উয়ারী-বটেশ্বর
উয়ারী-বটেশ্বর বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। নরসিংদী জেলার বেলাব উপজেলা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবিস্থত উয়ারী এবং বটেশ্বর গ্রাম দু’টি ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রার প্রাপ্তিস্থান হিসেবে দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত। প্লাইসটোসিন যুগে গঠিত মধুপুর গড়ের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত এ গ্রাম দু’টিতেই নিবিড় অনুসন্ধান ও সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন দুর্গ নগর।
১৯৩০-এর দশকে মুহম্মদ হানিফ পাঠান নামের স্কুল শিক্ষক প্রথম উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব জনসমক্ষে তুলে ধরেন। পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র মুহম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান উক্ত স্থানের প্রত্নবস্ত্ত সংগ্রহ ও গবেষণার কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ দিন পর ১৯৯৬ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং ২০০০ সাল থেকে উয়ারী-বটেশ্বরে নিয়মিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কাজ শুরু হয়। ইতিপূর্বে গ্রাম দু’টিতে কৃষকের জমি চাষ ও নালা কাটা, গৃহস্থের বর্জ্য-গর্ত তৈরি ও মাটি কেটে স্থানীয়দের ঘর-বাড়ি নির্মাণের জন্যও গর্ত করে মাটি সংগ্রহের ফলে অনেক প্রত্নবস্ত্ত উন্মোচিত হয়েছে। আরও পাওয়া গিয়েছে বিচিত্র স্বল্প মূল্যবান পাথর ও কাচের পুঁতি, রৌপ্য মুদ্রা।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে উয়ারী প্রত্মস্থলে আবিষ্কৃত হয়েছে ৬০০ মি. x ৬০০ মি. আয়তনের চারটি মাটির দুর্গ-প্রাচীর। দুর্গ প্রাচীরের ৫-৭ ফুট উঁচু ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু অংশ এখনো টিকে আছে। এ ছাড়াও দুর্গের চারদিকের রয়েছে পরিখা (যদিও কালের ব্যবধানে তাতে মাটি ভরাট হয়েছে)। ভরাট হলেও পূর্ব প্রান্তের পরিখার চিহ্ন এখনো দৃশ্যমান। দুর্গের পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় ৫.৮ কি. মি. দীর্ঘ, ২০ মি. প্রশস্ত ও ১০ মি. উঁচু অসম রাজার গড় নামে একটি মাটির বাঁধ রয়েছে। সম্ভবত এটি দ্বিতীয় দুর্গ প্রাচীর হিসেবে উয়ারী দুর্গনগরের প্রতিরক্ষার কাজ করত। ভারতের নাগার্জুনকুন্ড হল এরকম দ্বিস্তর বিশিষ্ট দুর্গ প্রাচীরের আরেকটি উদাহরণ। বীর মাউন্ড, হস্তিনাপুর, রাজগৃহ, কৌশাম্বী, বৈশালী প্রভৃতি স্থানেও একটি দুর্গকে ঘিরে রেখেছে আরেকটি দুর্গ গড়ে উঠেছে।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত উয়ারী দুর্গ নগরের বাইরে আরো ৫০ টি প্রত্নস্থান এ যাবত আবিষ্কৃত হয়েছে। বন্যামুক্ত উঁচু স্থানে বসতি স্থাপনকারী মানুষের মতো উন্নত পরিকল্পনা ও বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় মহাস্থান ও উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ অঞ্চলের বসতিবিন্যাসেও দেখা যায়। কৌটিল্য প্রণীত অর্থশাস্ত্রে দুর্গকে নগর বলা হয়েছে। ১১ শতকের বৈয়াকরণবিদ কৈয়টের মতে, ’নগর হলো উঁচু পাঁচিল এবং পরিখা দিয়ে ঘেরা বাসভূমি, যেখানে কারিগর ও ব্যবসায়ী সংঘের তৈরি আইন ও নিয়মকানুন বলবৎ থাকতো’। গ্রামীণ এলাকায় নগরায়নের ক্ষেত্রে যে দশটি নিয়ামকের তথ্য গর্ডন চাইল্ড ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতেও একই মত সমর্থন করে। উয়ারী-বটেশ্বর ছিল এই প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা একটি দুর্গ নগর, নগর বা একটি নগর কেন্দ্র। আবিষ্কৃত প্রত্নবস্ত্ত বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায় যে উয়ারী-বটেশ্বর ছিল একাধারে একটি নগর ও সমৃদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র।
ওয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম দুটির অধিকাংশ স্থান জুড়ে প্রাচীন বসতি ছিল। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী গ্রাম যেমন- রাঙ্গারটেক, সোনারুতলা, কেন্দুয়া, মরজাল, চন্ডীপাড়া, পাটুলি, জয়মঙ্গল, হরিসাঙ্গন, যশোর, কুন্ডাপাড়া, গোদাশিয়া, এবং আব্দুল্লাহ নগরেও প্রাচীন বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। উয়ারী দুর্গনগরীর নিকটবর্তী এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রায় অর্ধশতাধিক প্রত্নস্থানের প্রত্নবস্ত্ত বিচারে ধরে নেয়া যায় যে, অধিবাসীরা ছিল কৃষিজীবী এবং এদের উৎপাদিত উদ্বৃত্ত ফসল নগরে বসবাসরত ধনিক, বণিক, পুরোহিত, কারিগর ও রাজকর্মচারীদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করত। উয়ারী-বটেশ্বরের অধিবাসীগণ উন্নত প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত ছিল। তারা ধাতু গলিয়ে মুদ্রা তৈরি করার প্রযুক্তি জানত এবং পুঁতির সঙ্গে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে অলংকার তৈরি করতে পারত। উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রের সঙ্গে এ নগর সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। কারণ উপমহাদেশে দ্বিতীয় নগর সভ্যতার প্রত্নস্থানগুলোতে উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র পাওয়া যায়।
সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আবিষ্কৃত হয়েছে পেরেক, লৌহমল, লৌহ গলানোর ফলে অতি ক্ষুদ্র বল, মরিচাপড়া লৌহবস্ত্ত প্রভৃতি। প্রাপ্ত পোড়ামাটি থেকে ধারনা করা যায় যে, এ স্থানে উচ্চ তাপমাত্রায় লোহা গলানোর প্রযুক্তির প্রচলন ও ব্যবহার ছিল। ওয়ারী-বটেশ্বর প্রত্নস্থানের ধর্মীয় প্রকৃতি জানা যায় না। তবে প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত নবড্ মৃৎপাত্র এতদঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইঙ্গিত বহন করে। দিলীপ কুমার চক্রবর্তী (অধ্যাপক, সাউথ এশিয়ান আর্কিওলোজি, ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি) মনে করেন যে, উয়ারী-বটেশ্বরের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের যোগাযোগ ছিল। কারণ প্রাপ্ত রুলেটেড মৃৎপাত্র, স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি, স্বর্ণ আবৃত কাঁচের পুঁতি, টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ ইত্যাদি সব উপকরণ এ তথ্যের সত্যতার প্রমাণ দেয়। গর্ডন চাইল্ডের মতে, উয়ারী-বটেশ্বর অঞ্চলটি টলেমি (দ্বিতীয় শতকের ভূগোলবিদ) উল্লেখিত ‘সোনাগড়া’। কারণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একক রঙের কাঁচের পুঁতি উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়াও শ্রীলংকার মানটাই, দক্ষিণ ভারতের আরিকামেদু, থাইল্যান্ডের কিয়ন থম প্রভৃতি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে। সম্প্রতি উয়ারী-বটেশ্বরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে ইটের স্থাপনা পাওয়া গিয়েছে যা গর্ডন চাইল্ডের নগরায়ণ এর বৈশিষ্ট্যকে সমর্থন করে। খননের ফলে গলিপথসহ ১৬০ মিটার দীর্ঘ রাস্তা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একমত যে, উয়ারী বটেশ্বরে কেবল নগরায়নই ঘটেনি, ব্রহ্মপুত্র নদের উপস্থিতির কারণে এ অঞ্চল একই সঙ্গে ছিল নদীবন্দর এবং বাণিজ্য নগর।
উয়ারী-বটেশ্বরে জনপদ শ্রেণি ও সাম্রাজিক শ্রেণি এ দু’প্রকারের ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। জনপদ শ্রেণির মুদ্রাগুলো খ্রিস্টপূর্ব ৬-৪ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। এ মুদ্রাসমূহ উয়ারী-বটেশ্বরকে উপমহাদেশে ষোড়শ মহাজনপদের (খ্রিস্টপূর্ব ৬-৪) রাজ্য/রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সমাগোত্রীয় ও সমসায়িক বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা ছাড়াও ধারণা করা হয় যে, উয়ারী বটেশ্বর জনপদের রাজধানী ছিল। সাম্প্রতিক আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন নগর বা ষোড়শ মহাজনপদ পূর্ব সময়ের মানব বসতির চিহ্নও আবিষ্কৃত হয়েছে যা তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির চিহ্ন বহন করে। তাম্র-প্রস্তর সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো গর্ত বসতির চিহ্ন। ভারতের মহারাষ্ট্রের ইমামগাঁওয়ে অনুরূপ বসতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে।
বৃষ্টিবহুল বাংলার গর্ত বসতি কতটুকু সম্ভব, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও ধারণা করে নেয়া হয়েছে যে, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বা তার কিছু আগে এ মহাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক ছিল। দৈবাৎ প্রাপ্তি (Chance Finding) হলেও উয়ারী-বটেশ্বরে নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ারও আবিষ্কৃত হয়েছে। এ অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্র প্রাপ্তি মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির সাক্ষ্য বহন করে। [সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুল্লা পাঠান, মিজানুর রহমান, মুর্শেদ রায়হান, শামীমা আক্তার]