হরিকেল

হরিকেল প্রাচীন পূর্ববঙ্গের একটি জনপদ। এর শনাক্তীকরণ নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। খ্রিস্টীয় সাত শতকের প্রাচীন ভারতীয় লেখকগণ পূর্বভারতীয় একটি অঞ্চলকে হরিকেল বলে উলে­খ করেন। এটি পূর্ববঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। সাত শতকের চৈনিক পরিব্রাজক  ই-ৎসিঙ্ হরিকেলের অবস্থানকে ‘পূর্বভারতের পূর্বসীমা’য় নির্দেশ করেন। নয় শতকের সাহিত্য কর্ম কর্পূরমঞ্জরীতে এ বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। এতে হরিকেলের রমণীগণকে পূর্ব বঙ্গীয় নারীাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ই-ৎসিঙ্ কিংবা অন্য কেউ এর ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে কোন বিশদ বিবরণ দেন নি। এ অবস্থায় যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের ঊর্ধ্বে এর অবস্থান নির্দিষ্ট ও শনাক্ত করা দুরূহ।

অধিকন্তু, এ সম্পর্কে পরবর্তী সময়ের লেখক ও কাহিনীকারদের বেশ কিছু বিভ্রান্তিকর ও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আছে। এর ফলে বিলুপ্ত এ রাজ্যের অবস্থান নিরূপণ ও শনাক্তীকরণে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বারো শতকের অভিধান রচয়িতা হেমচন্দ্র তাঁর অভিধানচিন্তামণিতে হরিকেলকে বঙ্গের সমকক্ষরূপে বর্ণনা করেন। কিন্তু মঞ্জুশ্রীমূলকল্পে এ বক্তব্যকে অস্বীকার করা হয়েছে। এতে হরিকেল,  বঙ্গ এবং  সমতটকে স্বতন্ত্র সত্তা রূপে দেখানো হয়েছে।

কিন্তু এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর বর্ণনা পাওয়া যায় বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংগৃহীত দুটি পরবর্তীসময়ের পান্ডুলিপিতে। কোন উৎস বা কোন প্রমাণাদির উল্লেখ ছাড়াই এদুটি পান্ডুলিপিতে হরিকোলকে (সম্ভবত হরিকেলের সাথে অভিন্ন) সিলেটের সমার্থক রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ বর্ণনা হরিকেল শনাক্তকরণ বিষয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।

বলা যায় যে, হরিকেল প্রাচীন বঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ছিল। এ অঞ্চলের সকল রাজ্যের মধ্যে হরিকেল সবচেয়ে বেশি পরিচিত হলেও এর রয়েছে সবচেয়ে কম প্রমাণপত্রাদি। এর প্রধান কারণ সম্ভবত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে বহু দূরে দেশের এক অখ্যাত স্থানে এর অবস্থিতি। তবে এর অবস্থান সম্পর্কে ই-ৎসিঙ্ বেশ স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন।

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ অঞ্চলের একটি পুরানো মন্দিরে আবিষ্কৃত কান্তিদেবের (খ্রিস্টীয় নয় শতক) অসম্পূর্ণ তাম্রলিপিটি হরিকেল সম্পর্কিত সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য দলিল। এতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, মহারাজাধিরাজ কান্তিদেব হরিকেলের শাসক ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এ লেখ থেকে কান্তিদেব বা তাঁর রাজ্য সম্পর্কে আর কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

এগারো শতকের পান্ডুলিপি অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতায় বঙ্গের বিভিন্ন অংশে পূজিত বেশ সংখ্যক মহাযান বৌদ্ধ দেবতাদের সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে। এতে ‘হরিকেলের লোকনাথ’-এর বর্ণনা আছে। তেরো শতকের একটি বৌদ্ধ পান্ডুলিপি ডাকার্ণবে বঙ্গের বৌদ্ধ তন্ত্রের ৬৪টি পবিত্রস্থান বা পীঠস্থানের একটি তালিকাতে হরিকেলও অন্তর্ভুক্ত। তাই স্পষ্টতই দেখা যায় যে, হরিকেল তখন পর্যন্ত বঙ্গে বেশ পরিচিত ও বিখ্যাত ছিল, যদিও এ সম্পর্কে বিশদ কোন বিবরণ নেই।

বঙ্গের চন্দ্রবংশীয় শাসকদের (দশ-এগারো শতক) লেখসমূহ নির্ভুলভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, তাদের আদি বাসভূমি হরিকেল সীমার মধ্যে ছিল এবং সে রাজ্যটি সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা থেকে রাজ্যের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে ও খ্যাতি লাভ করেছে। এ বিষয়ে শ্রীচন্দ্রের বেশ কিছু ফলকে গূঢ় অর্থবোধক একটি রূপকশোভিত উক্তিতে সবচেয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়েছে। উক্তিটি এরূপ: আধারো হরিকেল-রাজ-ককুদ-চ্ছত্র-স্মিতানাম্ শ্রিয়াম্।’ এর অর্থ, বংশের প্রথম শাসক  ত্রৈলোক্যচন্দ্র কার্যত এবং আইনত উভয় প্রকারেই হরিকেলের রাজা ছিলেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্র তাঁর পিতার কাছ থেকে হরিকেল রাজ্যের একজন সামন্তের মর্যাদা লাভ করেন এবং তিনিই শক্তি সঞ্চয় করে হরিকেল রাজার প্রধান সহায়ক শক্তি হন এবং সে অবস্থা থেকে তিনি একজন সার্বভৌম রাজা হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, চন্দ্রবংশীয় লেখসমূহে এ রাজ্যের অবস্থান নির্ণয় ও শনাক্তীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় কোন তথ্যই পাওয়া যায় না। যাহোক, চন্দ্র বংশের লেখসমূহের উপর পর্যালোচনা ও গবেষণা এবং বঙ্গে তাদের বিজয় সম্পর্কে যথার্থ বিশ্লেষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে,  আরাকান সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম এলাকায় এ রাজ্য অবস্থিত ছিল। এ ধারণার আরও জোরালো সমর্থন পাওয়া যায় চট্টগ্রামে কান্তিদেবের  তাম্রশাসনের আবিষ্কারে।

সম্প্রতিকালে  ময়নামতীতে আবিষ্কৃত  হরিকেল মুদ্রাসমূহে উপরিউক্ত ধারণার একটি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। হরিকেল যে সমতটের নিকট অঞ্চলে এবং আরাকান অভিমুখে তার জোরালো সমর্থন এসব আকিষ্কারের ফলে মেলে। ‘বুল ও ট্রিগলিফ’ (Bull and Triglyph) রীতির প্রায় চারশত মুদ্রার বিশাল সংগ্রহের মধ্যে প্রাচীন আরাকান রাজাদের বেশ কিছু নমুনা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অবশিষ্টগুলিতে উৎকীর্ণ শব্দের পাঠ যা ইতিপূর্বে জারিক্রিয়, পটিকের ইত্যাদি রূপে করা হয়েছে, তা এখন শুদ্ধ রূপে ‘হরিকেল’ পড়া হয় এবং এ পাঠ বর্তমানে পন্ডিতগণ গ্রহণ করেছেন। কেবল হরিকেলের ঐতিহাসিক ভৌগোলিক সীমানানির্দেশই নয়, বরং প্রশ্নাতীতভাবে এ অঞ্চলের অন্যান্য আরও অশনাক্তীকৃত রাজ্যের জন্যও এ পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত না হলেও স্পষ্ট ও যথাযথভাবেই বলা যায় যে, হরিকেলের অবস্থান এখন সুনির্দিষ্ট।

বর্তমানে চট্টগ্রামের কেন্দ্রস্থলে আবিষ্কৃত জোবরা মুদ্রাগুলিকে ‘চূড়ান্ত প্রমাণের’ জন্য দেখানো হয়। ‘বুল ও ট্রিগলিফ’ ধরনের ৩৬টি পাতলা রৌপ্য মুদ্রা হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ জোবরা গ্রামে একটি ছোট মাটির পাত্রে পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৩৫টিতে হরিকেল প্রতীক এবং একটিতে প্রাচীন আরাকান রাজ প্রীতিচন্দ্রের প্রতীক অঙ্কিত রয়েছে।

যদিও হরিকেলের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কিত চূড়ান্ত প্রমাণাদি এখনও নেই, তবুও এ তথ্যগুলি নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, প্রাচীন হরিকেল রাজ্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে, খুব সম্ভবত রামু, দিয়াঙ্গ অথবা চট্টগ্রামের নগরাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। এটা কোন চূড়ান্ত সমাধান নয়, এটা শুধু হরিকেলের অবস্থান কোথায় হতে পারে তার ইঙ্গিত দেয়। এ সমস্যার একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান চট্টগ্রাম অঞ্চলে রামু ও রামকাত, দিয়াঙ্গ ও চট্টগ্রামে ব্যাপক ও জোরালোভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে নিহিত।

পার্বত্যময় চট্টগ্রাম অঞ্চল প্রাচীনকালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর পাহাড়ি ও কিছুটা অগম্য অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বার্মা, কম্বোডিয়া ও আরও দূরবর্তী এশিয়ার সাথে যোগাযোগ পথ ছিল এবং এ পথটি ভারতের পূর্বদিকের প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহূত হতো। সমগ্র প্রাচীনকালে বঙ্গ ও আরাকানের মধ্যকার নিবিড় যোগাযোগ এ অঞ্চলের মাধ্যমেই বিদ্যমান ছিল। সংকীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল কয়েকটি নিচু ভূমি দ্বারা বিন্যস্ত এবং পাহাড়ি ছোট নদী দ্বারা সিক্ত ছিল। ফলে এ অঞ্চল ছিল খুবই উর্বর। সাংস্কৃতিক দিক থেকেও এ অঞ্চল সমৃদ্ধ ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ অঞ্চলের অতীত সম্পর্কে খুব কমই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়েছে। তবে নিম্নোক্ত অঞ্চলসমূহে যথার্থ প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো হলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে।

প্রাচীনকালে দেশের দক্ষিণাঞ্চল, কক্সবাজারের নিকটস্থ আরাকানের পথে রামু ও রামকোট সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এ রামু, রামা বা রম্য আরব লেখকদের লেখায় রহমা বা রুহমি রাজ্য নামে উল্লিখিত হয়েছে। যদি চৈনিক পরিব্রাজক ই-ৎসিঙ্-এর বর্ণনানুসারে হরিকেল পূর্বভারতের পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত হয়ে থাকে, তাহলে রামু এর অতীত সম্পর্কে কিছু তথ্য সরবরাহ করতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর মতো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ রামুর আছে।

রামুর সন্নিকটে এবং প্রাচীন আরাকানের পথে রামকোট বনাশ্রম সংলগ্ন প্রাচীন শৈল শ্রেণির উপর বিস্তৃত এক বিশাল এলাকায় প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন দেখা যায় এবং এখানে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে প্রাচীন নিদর্শনসমূহ বর্তমান। এলোমেলো খননের ফলে কৌতূহলোদ্দীপক অনেক প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে একটি খোদাইকৃত পাথরের ফলক, প্রচুর পোড়া মাটির অলঙ্করণাদি, পাথরের মূর্তি ও পাথরের টুকরাসমূহ।

সম্ভবত দেবগ্রাম থেকে উদ্ভূত দিয়াঙ্গ এখন বন্দর নগরীর বিপরীতে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীর ধরে বাহিত একটি নিচু শৈল শিরা রূপে টিকে আছে। এখানে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের   প্রমাণ পাওয়া যায়। এখানে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। দিয়াঙ্গ শৈল শ্রেণির পাদদেশে ঝেওয়ারী গ্রামে ১৯৭২ সালে ৬৪টি উৎসর্গীকৃত তাম্রমূর্তি, ২টি সূতপের অংশ ও অনেক টুকরা আবিষ্কৃত হয়। এর মধ্যে ২৫টি উৎকীর্ণ মূর্তি। এখানে প্রাপ্ত অন্যান্য নিদর্শনসহ ঝেওয়ারী ভান্ডারটি দিয়াঙ্গের প্রাচীনত্ব এবং সমতট ও আরাকানের সাথে এর প্রাচীন সংযোগ সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণাদি সরবরাহ করে।

তিববতীয় ঐতিহাসিক  লামা তারনাথ ‘চটেগ্রাম’কে গোপিচন্দ্রের রাজধানী রূপে উল্লেখ করেন। নগরটি সম্ভবত আরব ভৌগোলিকদের ‘সমন্দার’ এবং প্রাচীন ইউরোপীয় লেখকদের ‘বেঙ্গলা’র সাথে অভিন্ন। তিববতীয় সূত্র থেকে আরও জানা যায় যে, অতীতে চাটিগ্রামে (চট্টগ্রাম) অনেক তির্থিকস (মন্দির) ও বিহার (বৌদ্ধ মঠ) ছিল। এ চাটিগ্রাম রম্ম দেশের রাজধানী ছিল। রম্ম বৌদ্ধদের বিখ্যাত একটি কেন্দ্র ছিল।

বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুসারে, ‘চৈত্যগ্রাম’ থেকে শহরটির নাম উদ্ভূত। বিখ্যাত ‘পন্ডিত বিহার’ সম্ভবত চট্টগ্রাম শহর বা এর সন্নিকটে অবস্থিত ছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, এ নগরেরই একটি পুরানো মন্দির থেকে হরিকেলের মহারাজা কান্তিদেবের তাম্রশাসনটি উদ্ধার করা হয়।  [এম হারুনুর রশীদ]