হোসায়েন, দেলোয়ার

হোসায়েন, দেলোয়ার (১৮৪০-১৯১৬)  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান গ্রাজুয়েট। তিনি ছিলেন সরকারি আমলা ও মুসলিম সংস্কারবাদী লেখক। হুগলি জেলা নিবাসী (আরসাহ পরগনার বাউবনাম গ্রাম) দেলোয়ার হোসায়েন বিশেষভাবে আহমেদ মির্জা দেলোয়ার হোসায়েন নামে সমধিক পরিচিত। তৎকালীন ভারতীয়দের জন্য সিভিল সার্ভিসে সর্বোচ্চ পদ নিয়ে তিনি তাঁর চাকরিজীবন শুরু করেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর (প্রথম শ্রেণির) পদে থাকাকালীন ১৮৯৪ সালে তিনি সিভিল সার্ভিস থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর সমসাময়িক নওয়াব  আবদুল লতিফ ও স্যার সৈয়দ আহমদও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন অবসর গ্রহণ করেন। উভয়ই চাকরি জীবনের পাশাপাশি সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং ব্রিটিশ-ভারত সাম্রাজ্যে তাঁদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন রাজকীয় পদবিতে ভূষিত হন। কিন্তু, দেলোয়ার হোসায়েন এ ধরনের কোন উচ্চ পদবিতে ভূষিত হন নি, যদিও তিনি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম গ্রাজুয়েট এবং ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা ও ব্রিটিশ শাসনের পক্ষের একজন প্রবক্তা ছিলেন। অবশ্য অবসর গ্রহণ কালে তিনি ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত হন। এটি ছিল সমসাময়িক মর্যাদাবান ও অনুগত মুসলমানদের জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত অতি সাধারণ একটি খেতাব।

দেলোয়ার হোসায়েন সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করার রাজনীতি পছন্দ করতেন না এবং স্বভাবগতভাবেই সাধারণ জনতার নৈকট্য পরিহার করে চলতেন। তিনি জনতার করতালির চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক নির্জনতা বেশি পছন্দ করতেন। অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি লেখক হিসেবে ছদ্মাবরণে থাকাই পছন্দ করেছেন। তিনি ‘ইস্তনিয়াহু আহমেদ’, ‘মুতাজালেহ’ ও ‘সাঈদ’ ছদ্মনামে লিখতেন। অবসর গ্রহণের পরই তিনি স্বনামে লিখতে শুরু করেন। তিনি The Moslem Chronicle ও The Mussalman পত্রিকায় প্রায়শই লিখতেন। তিনি ভালভাবেই জানতেন যে, মাতৃভাষায় লেখাই একজন লেখকের প্রতিষ্ঠা লাভের প্রধান পথ, তথাপি তিনি মাতৃভাষায় লিখতেন না।  সে কারণেই সরকারি আমলা এবং ইংরেজি ভাষার লেখক দেলোয়ার হোসায়েন এলিট শ্রেণিভুক্ত হয়ে সারাজীবন জনমানসের অগোচরেই  রয়ে যান।

সময়ের অগ্রগামী চিন্তাবিদ দেলোয়ার হোসায়েন-এর লেখালেখি এখন বিদ্বান শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তাঁর দুই খন্ডের গ্রন্থ Essays on Mohmmedan Social Reform (থ্যাকার স্পিংক অ্যান্ড কোং, কলকাতা, ১৮৮৯) এবং অন্যান্য লেখায় তাঁর চিন্তাধারার মৌলিকত্বের প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক রচনায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের বিষয়টি এক অনন্য ধারণায় রূপ লাভ করেছে। তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তার জন্য তিনি নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়ার পক্ষে ছিলেন। তাঁর মতে, শিক্ষা ও বস্ত্তগত সম্পদে মুসলমানরা হিন্দুদের সমকক্ষতা অর্জনের পূর্বপর্যন্ত তাদের উচিত আলাদা রাজনৈতিক পরিচয় রক্ষা করা। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, যদি কখনও এ ধরনের সমকক্ষতা অর্জিত হয় তাহলে কেবল যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হবে তাই নয়, একটি রাজনৈতিক প্রয়োজনও সিদ্ধ হবে।  [সিরাজুল ইসলাম]