চৌধুরী, আমীন আহম্মেদ
চৌধুরী, আমীন আহম্মেদ (১৯৪৬-২০১৩) খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধকালে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল, রাষ্ট্রদূত। তিনি ১৯৪৫ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ আনন্দপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সুলতান আহমেদ চৌধুরী এবং মাতার নাম আজিজুন্নেসা। তাঁর পিতা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি পুলিশ সার্ভিসে চাকরি করতেন। পিতার চাকরির সুবাদে তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। ময়মনসিংহ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এস.এস.সি) পাস করার পর তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (এইচ.এস.সি) পাস করার পর তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে বিএসসি-তে ভর্তি হন। বিএসসি অধ্যয়নকালে আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ১৯৬৫ সালের ২৭শে নভেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি (কাকুল) থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ট্রেনিং সমাপ্ত করে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে পোস্টিং পান।
আমীন আহম্মেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (East Bengal Regimental Centre, EBRC)-এ প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে তিনি গোপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তান মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটরের অধীনে দায়িত্ব পালন করার সুবাদে পাকিস্তানিদের মনোভাব বুঝতে তাঁর সুবিধা হয়। ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার পর মার্চ মাসের শুরু থেকেই চট্টগ্রামে কর্মরত বাঙালি সামরিক অফিসারগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সেনা অফিসাররা আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর বিদ্রোহী মনোভাব আঁচ করতে পেরে তাঁকে ২৫শে মার্চ হেলিকপ্টারে করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসে।
২৫শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ব্যাপক হত্যা ও নির্যাতন শুরু করে। তারা ঐ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বেশ কয়েকজন অফিসারসহ ইবিআরসিতে কয়েক শ’ বাঙালি সেনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে। আমীন আহম্মেদ চৌধুরী এ খবর জানতে পেরে ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ১১নং সেক্টরের অধীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি শত্রুসেনাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো সফল অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে ৭ই জুলাই মেজর জিয়াউর রহমান-এর নেতৃত্বে ব্রিগেড আকারে ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হলে, তিনি দক্ষতার সঙ্গে ঐ ফোর্সের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর নির্দেশনা, পরিকল্পনা ও তদারকিতে ৪ঠা আগস্ট শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী বিওপি (Border Out Post)-তে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ বিওপিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি এক কোম্পানি প্রশিক্ষিত সৈন্যর বিরুদ্ধে দুই কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী আক্রমণ পরিচালনা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২০ জন ছিলেন নিয়মিত বাহিনীর (১০ জন সামরিক বাহিনী, ৮ জন ইপিআর এবং ২ জন পুলিশ), বাকি সবাই ছিলেন এক বা দুই সপ্তাহের ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনীর সদস্য। নির্ধারিত দিনে আক্রমণ পরিচালনা করার পূর্বে তিনি তিনদিন যাবৎ সম্পূর্ণ বিওপি রেকি করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩রা আগস্ট রাত ১২টার সময় মুক্তিযোদ্ধারা আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এসেম্বলি এরিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে এফইউপি (Forming Up Place)-তে পৌঁছে ৪ঠা আগস্ট গভীর রাতে চূড়ান্তভাবে পজিশন নেন। ওয়ারলেসের মাধ্যমে নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে। ঘটনাক্রমে নিজেদের ছোড়া আর্টিলারির কয়েকটি গোলা এসে পড়ে এফইউপিতে। এর ফলে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হন। এ সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের আক্রমণ তীব্রতর করে।
এক পর্যায়ে শত্রুসেনাদের ছোড়া একটি শেলের আঘাতে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী আহত হন। এতে যুদ্ধের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। সহযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করতে আহত অবস্থায় আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীরত্বের সঙ্গে শত্রুদের বাংকারের পাঁচ গজ সীমানার মধ্যে পৌঁছে পলায়নরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ জোরদার করে নকশী বিওপি ধ্বংস করেন। এ যুদ্ধে ৩৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বপূর্ণ কৃতিত্বের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীকে ‘বীর বিক্রম’ উপাধিতে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং পর্যায়ক্রমে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনি ২০১০ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বর্তমান মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে মিলিটারি এটাশে; ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক; ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টি বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সেনা কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২য় (১৯৮৫), ৬ষ্ঠ (১৯৯৩) ও ১১শ (২০১০) সাফ গেমস আয়োজনে তিনি মূল সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সমর-নীতি, সমর-কৌশল ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে তিনি লেখালেখি করতেন। ‘১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘একাত্তরের চিঠি’-র সম্পাদনা পরিষদের তিনি সদস্য ছিলেন। জয়দেবপুর সেনানীবাসে থাকাকালীন সময়ে আমিন আহমেদ চৌধুরীর তত্ত্ববধানে শহীদদের অবদান এবং আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজধানী ঢাকার অদূরে গাজীপুরে ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-জয়দেবপুর-এর সংযোগস্থল চৌরাস্তার সড়ক-দ্বীপে ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয় দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে নির্মিত সর্বপ্রথম মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য।
রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি সড়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রমের নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর স্ত্রীর নাম সৈয়দা লতিফা আমিন। এ দম্পত্তির দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। ২০১৩ সালের ১৯শে এপ্রিল এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। [মনিরুজ্জামান শাহীন]