লেনদেন ভারসাম্য: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

সম্পাদনা সারাংশ নেই
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত ৭টি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
[[Category:বাংলাপিডিয়া]]
'''লেনদেন ভারসাম্য'''  একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশ কর্তৃক বিভিন্ন খাতে বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশকে পরিশোধিত এবং অন্যান্য দেশসমূহ থেকে গৃহীত সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক লেনদেনের সমন্বিত হিসাব।
'''লেনদেন ভারসাম্য''' একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশ কর্তৃক বিভিন্ন খাতে বিশ্বের সকল দেশকে পরিশোধকৃত এবং সকল দেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ তথা সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক অন্য কথায়, লেনদেনের সমন্বিত হিসাব। দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দ্রব্য, সেবা আমদানি-রপ্তানি, মূলধন তহবিলসহ বিদেশে সর্বপ্রকার অর্থ প্রেরণ এবং বিদেশ থেকে গ্রহণসংক্রান্ত লেনদেনসমূহের পার্থক্যই লেনদেন ভারসাম্য। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ভারসাম্যের হিসাবে ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে আসছে। অত্যধিক আমদানি নির্ভরশীলতা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ তহবিল গ্রহণের কারণেই বাণিজ্যিক হিসাব খাতের ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী তেলের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে অপরিশোধিত তেল, পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদি এবং সার আমদানি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।


দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দ্রব্য, সেবা আমদানি-রপ্তানি, মূলধন তহবিলসহ বিদেশে সর্বপ্রকার অর্থ প্রেরণ এবং বিদেশ থেকে গ্রহণসংক্রান্ত লেনদেনসমূহের পার্থক্যই লেনদেন ভারসাম্য। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ভারসাম্যের হিসাবে ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে আসছে। অত্যধিক আমদানি নির্ভরশীলতা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ তহবিল গ্রহণের কারণেই বাণিজ্যিক হিসাব খাতের ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী তেলের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে অপরিশোধিত তেল, পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদি এবং সার আমদানি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিগত তিন দশকে বারংবার সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী ঝড়, বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শস্যহানি ঘটায় বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। এর ফলে দেশের লেনদেন ভারসাম্যের আরও অবনতি ঘটে। অপরদিকে, আমদানি মূল্য বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয় প্রবাহের অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের বাণিজ্য শর্তের অস্বাভাবিক অবনতি ঘটে। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণে লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতিও অধিক হয়। রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে নানাবিধ সুবিধা প্রদান ও কৌশল অবলম্বন এবং বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশিদের অর্থপ্রেরণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ভারসাম্যের হার অব্যাহত থাকে। ১৯৯০-এর দশকে দেশের বহির্বাণিজ্য খাতের অত্যধিক উদারীকরণের ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও মনে করা হয়।
আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রণীত লেনদেন ভারসাম্য ম্যানুয়্যাল অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের লেনদেন ভারসাম্যের প্রকৃত অবস্থা চিহ্নিত ও প্রস্তুত করে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার অনুমোদিত ডিলারদের লেনদেনের বিবরণী, খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যশস্য আমদানি-সংক্রান্ত দলিলাদি, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য আমদানিকৃত দ্রব্যাদির রেকর্ড, শুল্ক বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত অন্যান্য দলিলাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে নানাবিধ সুবিধা প্রদান ও কৌশল অবলম্বন এবং বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশিদের অর্থপ্রেরণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির হার অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ঘাটতি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ১,০০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপি-র ৭.০৮%-এ উন্নীত হয়। অর্থবছর ২০০২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত (২০০৫, ২০১১ ও ২০১২ ব্যতীত) প্রায় এক দশকের অধিককাল ধরে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্য ধারাবাহিকভাবে উদ্বৃত্ত থাকে। পরবর্তীতে ২০১৭ থেকে ২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বিরাজ করছে। জুন ২০২১ মাসে সমাপ্ত অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডিসেম্বর ২০২০ শেষে বাংলাদেশের আইএমএফ-এসডিআর স্থিতির পরিমাণ ছিল ১.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।


'''''আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল'''''  কর্তৃক প্রণীত লেনদেন ভারসাম্য ম্যানুয়্যাল অনুযায়ী [[বাংলাদেশ ব্যাংক|বাংলাদেশ ব্যাংক]] দেশের লেনদেন ভারসাম্যের প্রকৃত অবস্থা চিহ্নিত ও প্রস্ত্তত করে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার অনুমোদিত ডিলারদের লেনদেনের বিবরণী, খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যশস্য আমদানি-সংক্রান্ত দলিলাদি, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য আমদানিকৃত দ্রব্যাদির রেকর্ড, শুল্ক বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত অন্যান্য দলিলাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ঘাটতি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ১,০০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপি-র ৭.০৮%-এ উন্নীত হয়। অর্থবছর ২০০২ (২০০৫ ব্যতীত) থেকে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্য ধারাবাহিকভাবে উদ্বৃত্ত প্রদর্শন করে আসছে। লেনদেন ভারসাম্যের অসম অবস্থার উন্নয়নের জন্য আইএমএফ বাংলাদেশকে নানাবিধ আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করেছে। একটি জরুরি ব্যবস্থাধীনে বাংলাদেশ ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে আইএমএফ-এর নিকট থেকে ৯৩.৭৫ মিলিয়ন এসডিআর উত্তোলন করে। রপ্তানি ঘাটতি পূরণার্থে ক্ষতিপূরণমূলক অর্থায়ন সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে আইএমএফ-এর নিকট থেকে ৬২.৫০ মিলিয়ন এসডিআর গ্রহণ করেছিল।
''চিত্র ১'' বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স (মিলিয়ন মার্কিন ডলার)
[[Image:BalanceofPaymentsB.jpg|right|thumbnail|600px|''তথ্যসূত্র'' ইকনমিক ট্রেন্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি, এপ্রিল-জুন ২০২১]]


বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাব খাতে ১৯৭৫-৭৬ এবং ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৮৮১ মিলিয়ন এবং ৪৩৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা আবার উক্ত বছরদ্বয়ের জিডিপির যথাক্রমে ১২.৩৩% ও ৬.৪২%-এর সমান ছিল। মে ১৯৭৫ এবং জুন-ডিসেম্বর ১৯৭৫ সময়ে যথাক্রমে ৬১% ১০% এবং জানুয়ারি-ডিসেম্বর ১৯৭৬ সময়ে ১১% হারে (মার্কিন ডলারের বিপরীতে) টাকার অবমূল্যায়নের ফলে তৎপরবর্তী কিছুকাল এদেশের লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উক্ত সময়ে লেনদেন ভারসাম্যের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা হিসেবে নিয়ন্ত্রণমূলক আর্থিক ও রাজস্ব নীতি অনুসরণ করে। ব্যাংক রেট ৫% থেকে ৮%-এ বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি সেবাসমূহের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণমূলক আর্থিক ও রাজস্ব নীতির বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। লেনদেন ভারসাম্যের আরও উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষ উলি­খিত আর্থিক ও রাজস্ব নীতির পাশাপাশি রপ্তানি উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আমদানির বিকল্প পন্থা অনুসরণের চেষ্টা করে।
দেশের আমদানি বাণিজ্যের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তৎসঙ্গে লেনদেন ভারসাম্যের সেবাখাতের ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস এর উন্নয়ন অব্যাহত থাকে যা ২০০২ সালের পর থেকে উদ্বৃত্ত এবং ২০১৭-২০২১ অর্থবছরগুলিতে ঘাটতি প্রদর্শন করলেও বাংলাদেশের বহিঃখাত একটা সুস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে ধরা যায়।


১৯৭৯-৮০ অর্থবছরে বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাব খাতে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১,৪৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা জিডিপি-র ১১.২৩%-এর সমান। কিন্তু এ ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পেয়ে ১৯৮৫-৮৬ সালে ১,০৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপির ৬.৮৫% এবং ১৯৯০-৯১ সালে ৯৮১ মিলিয়ন মাকিন ডলার বা জিডিপির ৪.১৯%-এ দাঁড়ায়। তবে ঐ সময়ে আইএমএফ-এর নিকট থেকে বাংলাদেশের এসডিআর গ্রহণের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে আইএমএফ প্রদত্ত বিভিন্ন সুবিধার আওতায় ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আইএমএফ-এর নিকট থেকে মোট ৬৮৯.৩৯ মিলিয়ন এসডিআর উত্তোলন করে। এ সকল সুবিধার মধ্যে ক্ষতিপূরণমূলক আর্থিক সুবিধা, তেল সুবিধা, ট্রাস্ট ফান্ড সুবিধা, স্ট্যান্ড-বাই অ্যারেঞ্জমেন্ট এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড সুবিধা ছিল উলে­খযোগ্য। আইএমএফ প্রদত্ত উল্লিখিত সুবিধাগুলিসহ বিভিন্ন নির্দেশনা অনুসরণের ফলে বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থিক অবস্থা এবং লেনদেন ভারসাম্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। আর্থিক ও রাজস্ব নীতিতে গতিশীলতা আনয়নের মাধ্যমে সার্বিক চাহিদা ব্যবস্থাপনার জন্য আইএমএফ কর্তৃক নির্দেশিত নীতিমালা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। এছাড়া বৈদেশিক বিনিময় হার এবং সুদের হার সংক্রান্ত নীতিমালাসমূহ বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্যের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আইএমএফ এদেশের জন্য উচ্চতর শর্তাধীনে বর্ধিত ঋণ অনুমোদন করে।


লেনদেন ভারসাম্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতিজনিত অবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ ও আগস্ট ১৯৯০ সালে আইএমএফ-এর কাঠামোগত সমন্বয় সুবিধা এবং বর্ধিত কাঠামোগত সুবিধা কার্যক্রমের অধীনে উক্ত সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা গ্রহণ করে। এতদ্ব্যতীত বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আইএমএফ-এর নিকট থেকে জরুরি আর্থিক সহায়তা নিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেনি। কেননা চলতি হিসাবের এ ঘাটতি ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে ১৯৯০-৯১ অর্থবছরের ৯৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপির ৪.১৯% থেকে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে ৬৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২.২৮%-এ নেমে যায়। কিন্তু ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তা আবার বৃদ্ধি পেয়ে ১,২৯১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপির ৪.০৫%-এ উন্নীত হয়। এরপর চলতি হিসাবের ঐ ঘাটতি ১৯৯৬-৯৭ থেকে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯০-এর দশকব্যাপী বাংলাদেশে বাণিজ্য উদারীকরণ নীতি ও আর্থিক খাত সংস্কার কার্যক্রমের কিছুটা অগ্রগতি সাধিত হয়। এতদ্ব্যতীত আমদানির ওপর পূর্বেকার আরোপিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শিথিল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রত্যাহারপূর্বক ১৯৯৫-৯৭ অর্থবছরে দেশে একটি নমনীয় আমদানি নীতি কার্যকর করা হয়। অপরদিকে চলমান বাণিজ্য নীতি সংশোধনপূর্বক ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে দেশে যথেষ্টভাবে উদারীকৃত একটি পঞ্চবার্ষিক বাণিজ্য নীতি চালু করা হয়। ফলে গড় শুল্কহার ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের ৫৭% থেকে হ্রাস পেয়ে ১৯৯৭-৯৮-এ ২০% এবং ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ১৬%-এ অবনমিত হয়। তবে ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের তুলনায় শুল্ক হারের সর্বাধিক হ্রাস ঘটেছিল ২০০০-২০০১ অর্থবছরে যা প্রথমোক্ত সালের ৯০% থেকে ২০০০-২০০১ অর্থবছরে ৩৭.৫০%-এ অবনমিত হয়।


দেশের আমদানি বাণিজ্যের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তৎসঙ্গে লেনদেন ভারসাম্যের সেবাখাতের ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস ও এর উন্নয়ন অব্যাহত থাকে।


সেবা হিসাব ঘাটতি কাটিয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে উদ্বৃত্ত অবস্থায় উন্নীত হয় এবং এ অবস্থা ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরের ৫৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ৭৬৪ মিলিয়ন, ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে ১২১৭ মিলিয়ন এবং ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ১,৯৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়।


নিম্নগামী আমদানি প্রবৃদ্ধির সাথে ঊর্ধ্বগামী রপ্তানি প্রবৃদ্ধির সংমিশ্রণে ২০০০ সালের শেষ দিকে মোট বাণিজ্য ঘাটতি দেশজ উৎপাদনের (GDP) শতকরা হিসেবে সংকুচিত হয়ে এসেছিল। অপরদিকে সেবাখাতের ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি বাণিজ্য খাতের এরূপ উন্নতিকে বহুলাংশকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থের বিপুল পরিমাণ আন্তঃপ্রবাহ এ সময়ে চলতি হিসাব ঘাটতিকে উদ্বৃত্তে পরিণত করে। চলতি হিসাব স্থানান্তরের উন্নতি ও চলতি হিসাবের ভারসাম্যের উন্নতিতে অবদান রাখে। চলতি হিসাবের এই গতিধারা অর্থবর্ষ ২০০৫ ব্যতীত অব্যহত ছিল এবং ২০০৬ সালের শেষে চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত রেকর্ড পরিমাণ ৮২৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। মূলধনী ও আর্থিক হিসাব এ সময়ে কিছুটা চাপের মধ্যে ছিল। বিশেষ করে অর্থবছর ২০০৬-এ কিছুটা উন্নতি সত্ত্বেও অর্থবছর ২০০৪ ও ২০০৫-এ মূলধনী হিসাবের ঘাটতি খুব শোচনীয় হয়ে পড়ে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রবাহের উল্লেখযোগ্য হ্রাসের সাথে স্বল্প মেয়াদি ঋণ ও ট্রেড ক্রেডিটের নীট বহিঃপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে আর্থিকখাতের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ে। এ গতিধারার সম্মিলিত প্রভাবে অর্থবছর ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য ততটা স্বস্তিদায়ক ছিল না। অনেক সময়েই তা বিপদজনক অবস্থায় উপনীত হয়। যাহোক, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০০৮ সাল ছাড়া বাংলাদেশের লেনদেনের ভারসাম্য ২০০৬ থেকে সুস্থ গতিধারায় ফিরে এসেছে। সেবা ও আয় হিসাবের ঘাটতি বৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রবাস আয়ের বিশাল আন্তঃপ্রবাহের কারণে চলতি হিসাবে ধারাবাহিকভাবে উদ্বৃত্ত অবস্থা বিরাজমান রয়েছে। এই উদ্বৃত্তাবস্থার কারণগুলির মধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি, এন্টি মানি লন্ডারিং কর্মকান্ড বৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নত ব্যাংকিং সেবা এবং বাংলাদেশি টাকার অবমূল্যায়ন এরূপ সুস্থধারার পিছনে কাজ করেছে বলে ধারণা করা যায়।


''সারণি''  বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য (মিলিয়ন ইউ.এস ডলারে)।
 
 
''সারণি'' বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য অর্থবছর ২০১১-২০২০ (মিলিয়ন ইউ.এস ডলারে)।
{| class="table table-bordered table-hover"
{| class="table table-bordered table-hover"
|-
|-
| বিষয়সমূহ || অর্থবছর-২০০০  || অর্থবছর-২০০১  || অর্থবছর-২০০২  || অর্থবছর-২০০৩  || অর্থবছর-২০০৪  || অর্থবছর-২০০৫  || অর্থবছর-২০০৬  || অর্থবছর-২০০৭  || অর্থবছর-২০০৮  || অর্থবছর-২০০৯
|বিষয়সমূহ || ২০১১ || ২০১২ || ২০১৩ || ২০১৪ || ২০১৫ || ২০১৬ || ২০১৭ || ২০১৮ || ২০১৯ || ২০২০
|-
|-
| আমদানি  || -৭৫৬৬  || -৮৪৩০  || ৭৬৯৭  || -৮৭০৭  || -৯৮৪০  || -১১৮৭০  || -১৩৩০১  || -১৫৫১১  || -১৯৪৮১  || -২০২৯১
|রপ্তানি (এফওবি) || ২২,৫৯২ || ২৩,৯৮৯ || ২৬,৫৬৭ || ২৯,৭৭৭ || ৩০,৬৯৭ || ৩৩,৪৪১ || ৩৪,০১৯ || ৩৬,২৮৫ || ৩৯,৬০৪ || ৩২,৮৩২
|-
|-
| রপ্তানি  || -৫৭০১  || ৬৪১৯  || ৫৯২৯  || ৬৪৯২  || ৭৫২১  || ৮৫৭৩  || ১০৪১২  || ১২০৫৩  || ১৪১৫১  || ১৫৫৮৩
|আমদানি (এফওবি) || ৩২,৫২৭ || ৩৩,৩০৯ || ৩৩,৫৭৬ || ৩৬,৫৭১ || ৩৭,৬৬২ || ৩৯,৯০১ || ৪৩,৪৯১ || ৫৪,৪৬৩ || ৫৫,৪৩৯ || ৫০,৬৯০
|-
|-
| বাণিজ্য ভারসাম্য || -১৮৬৫  || -২০১১  || -১৭৬৮  || -২২১৫  || -২৩১৯  || -৩২৯৭  || -২৮৮৯  || -৩৪৫৮  || ৫৩৩০  || -৪৭০৮
|বাণিজ্য ভারসাম্য || -৯,৯৩৫ || -৯,৩২০ || -৭,০০৯ || -৬,৭৯৪ || -৬,৯৬৫ || -৬,৪৬০ || -৯,৪৭২ || -১৮,১৭৮ || -১৫,৮৩৫ || -১৭,৮৫৯
|-
|-
| সেবা (নীট) || -৬৪৫  || -৯১৮  || -৪৯৯  || -৬৯১  || -৮৭৪  || -৮৭০  || -১০২৩  || -১২৫৬  || -১৫২৫  || -১৬২১
|সেবা (নীট) || -২,৬১২ || -৩,০০১ || -৩,১৬২ || -৪,০৯৬ || -৩,১৮৬ || -২,৭০৮ || -৩,২৮৮ || -৪,২০১ || -৩,১৭৭ || -২,৫৪১
|-
|-
| আয় (নীট) || -৩০২  || -৩৪৪  || -৪০২  || -৩৫৮  || -৩৭৪  || -৬৮০  || -৭০২  || -৯০৫  || -৯৯৪  || -১৩৬১
|প্রাথমিক আয় (নীট) || -১,৪৫৪ || -১,৫৪৯ || -২,৩৬৯ || -২,৬৩৫ || -২,২৫২ || -১,৯১৫ || -১,৮৭০ || -২,৬৪১ || -২,৯৯৩ || -৩,১০৬
|-
|-
| প্রবাসীদের চলতি রেমিট্যান্স স্থানান্তর  || ২৩৯৪১৯৪৯  || ২১৭১১৮৮২  || ২৮২৬২৫০১  || ৩৩৪০৩০৬২  || ৩৭৪৩৩৩৭২
|সেকেন্ডারি আয় || ১২,৩১৫ || ১৩,৪২৩ || ১৪,৯২৮ || ১৪,৯৩৪ || ১৫,৮৯৫ || ১৫,৩৪৫ || ১৩,২৯৯ || ১৫,৪৫৩ || ১৬,৯০৩ || ১৮,৭৮০
|-
|-
| || ৪২৯০৩৮৪৮  || ৫৪৩৮৪৮০২  || ৬৫৫৪৫৯৭৯  || ৮৫৫১৭৯১৫  || ১০১৫৪৯৬৮৯
|প্রবাসী রেমিট্যান্স স্থানান্তর || ১১,৫১৩ || ১২,৭৩৪ || ১৪,৩৩৮ || ১৪১,১৬ || ১৫,১৭০ || ১৪,৭১৭ || ১২,৭৬৯ || ১৪,৭০৩ || ১৬,১৯৬ || ১৮,০১৪
|-
|-
| চলতি হিসাব ভারসাম্য || -৪১৮  || -১০৯৮  || ১৫৭  || ১৭৬  || ১৭৬  || -৫৫৭  || ৮২৪  || ৯৩৬  || ৭০২  || ২৫৩৬
|চলতি হিসাব ভারসাম্য || -১,৬৮৬ || -৪৪৭ || ২,৩৮৮ || ১,৪০৯ || ৩,৪৯২ || ৪,২৬২ || -১,৩৩১ || -৯,৫৬৭ || -৫,১০২ || -৪,৭২৩
|-
|-
| মূলধন হিসাব || ৫৬১  || ৪৩২  || ৪১০  || ৪২৮  || ১৯৬  || ১৬৩  || ৩৭৫  || ৪৯০  || ৫০৯  || ৪৫১
|মূলধন হিসাব || ৬৪২ || ৪৮২ || ৬২৯ || ৫৯৮ || ৪৯৬ || ৪৬৪ || ৪০০ || ৩৩১ || ২৩৯ || ২৫৬
|-
|-
| আর্থিক হিসাব || -১১৬  || ৬৮২  || ৩৯১  || ৪১৩  || -৩১  || ৭৮৪  || -১৪১  || ৭৬২  || -৩৯২  || -৮০৮
|আর্থিক হিসাব || ৬৫১ || ১,৪৩৬ || ২,৮৬৩ || ২,৮১৩ || ১,২৬৭ || ৯৪৪ || ৪,২৪৭ || ৯,০১১ || ৫,৯০৭.২ || ৭,৫৩৭
|-
|-
| এফডিআই || ৩৮৩  || ৫৫০  || ৩৯১  || ৩৭৬  || ২৭৬  || ৮০০  || ৭৪৩  || ৭৯৩  || ৭৪৮  || ৯৪১
|(১) এফডিআই || ৭৭৫ || ১,১৯১ || ১,৭২৬ || ১,৪৩২ || ২,৫২৫ || ২,৫০২ || ৩,০৩৮ || ৩,২৯০ || ৪,৯৪৬ || ৩,২৩৪
|-
|-
| পোর্টফোলিও বিনিয়োগ || ০  || ০  || -৬  || ২  || ৬  || ০  || ৩২  || ১০৬  || ৪৭  || -১৫৯
|(২) পোর্টফোলিও বিনিয়োগ || ১০৯ || ২৪০ || ৩৬৮ || ৯৩৭ || ৩৭৯ || ১৩৯ || ৪৫৭ || ৩৪৯ || ১৭২ || ৪৪
|-
|-
| অন্যান্য বিনিয়োগ (নীট) || -৪৯৯  || ১৩২  || ৬  || ৩৫  || -৩১৩  || -১৬  || -৯১৬  || -১৩৭  || -১১৮৭  || -১৫৯০
|(৩) অন্যান্য বিনিয়োগ (নীট) || -২৩৩ || || ৭৬৯ || ৪৪৪ || -২৮৪ || -৪৮০ || ২,১৩৭ || ৬,৮৮৪ || ৩,১০৮ || ৬,২২২
|-
|-
| ভুল-বিচ্যুতি || ১৫২  || -২৯৭  || -৫৫০  || -২০২  || -১৭০  || -৩২৩  || -৭২০  || -৬৯৫  || -৪৮৮  || -১২১
|ভুল-বিচ্যুতি || -১,৩৭৬ || -৯৭৭ || -৭৫২ || ৬৬৩ || -৮৮২ || -৬৩৪ || -১৪৭ || -৬৩২ || -৮৬৫.২ || -১৪৫
|-
|-
| সার্বিক ভারসাম্য || ১৭৯  || -২৮১  || ৪০৮  || ৮১৫  || ১৭১  || ৬৭  || ৩৩৮  || ১৪৯৩  || ৩৩১  || ২০৫৯
|সার্বিক ভারসাম্য || -৬৫৬ || ৪৯৪ || ৫১২৮ || ৫,৪৮৩ || ৪,৩৭৩ || ৫,০৩৬ || ৩,১৬৯ || -৮৫৭ || ১৭৯ || ২,৯২৫
|}
|}
''তথ্যসূত্র''  বাংলাদেশ ব্যাংক।


আমাদের লেনদেনের ভারসাম্যের মূলধনী এবং আর্থিক উভয় খাতই অর্থবছর ২০০০ থেকে একটি হতাশাব্যঞ্জক ছবি প্রকাশ করে আসছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (ADP) দূর্বল বাস্তবায়নের কারণে ঋণ ও সাহায্যের আন্তঃপ্রবাহ হ্রাস, নিম্নমাত্রার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক ঋণ সংকোচন এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপক মূলধন ধ্বসের ফলে বৈদেশিক বিনিয়োগের (FDI এবং Portfolio উভয়ই) নিম্ন আন্তঃপ্রবাহ, অন্যান্য দক্ষিণ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির দিকে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বৃদ্ধি এসব কারণ লেনদেনের ভারসাম্যের এসব খাতে এরকম বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। আমাদের জ্বালানি খাতের দূর্বলতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতিও এক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। এতসব সত্ত্বেও সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য ২০০৭ অর্থবছরে ১৪৯৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি স্বস্তিদায়ক স্তরে পৌঁছায়। বৈশ্বিক আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে ২০০৮ অর্থবছরে অবস্থা কিছুটা খারাপ হলেও ২০০৯ অর্থবছরে অবস্থার উন্নতি হয়ে লেনদেনের সামগ্রিক ভারসাম্য ২০৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। [সৈয়দ আহমেদ খান এবং এ. সামাদ সরকার]
নিম্নগামী আমদানি প্রবৃদ্ধির সাথে ঊর্ধ্বগামী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আর প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমূখী প্রবাহের কারণে ২০০০ সালের পর থেকে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমতে থাকে এবং ২০০২ সালের পর থেকে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে যা দু’একটি বছর ছাড়া ২০১৬ অর্থবচর পর্যন্ত বজায় থাকে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারেও একটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। ২০১৭ অর্থবছর থেকে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর চলতি হিসাবে আবার ঘাটতি দেখা দেয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সন্তোষজনক (৯ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সক্ষমতা) অবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোষাক শিল্পের প্রতিযোগিতায় নিজ অবস্থান (দ্বিতীয়) ধরে রাখা, রেমিট্যান্স এফডিআই প্রবাহ এবং সন্তোষজনক অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ (২০১৭ অর্থবছরের পর থেকে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি) অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বহিঃখাতের অনুকূল অবস্থা সহসায় ফিরে আসবে আশা করা যায়। [সৈয়দ আহমেদ খান এবং এ. সামাদ সরকার]
 
[[en:Balance of Payments]]
 
[[en:Balance of Payments]]
 
[[en:Balance of Payments]]


[[en:Balance of Payments]]
[[en:Balance of Payments]]

০৯:২৪, ২৬ মে ২০২৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

লেনদেন ভারসাম্য একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশ কর্তৃক বিভিন্ন খাতে বিশ্বের সকল দেশকে পরিশোধকৃত এবং সকল দেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ তথা সর্বপ্রকার আন্তর্জাতিক অন্য কথায়, লেনদেনের সমন্বিত হিসাব। দেশের আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান দ্রব্য, সেবা আমদানি-রপ্তানি, মূলধন তহবিলসহ বিদেশে সর্বপ্রকার অর্থ প্রেরণ এবং বিদেশ থেকে গ্রহণসংক্রান্ত লেনদেনসমূহের পার্থক্যই লেনদেন ভারসাম্য। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ভারসাম্যের হিসাবে ঘাটতির সম্মুখীন হয়ে আসছে। অত্যধিক আমদানি নির্ভরশীলতা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ তহবিল গ্রহণের কারণেই বাণিজ্যিক হিসাব খাতের ঘাটতি বাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাপী তেলের দ্রুত মূল্যবৃদ্ধির ফলে অপরিশোধিত তেল, পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদি এবং সার আমদানি খাতে বাংলাদেশের ব্যয় অত্যধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।

আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রণীত লেনদেন ভারসাম্য ম্যানুয়্যাল অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের লেনদেন ভারসাম্যের প্রকৃত অবস্থা চিহ্নিত ও প্রস্তুত করে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার অনুমোদিত ডিলারদের লেনদেনের বিবরণী, খাদ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক খাদ্যশস্য আমদানি-সংক্রান্ত দলিলাদি, বিদেশি সাহায্যপুষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য আমদানিকৃত দ্রব্যাদির রেকর্ড, শুল্ক বিভাগ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে রক্ষিত অন্যান্য দলিলাদি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। রপ্তানি বৃদ্ধিকল্পে নানাবিধ সুবিধা প্রদান ও কৌশল অবলম্বন এবং বিদেশে কার্যরত বাংলাদেশিদের অর্থপ্রেরণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতির হার অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ ঘাটতি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে ১,০০৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা জিডিপি-র ৭.০৮%-এ উন্নীত হয়। অর্থবছর ২০০২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত (২০০৫, ২০১১ ও ২০১২ ব্যতীত) প্রায় এক দশকের অধিককাল ধরে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্য ধারাবাহিকভাবে উদ্বৃত্ত থাকে। পরবর্তীতে ২০১৭ থেকে ২০২১ অর্থবছর পর্যন্ত চলতি হিসাবের লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বিরাজ করছে। জুন ২০২১ মাসে সমাপ্ত অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ডিসেম্বর ২০২০ শেষে বাংলাদেশের আইএমএফ-এসডিআর স্থিতির পরিমাণ ছিল ১.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

চিত্র ১ বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স (মিলিয়ন মার্কিন ডলার)

তথ্যসূত্র ইকনমিক ট্রেন্ড এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কোয়ার্টারলি, এপ্রিল-জুন ২০২১

দেশের আমদানি বাণিজ্যের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা সত্ত্বেও রপ্তানি আয় ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং তৎসঙ্গে লেনদেন ভারসাম্যের সেবাখাতের ঘাটতির পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় ১৯৯০-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস ও এর উন্নয়ন অব্যাহত থাকে যা ২০০২ সালের পর থেকে উদ্বৃত্ত এবং ২০১৭-২০২১ অর্থবছরগুলিতে ঘাটতি প্রদর্শন করলেও বাংলাদেশের বহিঃখাত একটা সুস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে ধরা যায়।





সারণি বাংলাদেশের লেনদেন ভারসাম্য অর্থবছর ২০১১-২০২০ (মিলিয়ন ইউ.এস ডলারে)।

বিষয়সমূহ ২০১১ ২০১২ ২০১৩ ২০১৪ ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯ ২০২০
রপ্তানি (এফওবি) ২২,৫৯২ ২৩,৯৮৯ ২৬,৫৬৭ ২৯,৭৭৭ ৩০,৬৯৭ ৩৩,৪৪১ ৩৪,০১৯ ৩৬,২৮৫ ৩৯,৬০৪ ৩২,৮৩২
আমদানি (এফওবি) ৩২,৫২৭ ৩৩,৩০৯ ৩৩,৫৭৬ ৩৬,৫৭১ ৩৭,৬৬২ ৩৯,৯০১ ৪৩,৪৯১ ৫৪,৪৬৩ ৫৫,৪৩৯ ৫০,৬৯০
বাণিজ্য ভারসাম্য -৯,৯৩৫ -৯,৩২০ -৭,০০৯ -৬,৭৯৪ -৬,৯৬৫ -৬,৪৬০ -৯,৪৭২ -১৮,১৭৮ -১৫,৮৩৫ -১৭,৮৫৯
সেবা (নীট) -২,৬১২ -৩,০০১ -৩,১৬২ -৪,০৯৬ -৩,১৮৬ -২,৭০৮ -৩,২৮৮ -৪,২০১ -৩,১৭৭ -২,৫৪১
প্রাথমিক আয় (নীট) -১,৪৫৪ -১,৫৪৯ -২,৩৬৯ -২,৬৩৫ -২,২৫২ -১,৯১৫ -১,৮৭০ -২,৬৪১ -২,৯৯৩ -৩,১০৬
সেকেন্ডারি আয় ১২,৩১৫ ১৩,৪২৩ ১৪,৯২৮ ১৪,৯৩৪ ১৫,৮৯৫ ১৫,৩৪৫ ১৩,২৯৯ ১৫,৪৫৩ ১৬,৯০৩ ১৮,৭৮০
প্রবাসী রেমিট্যান্স স্থানান্তর ১১,৫১৩ ১২,৭৩৪ ১৪,৩৩৮ ১৪১,১৬ ১৫,১৭০ ১৪,৭১৭ ১২,৭৬৯ ১৪,৭০৩ ১৬,১৯৬ ১৮,০১৪
চলতি হিসাব ভারসাম্য -১,৬৮৬ -৪৪৭ ২,৩৮৮ ১,৪০৯ ৩,৪৯২ ৪,২৬২ -১,৩৩১ -৯,৫৬৭ -৫,১০২ -৪,৭২৩
মূলধন হিসাব ৬৪২ ৪৮২ ৬২৯ ৫৯৮ ৪৯৬ ৪৬৪ ৪০০ ৩৩১ ২৩৯ ২৫৬
আর্থিক হিসাব ৬৫১ ১,৪৩৬ ২,৮৬৩ ২,৮১৩ ১,২৬৭ ৯৪৪ ৪,২৪৭ ৯,০১১ ৫,৯০৭.২ ৭,৫৩৭
(১) এফডিআই ৭৭৫ ১,১৯১ ১,৭২৬ ১,৪৩২ ২,৫২৫ ২,৫০২ ৩,০৩৮ ৩,২৯০ ৪,৯৪৬ ৩,২৩৪
(২) পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ১০৯ ২৪০ ৩৬৮ ৯৩৭ ৩৭৯ ১৩৯ ৪৫৭ ৩৪৯ ১৭২ ৪৪
(৩) অন্যান্য বিনিয়োগ (নীট) -২৩৩ ৭৬৯ ৪৪৪ -২৮৪ -৪৮০ ২,১৩৭ ৬,৮৮৪ ৩,১০৮ ৬,২২২
ভুল-বিচ্যুতি -১,৩৭৬ -৯৭৭ -৭৫২ ৬৬৩ -৮৮২ -৬৩৪ -১৪৭ -৬৩২ -৮৬৫.২ -১৪৫
সার্বিক ভারসাম্য -৬৫৬ ৪৯৪ ৫১২৮ ৫,৪৮৩ ৪,৩৭৩ ৫,০৩৬ ৩,১৬৯ -৮৫৭ ১৭৯ ২,৯২৫

তথ্যসূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক।

নিম্নগামী আমদানি প্রবৃদ্ধির সাথে ঊর্ধ্বগামী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আর প্রবাসী আয়ের ঊর্ধ্বমূখী প্রবাহের কারণে ২০০০ সালের পর থেকে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমতে থাকে এবং ২০০২ সালের পর থেকে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে যা দু’একটি বছর ছাড়া ২০১৬ অর্থবচর পর্যন্ত বজায় থাকে। এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারেও একটি স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে। ২০১৭ অর্থবছর থেকে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর চলতি হিসাবে আবার ঘাটতি দেখা দেয়। তবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের সন্তোষজনক (৯ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের সক্ষমতা) অবস্থা, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোষাক শিল্পের প্রতিযোগিতায় নিজ অবস্থান (দ্বিতীয়) ধরে রাখা, রেমিট্যান্স ও এফডিআই প্রবাহ এবং সন্তোষজনক অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ (২০১৭ অর্থবছরের পর থেকে শতকরা ৩০ ভাগের বেশি) অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের বহিঃখাতের অনুকূল অবস্থা সহসায় ফিরে আসবে আশা করা যায়। [সৈয়দ আহমেদ খান এবং এ. সামাদ সরকার]