সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন

সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন  ১৮৭৭ সালে  সৈয়দ আমীর আলী কর্তৃক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক সংগঠন। আমীর আলী ছিলেন প্রথম মুসলিম নেতা যিনি মুসলমানদের জন্য একটি রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একজন নেতার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার চেয়ে সংগঠনের মাধ্যমে দলগত প্রচেষ্টা অধিক ফলপ্রসূ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলমানরা তাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। তাদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার অভাব ছিল এবং তারা হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা শাসিত এবং কিছু ক্ষেত্রে শোষিত হতো। তৎকালীন ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন,  ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রভৃতি রাজনৈতিক সংগঠনে ছিল হিন্দুদের প্রাধান্য। কাজেই এসব সংগঠন তাঁর ধর্মের লোকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারবে না। তাই মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তিনি গড়ে তোলেন একটি সংগঠন। তিনি চেয়েছিলেন মুসলমানদের মাঝে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যপ্রবণতা সৃষ্টি করতে, যাতে তাদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সন্দেহ দূর হয়। দেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তিনি সম্প্রীতি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মুসলমানদের কল্যাণ সাধনই ছিল সংগঠনটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এর উদ্দেশ্য ছিল নৈতিক মূল্যবোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের চেতনা ফিরিয়ে এনে মুসলমানদের পুনরুজ্জীবিত করা।

মাত্র ২০০ সদস্য নিয়ে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন যাত্রা শুরু করলেও পাঁচ বছরের মধ্যে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ছয়শ-তে পৌঁছে। আমীর আলী তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বাংলা, বিহার, বোম্বাই, যুক্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, এমনকি লন্ডনে এর প্রায় ৫০টি শাখা খোলেন। সচরাচর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাই এই সংগঠনের সদস্য হতেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও এর সদস্য হতে পারতেন। এটি মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণে যেকোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্ত্তত ছিল।

মুসলমানদের আধুনিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধকরণ ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সংগঠনের কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম ছিল; অ্যাসোসিয়েশরেন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সভা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা ও বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা, সংবাদপত্র ও জনসভার মাধ্যমে মুসলমানদের সমস্যা ও অধিকার সম্বন্ধে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করা প্রভৃতি। সৈয়দ আমীর আলী নিজে সংগঠনের ব্যানারে স্মারকলিপি পেশ করতেন এবং কর্তৃপক্ষের নিকট নিয়মিত প্রতিনিধিদল প্রেরণ করতেন। তাছাড়াও গভর্নর জেনারেল ও লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের সংবর্ধনা প্রদান করতেন। অ্যাসোসিয়েশন মূলত মুসলমানদের শিক্ষা ও রাজনৈতিক উন্নয়নের জন্য কাজ করত। ১৮৮১ সালে মুসলমানদের শিক্ষার সমস্যাবলি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ ছিল অ্যাসোসিয়েশনের একটি উলে­খযোগ্য কাজ। আমীর আলীর নেতৃত্বে অ্যাসোসিয়েশন ১৮৮২ সালে  হান্টার কমিশনের নিকট একটি লিখিত বক্তব্য পেশ করে। এ বক্তব্যে বলা হয়, মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের পূর্ব অনুসৃত ঘৃণা পরিত্যাগ করেছে এবং এখন তারা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুক। কিন্ত চরম দারিদ্র্য এ পথে তাদের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সৈয়দ আমীর আলী ১৮৮২ সালে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে ‘'A cry from the Indian Muhamedans’ শীর্ষক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপিতে আবেদন করা হয় যে, মুসলমানরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনুগত, কিন্তু তাদের দুরবস্থার কারণে তারা অসন্তুষ্ট। তারা চাকরির সুযোগ এবং সমাজে সম্মানজনক অবস্থান হতে বঞ্চিত। এভাবে ক্রমাগত চাপ প্রয়োগে অ্যাসোসিয়েশন একটি বড় রকমের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়। ১৮৮৫ সালে সরকার মুসলিম শিক্ষার ওপর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সৈয়দ আমীর আলী এই সিদ্ধান্তকে মুসলমানদের জন্য ম্যাগনাকার্টা রূপে গণ্য করেন।

ভারতে ও ইংল্যান্ডে যুগপৎ আই.সি.এস পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং মনোনয়ন পদ্ধতি বলবৎ রাখার জন্য  সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর দাবির বিরোধিতা করে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের দাবি ছিল ব্যাপক হারে মুসলমানদের নিয়োগ, নির্বাহি পরিষদের সম্প্রসারণ ও ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ। স্থানীয় পরিষদসমূহে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের দাবি করা হয়েছিল। সৈয়দ আমীর আলীর নেতৃত্বে অ্যাসোসিয়েশনের আন্দোলন ফলপ্রসু হয় যখন ১৮৯২ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট পাস হয়। এই আইন বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দলের স্বার্থ রক্ষার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

আমীর আলী অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯০৬ সালে  মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি ছিল মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সংগঠনটি মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে। এটি বিচ্ছিন্নতার নীতি পরিহার করে সক্রিয় অংশগ্রহণ নীতি অনুসরণে মুসলমানদের উদ্বুদ্ধ করে। সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে সৈয়দ আমীর আলী মুসলমানদের পুনর্জাগরণ ও আধুনিকায়নের পথ প্রশস্ত করেন। ১৯০৪ সালে যখন তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন, তখন সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে এর স্বাভাবিক বিলুপ্তি ঘটে।  [আব্দুল খালেক]