রশীদ, এম.এ
রশীদ, এম.এ (১৯১৯-১৯৮১) শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশে প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার পথিকৃৎ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য; পুরো নাম মুহম্মদ আবদুর রশীদ। ১৯১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার বগাডুবি গ্রামে এম.এ রশীদ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হবিগঞ্জ হাইস্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, সিলেট সরকারী এম.সি কলেজ থেকে ১৯৩৮ সালে প্রথম বিভাগে আই.এসসি এবং কলকাতার শিবপুরে অবস্থিত বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে পুরকৌশলে বি.ই (ব্যাচেলর অব ইঞ্জিনিয়ারিং) ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ এম.এ রশীদ ১৯৪১ সালে স্লটার মেমোরিয়াল স্বর্ণপদক ও টেট মেমোরিয়াল মেডেল এবং ১৯৪২ সালে ট্রেভর মেমোরিয়াল পুরস্কার ও স্বর্ণপদক অর্জন করেন।
এম.এ রশীদের কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪২ সালে আসাম সরকারের গণপূর্ত বিভাগের সহকারী প্রকৌশলি পদে চাকরিতে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৪৫ সালে তিনি ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং পেনসিলভেনিয়াতে অবস্থিত কার্নেগি ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে পুরকৌশলে এম.এস ও ডি.এসসি ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৪৮ সালে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এদেশে তিনিই প্রথম প্রকৌশলবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনকারী ব্যক্তি। একই বছর ১৬ ডিসেম্বরে তিনি ঢাকার আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পুরকৌশল বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। তিনি ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত উক্ত কলেজে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৫২-তে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ১৯৫৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে ড. রশীদ আহসানউলাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। তিনিই উক্ত কলেজের প্রথম বাঙালি অধ্যক্ষ। দীর্ঘ ১৬ বছর এদেশে প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষার দৃঢ় ভিত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
১৯৫৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাঁকে জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি কমিশনে থাকাকালীন প্রকৌশল শিক্ষা সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মূলত তাঁর সুপারিশের ভিত্তিতেই সে সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একটি করে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধ্যাপক রশীদকে পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প কমিটির সদস্য মনোনীত করে। ইতোমধ্যে তিনি ১৯৬১ সালের ১ এপ্রিলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম কারিগরি শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালের ১১ ডিসেম্বরে তাঁকে নব প্রতিষ্ঠিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
এছাড়া এম.এ রশীদ ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ব্যাংককে অবস্থিত এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ট্রাস্টি বোর্ড, ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকারের জনশক্তি ও শিক্ষা কমিশন, ১৯৭০ সালে জাতীয় পরীক্ষা কমিশন প্রভৃতির সদস্য; ১৯৭০-১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, ১৯৭১ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কমিশনের সদস্য, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য, ১৯৭৩ সালে শিল্পকারখানার শ্রমিকদের মজুরি কমিশনের সদস্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক রশীদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় পূর্ত ও নগর উন্নয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং স্থানীয় সরকার, পলী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর পুরকৌশল বিভাগ তাঁকে ‘অধ্যাপক’ (ব্যক্তিগত চেয়ার) পদে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে তিনি ১৯৭৯ সালের ১৫ জানুয়ারিতে পুনরায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ঐ পদ অলঙ্কৃত করেন। প্রকৌশল শাস্ত্রে অধ্যাপক রশীদের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটি ছাত্রাবাসকে এম.এ রশীদ হল নামে নামকরণ করে।
জাতির প্রতি একনিষ্ঠ সেবার কথা বিবেচনা করে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৬ সালে এম.এ রশীদকে ‘সিতারা-এ-পাকিস্তান’ খেতাব ও পদকে সম্মানিত করে। তিনি আমেরিকান সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্সসহ অন্যান্য বহু খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের ‘ফেলো’ নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে এম.এ রশীদকে কমনওয়েলথ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মনোনীত করা হয়। ১৯৮২ সালের ১ জুলাই থেকে তাঁর এ দায়িত্বভার গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু এ গুরুদায়িত্ব গ্রহণের পূর্বেই তিনি ১৯৮১ সালের ৬ নভেম্বর পাবনা থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। [সুলতানা নাসরিন বেবী]