিয়ে আসবে। যা’হোক, জলাভূমি গুলোর আধার ক্রমশঃ তাদের তীরবর্তী এলাকায় অতি উত্তোলনের ফলে এবং তাদের বাহির পথ দিয়ে অতি নিষ্কাশনের জন্যে ক্ষীয়মান হয়ে যাচ্ছে। ভূপরিস্থ জলাধার থেকে অতি উত্তোলন সাধারণতঃ সেচের জন্যে করা হয়ে থাকে। আর, কোন জলাধারের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সেচ বা জল সরবরাহের জন্যে যদি ভূগর্ভস্থ জলের অতি উত্তোলন করা হয়, তাহলে জলাধারের পানি মাটির গভীরে বেশী প্রবেশ করবে ও জলাধারের পানির উচ্চতা নেমে যাবে। বাংলাদেশের উত্তর, পশ্চিম ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বহু জলাভূমি এই ধরনের উত্তোলনের ফলে শুকিয়ে গেছে। জলাভূমি গুলির নিষ্কাশন খালের পলি অপসারণের নামে কখোনো শ্রমিক লাগিয়ে কখোনো যান্ত্রিক ড্রেজার লাগিয়ে এগুলি কেটে অতি নিষ্কাশন করা হয়। । এটাই হলো জলাভূমি সমূহের শুকিয়ে যাওয়া আর পরিবেশের ক্ষতি হবার মূল কারণ। এটি বর্তমানে একটি মারাত্মক সমস্যা। চাষের জমি বৃদ্ধির নামে অতি নিষ্কাশন করায় প্রধানতঃ উত্তর পূর্বাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বহু স্থানে অনেক জলাভূমি শুকিয়ে গিয়েছে।
হাওরের বাঁধ হাওর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্যে নদী তীরে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয় তা’ অল্প উচ্চতার হয় এবং তাতে নিষ্কাশন কাঠামো থাকে। হঠাৎ বৃষ্টি হলে বাঁধের ভেতরের পানি এই কাঠামো দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু গ্রীষ্মের শুরুতে হঠাৎ বন্যা এসে গেলে তা’ এই নিষ্কাশন পথ রোধ করে দেয়। তাই চাষীরা ধান পাকার সময় ভীষণ ঝুঁকির মধ্যে থাকে, কারণ ঐ সময় জলাভূমির বিস্তীর্ণ এলাকা ৩ থেকে ৬ মিটার বৃষ্টির পানি অথবা বন্যার পানিতে কয়েক দিনের মধ্যে ডুবে যেতে পারে। বসন্ত ঋতু শেষ হলেই নদীতে বন্যার পানি আসতে শুরু করে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকাগুলি খুবই নিচু, সুনামগঞ্জ জেলার ভূমি গড় সমুদ্রতল থেকে মাত্র ২ থেকে ৪ মিটার উপরে অবস্থিত। তাই উত্তর পূর্বাঞ্চলের হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধের জন্য গৃহিত ব্যবস্থা (বন্যায় ডুবে যাওয়া বাঁধ) যথাযথ মনে হয়। যেহেতু এলাকাগুলি নিচু, তাই এসব এলাকা কেবল শীতকালেই জেগে ওঠা সম্ভব, যখন নদীতে পানিতে কম থাকে। তাই হাওর এলাকাগুলি বছরে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের জন্য একটি ফসলেরই উপযোগী। [ম. ইনামুল হক] আরও দেখুন [জলাভূমি|জলাভূমি].