সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ

সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ভারতীয় জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার আরও একটি পদক্ষেপ হিসেবে প্রাদেশিক আইনসভা গঠন বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক জারীকৃত একটি নীতিনির্ধারণী দাপ্তরিক নির্দেশনা বা রোয়েদাদ। এই রোয়েদাদে আইনসভায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব এবং আনুপাতিক আসনসংখ্যা নিরূপণের পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। রোয়েদাদে বিধৃত নীতিমালা পরবর্তী সময়ে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে এবং এরই ভিত্তিতে আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৩১ সালে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপ্তি পর্বেও যখন ভারতীয় নেতৃবর্গ সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনো সাংবিধানিক সমাধানে উপনীত হতে ব্যর্থ হন তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড স্পষ্টতই জানিয়ে দেন যে, ভারতের বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় ও স্বার্থগোষ্ঠী যদি কোনো ঐক্যমত বা মীমাংসায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয় তাহলে ব্রিটিশ রাজ একটি সাময়িক পরিকল্প আরোপ করতে বাধ্য হবেন।

১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক একটি অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে শুরু হয়। কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মহাত্মা গান্ধী বৈঠকে যোগ দেন। দেশীয় রাজ্যের রাজারা কোনো ফেডারেশনে অন্তর্ভুক্ত হতে অনীহা প্রকাশ করেন। শিখদের পক্ষ থেকে বৈঠকে যোগ দেন দুজন প্রতিনিধি। বৈঠকে উপস্থিত ১১৪ জন প্রতিনিধির মধ্য থেকে ৫১ জন সদস্য সমন্বয়ে একটি ‘মাইনরিটি কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটিকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত মতামত ও দাবির নিরীখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষার প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি সুপারিশ পেশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মুসলিম প্রতিনিধিরা এতোটাই জোরালোভাবে স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষে তাদের দাবি তুলে ধরেন যে, তাতে কমিটির আলোচনার অগ্রগতি কঠিন হয়ে পড়ে। তারা দাবি করেন যে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ পাঞ্জাব ও বাংলায় আইনসভার আসন প্রকৃত জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নির্ধারিত হবে, আর যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেখানে আলোচনার মাধ্যমে এবং ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌতে স্বাক্ষরিত কংগ্রেস-মুসলিম লীগ চুক্তির শর্তানুযায়ী মুসলমানদের অনুকূলে আসনের অনুপাত নির্ধারণ করতে হবে। দ্বিতীয় বৈঠকে উপস্থিত অপর প্রধান পক্ষগুলোর মধ্য থেকে মুসলিম নেতারা শুধুমাত্র তথাকথিত ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু দলিত শ্রেণী, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং ভারতীয় খ্রিস্টানদের একটি অংশের সমর্থন লাভে সক্ষম হন। এদের প্রতিটি পক্ষই মুসলমানদের দাবির সঙ্গে তাদের নিজেদের দাবি যুক্ত করা সুবিধাজনক মনে করে। কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের কোনো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হন। এরপর মুসলিম, হিন্দু দলিত সম্প্রদায়, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও ব্রিটিশ স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা সম্মিলিতভাবে একটি যৌথ বিবৃতি পেশ করেন এবং দাবি করেন যে, টেকে তো পুরোটাই টিকুক আর বাতিল হলে পুরোটাই হোক। দ্বিতীয় বৈঠকের একমাত্র ফলশ্রুতি হলো কংগ্রেস এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষত মুসলিম লীগের মধ্যকার বিভেদ ও দূরত্বের বিস্তৃতি। এই করে মীমাংসার উদ্যোগটি বস্ত্তত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হাত থেকে ব্রিটিশ সরকারের এক্তিয়ারে চলে যায়। এর নয় মাস পর এবং ইতোমধ্যে গঠিত একটি পরামর্শক কমিটির আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির মীমাংসার শেষ চেষ্টার পর এবং তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক শুরুর আগে ম্যাকডোনাল্ডের উক্তি ও সতর্কবানী বাস্তব রূপ নেয় একটি সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের আকারে। ১৯৩২ সালের ১৬ আগস্ট ঘোষিত এ রোয়েদাদের দাপ্তরিক নাম দেয়া হয় সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত।

প্রাদেশিক আইনসভা গঠন ও নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর পরস্পর বিরোধী দাবির একটি একতরফা মীমাংসার আকারে রোয়েদাদটি জারী করা হয়। এই রোয়েদাদে শুধু ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর জন্য আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণের পদ্ধতিই বিধিবদ্ধ হয় নি, এতে বিধৃত হয়েছে প্রতিটি সম্প্রদায়কে অপরের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কতটা আসন প্রদান করা হবে, সম্প্রদায় নিরপেক্ষ বিশেষ জনগোষ্ঠীকে কি পদ্ধতিতে কতটা আসন দেয়া হবে এবং নির্ধারিত হয়েছে আইন সভাগুলোর সদস্য সংখ্যা। এ রোয়েদাদের মাধ্যমে কার্যত ভারতীয় নির্বাচকমন্ডলীকে আরো বেশি খন্ডিত ও বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।

রোয়েদাদে নিম্নোক্ত সাম্প্রদায়িক নির্বাচনী এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে: সাধারণ (হিন্দু ও অবশিষ্ট সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নিয়ে গঠিত), মুসলিম, শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, ইউরোপীয়, হিন্দু দলিত সম্প্রদায় (সাধারণ নির্বাচনী এলাকায়ও ভোটাধিকারী) এবং উপজাতি বা অনুন্নত এলাকা। পৃথক নির্বাচনের অধিকার শুধুমাত্র ভারতে মুসলমানদেরই দেয়া হয় নি, সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই দেয়া হয়েছে। এ রোয়েদাদে হিন্দু দলিত শ্রেণীকে সংখ্যালঘু হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়, এবং এই করে তাদের এমন কিছু বিশেষ আসন দেয়া হয় যেসব আসন সংশি­ষ্ট এলাকার অধিবাসী দলিত শ্রেণীর বিশেষ ভোটারদের দ্বারা পূরণ করা হবে। মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে কিছুটা পরিবর্তনসহ মুসলমানদের জন্য weightage নীতিও বহাল করা হয়েছে। এই নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে বাংলা ও আসামে ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে, পাঞ্জাব ও উক্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে শিখদের ক্ষেত্রে এবং সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হিন্দুদের ক্ষেত্রে। মুসলমানরা পাঞ্জাবের মোট জনসংখ্যার ৫৬% হলেও তাদের পাঞ্জাব আইনসভার ১৭৫ আসনের মধ্যে মাত্র ৮৬টি আসন দেয়া হয়। এরূপে পাঞ্জাবে সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়। এই ফর্মুলায় সর্বাধিক সুবিধা পেয়েছে পাঞ্জাবের শিখ এবং বাংলার ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। প্রাদেশিক আইনসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাদের জন্য বিশেষ আসনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রোয়েদাদে কতিপয় বিশেষ নির্বাচনী এলাকা সংরক্ষণ করা হয়, যেমন শ্রমিক শ্রেণী, ব্যবসায়ী, জমিদার শ্রেণী ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।

এই সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ বস্ত্তত ভারতের কোনো রাজনৈতিক দলেরই পছন্দসই ছিল না। মুসলমানরা এ রোয়েদাদে সন্তুষ্ট হতে পারে নি, কারণ এতে করে পাঞ্জাব ও বাংলায় তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংখ্যা লঘিষ্টে পরিণত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও মুসলমানরা এ রোয়েদাদকে গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়। ১৯৩৩ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়: ‘এই রোয়েদাদে মুসলমানদের দাবির যৎসামান্য পূরণ হলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মুসলমানরা এই শর্তে রোয়েদাদকে মেনে নিচ্ছে যে, সকল দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তাদের চাপ প্রয়োগের অধিকার অব্যাহত থাকবে।’

পক্ষান্তরে হিন্দু সম্প্রদায় এ রোয়েদাদ মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। হিন্দু দলিত শ্রেণীর (অস্পৃশ্য) লোকদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে মেনে নেয়া তাদের পক্ষে মোটেও সম্ভব ছিল না। তারা এলাহাবাদ ঐক্য সম্মেলন আয়োজন করে ওই সম্মেলনে স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানায়। বেশসংখ্যক জাতীয়তাবাদী মুসলমান ও শিখরা এ সম্মেলনে যোগ দেয়। কংগ্রেস গোটা রোয়েদাদকেই প্রত্যাখ্যান করে। রোয়েদাদে দলিত শ্রেণীর জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন ব্যবস্থা প্রয়োগের কারণে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরিত এক পত্রে এ ব্যবস্থা বাতিলের দাবি করেন, অন্যথা তিনি আমরণ অনশন করবেন বলেও জানান। ব্রিটিশ সরকার অনুধাবন করেন যে, গান্ধীর এই বক্তব্যে যুক্তি রয়েছে যে দলিত শ্রেণী হিন্দু সম্প্রদায়েরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে সরকার প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করেন। এরপর মহাত্মা গান্ধী দলিত সম্প্রদায়ের নেতা ডাঃ বি. আর আম্বেদকরের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পর পারস্পরিক সমঝোতায় উপনীত হন এবং উভয়পক্ষে পুনা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৩২ সালের সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে দলিত শ্রেণীর জন্য যে আসন সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছিল পুনা চুক্তির শর্তানুযায়ী এই সম্প্রদায়কে সাধারণ হিন্দু কোটা থেকে তার চেয়েও অধিক আসন বরাদ্দ দেয়া হয়।  [মাসুদুর রহমান খান]