সাম্প্রদায়িকতা

সাম্প্রদায়িকতা বাংলার হিন্দু-মুসলমান বিরোধের ফসল। ব্রিটিশ রাজের নাগপাশ থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই বিষয়টি এমন সব ঘটনাবলির ফল, যেগুলিকে অনেক সময়ই স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে স্ববিরোধী বলে মনে হয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে ওঠার সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতা আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে উপমহাদেশ ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়।

বাংলার সাম্প্রদায়িকতা স্বভাবতই সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কারণ ও প্রকৃতি নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের অবতারনাও হয়েছে। সাম্প্রতিক গবেষণা হিন্দু প্রাধান্য এবং মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপনের বিশেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ১৮৭১ সালের আদমশুমারি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বাংলার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধাংশ ছিল মুসলমান, যাদের অধিকাংশের বাস ছিল পূর্ব-বাংলার জল-কাদাময় নিম্নভূমিতে। মোটামুটি সেই সকল এলাকা নিয়েই বর্তমান বাংলাদেশ গঠিত। ময়মনসিংহ, পাবনা, বগুড়া, বাকেরগঞ্জ (বরিশাল), নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের মতো জেলাগুলিতে শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি লোক ছিল মুসলমান।

মুসলমানদের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অবশ্য প্রদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয় নি। সম্প্রদায় হিসেবে তারা জীবিকা নির্বাহ করত মূলত চাষি কৃষক এবং হিন্দু  জমিদার কর্তৃক নিয়োজিত খেতমজুর হিসেবে। মুসলমান চাষীদের ওপর হিন্দু প্রাধান্য আরও দৃঢ় হয়েছিল ঋণের জন্য হিন্দু  মহাজন-এর উপর মুসলমান খাতকদের নির্ভরতার মাধ্যমে। প্রচলিত খাজনা নিয়মিত পরিশোধ করা ছাড়াও পূজাবাবদ এবং গ্রামের স্কুলে অতিরিক্ত ক্লাশ খোলা ও জমিদারিতে বিশেষ অনুষ্ঠানাদি, যেমন জমিদার পরিবারে নতুন শিশুর জন্ম কিংবা বিবাহানুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য মুসলমান চাষীদের অতিরিক্ত  আবওয়াব-এর বোঝা বহন করতে হতো।

বাংলায় কয়েকটি মুসলমান জমিদার পরিবারও অবশ্য ছিল। এ সমস্ত পরিবারের মহিলা উত্তরাধিকারিগণ জমিদারির অংশীদার হতো। ফলে এগুলি ভাগ হতে হতে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছিল। অন্যদিকে হিন্দু জমিদার পরিবারের কন্যাগণ উত্তরাধিকারী হতে পারত না বলে হিন্দু জমিদারি ভাগ-বাটোয়ারা দ্বারা বিশেষ একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। স্বল্প সংখ্যক মুসলমান, যারা শহরে বাস করত তারা, তাদের জীবিকা নির্বাহ করত দিনমজুর, কসাই, কাঠমিস্ত্রী, গারোয়ান, কোচোয়ান, আস্তাবল তদারককারী, দর্জি, মাঝি, লস্কর, দপ্তরী, খুদে ব্যবসায়ী ইত্যাদি হিসেবে। একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ শতকের শুরুতে সরকারি চাকরি ও অন্যান্য কর্মসংস্থানে হিন্দু-মুসলমান কর্মচারীর অনুপাত ছিল ৭:১। ১৯৪০ সালের দিকে এই অবস্থার সামান্য পরিবর্তন হয়।

বিশ শতকের প্রথমার্ধে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসমূহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই অর্থনৈতিক বিভাজন। শোষক-শোষিতের একটা চিত্র পরিদৃষ্ট হয় বিশ শতকের উপনিবেশিক বাংলায়, যেখানে জমিদার ও মহাজনগণ ছিলেন মূলত হিন্দু, আর প্রজা ও খাতকগণের অধিকাংশ ছিলেন মুসলমান। শোষক গোষ্ঠী শোষিতদের থেকে বর্ণগত ও কৃষ্টিগত দিক থেকে স্বতন্ত্র হওয়ায় সংঘর্ষটা সাম্প্রদায়িক রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। অবশ্য মুসলমানদের ওপর শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নির্যাতনই সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট ছিল না। ১৯২০ এর দশকে অর্থনৈতিক চিত্রটাই পাল্টে গিয়েছিল ব্যাপকভাবে। সৃষ্টি হয়েছিল যথেষ্ট সংখ্যক মুসলমান ভূস্বামী শ্রেণির-  বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে মুসলমান চাষিরা দরিদ্র হয়ে পড়ায় বাংলায় কৃষি সংশ্লিষ্ট উত্তেজনা বেড়ে যায়। আদর্শগত কারণে মুসলমান কৃষকদের মধ্যে ঐক্য দৃশ্যমান হয়। ঐক্য আসে ধর্মীয় বন্ধন থেকে, আর ধর্মীয় বন্ধনই অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে তাদেরকে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত করে। বাঙালি মুসলমান সমাজে এই ঐক্যবোধ গড়ার পেছনে আলেম সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মুসলমানদের সংঘবদ্ধ করার ক্ষেত্রে। উনিশ শতকের শেষার্ধ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত সংস্কার আন্দোলন মুসলমানদের ধর্মীয় পবিত্রতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে বিশেষভাবে প্রয়াসী হয়। এ সকল আন্দোলন বিধর্মী ক্রিয়াকলাপ থেকে মুসলমানদের দূরে সরিয়ে রেখে তাদের মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় এক ধরনের নতুন ইসলামি পরিচিতি লাভ করে, যা গ্রামীণ একজন মুসলমানকে তার হিন্দু প্রতিবেশী থেকে স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত করে। এই হিন্দু প্রতিবেশীর সাথে সে কিন্তু ইতিপূর্বে একই সামাজিক পরিমন্ডলে মিলে-মিশে বাস করত। এই ধর্মীয় চেতনা তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, তার হিন্দু প্রতিবেশী থেকে সে স্বতন্ত্র সংস্কৃতির অধিকারী এবং তার চালচলন, রীতিনীতি, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নামধাম হবে বিশ্ব ইসলামের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনার অনুরূপ ধর্মীয় পুনর্জাগরণ হিন্দুদের মধ্যেও দ্রুত দেখা দেয়। গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে পাবনা ও ঢাকার মতো জেলাগুলিতে স্থানীয় ‘হরিসভা’ এবং ‘আর্যধর্ম প্রচারিণী সভা’সমূহ যজ্ঞ ও কীর্তন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে থাকে হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। হিন্দু সম্পত্তি সম্ভাব্য মুসলমান আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কলকাতার  মাড়োয়ারিরা রক্ষীদল গঠন করে। ১৯২৬ সালের ৩০ জুনের অমৃতবাজারের ন্যায় পত্রিকাগুলি বাংলার প্রতি অঞ্চলে হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার খবর ছাপে। ১৯২১/২২ সালে প্রতিষ্ঠিত পাবনার ‘হিন্দু সভা’র মতো প্রতিষ্ঠানগুলি এতদিন পর্যন্ত মুসলমান বিদ্বেষী ছিল না। কিন্তু এগুলিও কোন প্রকার বাধা-নিষেধ ছাড়া ধর্মীয় শোভাযাত্রায় গান-বাজনা করার অধিকার প্রতিষ্ঠার বাণী অনুসারীদের মধ্যে প্রচার করতে থাকে।

বিশ শতকের শুরুতে বাংলার সমাজে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন তেমনি উচ্চ মহলে। দলীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে কিছু স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী বিধিব্যবস্থা দুই সম্প্রদায়কে কাছে টানতে চেষ্টা করে। ১৯০৯ ও ১৯১৯ সালের সাংবিধানিক আইনগুলি ভোটাধিকার বাড়ায় সত্য, কিন্তু এগুলি স্বতন্ত্র নির্বাচনের ব্যবস্থা করে রাজনীতিবিদদের সাম্প্রদায়িক ও খন্ডিত গন্ডির মধ্যে চালিত করে। এ ধরনের মনোভাব সমসাময়িক অপর একটা প্রক্রিয়া দ্বারা জোরদার হয়। শিক্ষা বিস্তারের সাথে সাথে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করায় সীমিত কর্মসংস্থানকে সাম্প্রদায়িক কাড়াকাড়ির বিষয়ে পর্যবসিত করে। এভাবে রাজনীতি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটে।

খিলাফত আন্দোলন ছিল বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আর একটা মাইল ফলক। ধর্মীয় বিষয়ে আন্দোলন শুরুর আগে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ঘটানো হয়েছিল, আর এই আন্দোলন ভেঙ্গে গেলে একটা প্রচন্ড সাম্প্রদায়িক রোষের সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলন উলেমাগণকে একটা রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করে দেয় এবং তাঁরা তাঁদের স্বধর্মীদের মনে একটা সচেতনতা ও একটা প্রত্যয় সৃষ্টি করেন, যা ভবিষ্যতে তাদেরকে দ্বিজাতিতত্ত্ব গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। অপর দিকে মদনমোহন মালব্যের মতো হিন্দু নেতাগণ ‘হিন্দ-হিন্দি-হিন্দু’ জিগির তোলেন।

১৯২৫ সালে  চিত্তরঞ্জন দাশএর  বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিল হয়। এই চুক্তি ছিল উপরিকাঠামোয় ঐক্যের মাধ্যমে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম ঐক্য বজায় রাখার শেষ চেষ্টা। প্রয়াসটি ছিল অসবর্ণ বিবাহের মতো। ভঙ্গুর প্রয়াসটি ব্যর্থ হলে বাংলার মুসলমান নেতাগণ স্বরাজ পার্টির বিকল্প খুঁজতে থাকেন। হিন্দু  ভদ্রলোক শ্রেণির প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আঞ্জুমানসমূহ মুসলমান নেতাদের জন্য তৈরি মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। মুসলমানদের রাজনৈতিক সত্ত্বা সন্ধানের এক পর্যায়ে  .কে ফজলুল হক ও মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে  বেঙ্গল মোসলেম কাউন্সিল পার্টি। স্যার  আবদুর রহিম গঠন করেন  বেঙ্গল মুসলিম পার্টি। হক যেখানে স্বরাজ দলের অনুরূপ ব্রিটিশ বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন, আবদুর রহিম সেখানে অনুসরণ করেন ব্রিটিশ ঘেঁষা নীতি। একই সাথে ধীরে ধীরে বিভিন্ন আঞ্চলিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে মুসলিম চিন্তা-ধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পাবনায় এতদিন পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায় একে অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিয়েছে এবং ঢাকা ছিল হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ থেকে মুক্ত। এ সময়ে এসব স্থানে সাম্প্রদায়িকতা দানা বাঁধতে শুরু করে।

১৯২৬ সালের পূর্বে মসজিদের সামনে বাদ্য-বাদন নিয়ে হিন্দু-মুসলিম নেতাদের কখনও বিচলিত হতে হয় নি। কিন্তু এখন তা একটা প্রবল ধর্মীয় অনুভূতির বিষয় হয়ে দাঁড়ায় এবং একে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক চেতনা মাথা জাগাতে শুরু করে। পাবনার হাদাল ঘোষণা করে যে, সেখানে মসজিদের সামনে কখনও বাজনা বাজানো যাবে না। সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে আইন করে যে, রাস্তায় বাদ্য সহকারে কোনপ্রকার শোভাযাত্রা করা যাবে না। হিন্দুদের তরফ থেকে এই মর্মে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ আসে যে, বাদ্য সহকারে ধর্মীয় শোভাযাত্রা করা তাদের অতি পুরানো রীতি। মিছিল-মিটিং করে সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হতে থাকে এটা প্রমাণ করার জন্য যে, সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা প্রচলিত হিন্দু রীতি সম্পর্কে অজ্ঞতাপ্রসূত।

এই পটভূমিতে বাংলার মিলনাত্মক ঐতিহ্য একটা ধাক্কা খায়। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, ঢাকার জন্মাষ্টমী মিছিলে মুসলমান বাদক দল ও অন্যান্য শ্রমিক নিয়োজিত হতো। ধনী মুসলমানগণ তাদের হাতি-ঘোড়া দিয়ে সহযোগিতা করত এবং আশ-পাশের গ্রাম থেকে মুসলমানগণ এসে রাস্তার দুধারে ভিড় করে মিছিল দেখত। কিন্তু ১৯২৫/২৬ সালে হঠাৎ করেই এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। মুসলমান সমাজের নেতৃবৃন্দ হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ছাড়া বিয়ে-শাদী জাতীয় অপরাপর অনুষ্ঠানে বাদ্যসহকারে মিছিল করায় আপত্তি উত্থাপন করে।

১৯২৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভা নির্বাচনের ফলাফলে দলীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক ধারার সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায়। জাতীয়তাবাদী হওয়া সত্ত্বেও স্বরাজীগণ হিন্দু কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন নি। তারা ৪৭টি হিন্দু আসনের মধ্যে ৩৫টি লাভ করেন। কিন্তু ৩৯টি মুসলমান আসনের মধ্যে তারা লাভ করেন একটি মাত্র আসন। অপরদিকে আবদুর রহিমের নেতৃত্বে বেঙ্গল মুসলিম পার্টি নতুন কাউন্সিলে সর্ববৃহৎ একক দলে পরিণত হয়। কিন্তু দলটি অপর দুটি মুসলমান দল, বেঙ্গল মোসলেম কাউন্সিল পার্টি এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টির সাথে ঐক্য স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়। তা সত্ত্বেও বঙ্গীয় আইন সভায় একটি মুসলিম ব্লকের সৃষ্টি হয়। ১৯২৬ সালের পর গঠিত কোন মন্ত্রিসভাই দীর্ঘস্থায়ী হয় নি, তবে সবগুলি মন্ত্রিসভাতেই মুসলিম প্রাধান্য বজায় ছিল। পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে এভাবে মুসলমান রাজনীতিবিদগণ গুরুত্ব লাভ করেন। ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত কলকাতা কর্পোরেশন-এর নির্বাচনেও মুসলমানগণ একটা স্বতন্ত্র গ্রুপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। মুসলিম কাউন্সিলরগণ করপোরেশনের ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারকরূপে বিবেচিত হন।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। মুসলিম রাজনীতিবিদগণ বঙ্গীয় আইন সভায় ও অন্যত্র বিপুল মুসলমান প্রজার পক্ষে এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেন। জমিদারদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। ১৯২৮ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের উপর আলোচনাকালে এমনটিই প্রতিভাত হয়। আইন সভার মুসলমান সদস্যগণ এ আইনের যে সকল ধারা বর্গাদার, ক্ষুদ্রচাষি ও প্রজার অনুকূলে ছিল সেগুলির পক্ষে ভোট দেন। অপর পক্ষে স্বরাজী ও অস্বরাজী নির্বিশেষে সকল হিন্দু সদস্য জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে অর্থাৎ প্রজার বিপক্ষে ভোট দেন। সাধারণ মুসলমানদের দৃষ্টিতে স্বভাবতই আইন সভার হিন্দু সদস্যগণকে জমিদারদের স্বার্থ সংরক্ষণে অতিশয় উদগ্রীব বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলার হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণিকে নিজেদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রাধান্য বজায় রাখার শেষ প্রয়াসে লিপ্ত হতে দেখা যায় এবং এ ব্যাপারে স্বরাজী ও কংগ্রেস নেতাদেরকে একই মতের অনুসারী হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। ১৯২৭ সালের প্রথম মাস থেকে হিন্দুদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা পরিস্ফুট হতে দেখা যায় এবং এ চেতনা মুসলমানদেরও অনুরূপভাবে সাম্প্রদায়িক করে তোলে। আর্য সমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ উত্তর ভারতে নিহত হলে হিন্দু পত্রপত্রিকায় মুসলমান বিদ্বেষ প্রচারিত হতে শুরু করে। এই উগ্র সাম্প্রদায়িক নেতাকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বত্তা দারুণভাবে প্রতিবাদ মুখর হয়। কলকাতা করপোরেশনের হিন্দু সদস্যগণ শহরের একটা পার্ককে শ্রদ্ধানন্দের নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে মুসলমান পত্র-পত্রিকা এই সিদ্ধান্তকে মুসলমানদের মনোভাব পদদলিত করার আর একটি নমুনা হিসেবে নিন্দা করে।

রাজনীতি ক্ষেত্রে এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন হিন্দু ও মুসলমান পত্র-পত্রিকায় সমভাবে প্রতিফলিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃত হলে বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নতুন মোড় নেয়। এই আইনে বাংলার প্রস্তাবিত আইন সভায় প্রায় অর্ধেক সদস্যপদ মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত হয়। হিন্দু রাজনীতিবিদগণ মনে করেন এর ফলে তারা তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে নিজেদের মনোভাবের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে পারবেন না। এই মনস্তাত্ত্বিক আঘাত শীঘ্রই বাস্তব রূপ নেয় যখন কৃষক প্রজা পার্টি মুসলিম লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা নিম্নবর্গীয় প্রজাকুলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং তাদের অনুকূলে কয়েকটা আইন প্রণয়নের সাথে সাথে কয়েকটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নিম্নবর্গীয় এই প্রজাকুলের অধিকাংশই ছিল মুসলমান। এ সকল ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে হিন্দু ভদ্রলোকদের নিজেদেরকে কোনঠাসা ভাবার যৌক্তিক কোন হেতু সম্ভবত ছিল না। তবে ১৯৩৭ পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার শাসনামলে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমান অনুপাত কঠোরভাবে অনুসরণ করার ফলে শিক্ষিত হিন্দু বেকারের সংখ্যা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

উনিশ শতকের সংস্কারবাদী আন্দোলনের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায় অনুকূল সাড়া দেয় আত্মবিশ্লেষণ ও অন্য সম্প্রদায় থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্রীকরণের মাধ্যমে। মুসলমান উচ্চ শ্রেণি নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য নবচেতনালব্ধ মুসলমান সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করে। প্রয়াসটি পরিণামে পাকিস্তান আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৩৭ সালের পর মুসলিম লীগ যেখানে এর অধুনা প্রাপ্ত সংহতিবোধকে প্রকাশ করতে থাকে, কংগ্রেস সেখানে, বিশেষত উত্তর ভারতে, ক্রমশ বেশি করে নির্ভর করতে শুরু করে প্রকট হিন্দুত্বের ওপর। হিন্দু সংস্কারবাদী সংস্থাগুলির সাথে কংগ্রেস গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। এসকল সংস্থার মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। বাংলায় এই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটে। বিশেষ করে বিশ শতকের ত্রিশের দশকের শেষ দিকে বাংলায় আর্য সমাজের প্রচারণা হিন্দু শ্রমজীবীদের তাদের মতো একই পেশাজীবী মুসলমানদের প্রতি বিদ্বিষ্ট মনোভাবাপন্ন করে তোলে।

কংগ্রেস ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনকে ভারতের স্বাধীনতা দাবির প্রতি নতুন হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এতে কংগ্রেস ও ব্রিটিশ রাজের মধ্যেকার তিক্ততা বৃদ্ধি পায়। কংগ্রেস-মুসলিম লীগ অনৈক্যকে পুঁজি করে ভারত সরকার এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জোরদার করতে না পারে। সংগত কারণেই ১৯৩৬ পরবর্তী বাংলায় সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে ইউরোপীয়গণ মুসলিম লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের প্রতি সমর্থন জুগিয়ে চলে। এসব কিছুই বাংলায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে জোরদার করে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপান্তর ঘটার মধ্যে। ১৯৪০ পূর্ববর্তী দাঙ্গাগুলি যেখানে ছিল শ্রেণিভিত্তিক এবং মোটামুটি সংগঠিত রাজনীতিমুক্ত, সেখানে ১৯৪০ পরবর্তী দাঙ্গাগুলি ছিল সুস্পষ্টভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত।

বাংলার জনসংখ্যার বেশ বড় একটি অংশ দেশ বিভাগ (১৯৪৭) মেনে নেয়। কিছু সংখ্যক জাতীয়তাবাদী মুসলমান এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব (গান্ধী ও বাদশাহ খান ব্যতীত) শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সৃষ্টির বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেন। প্রচারণা দ্বারা পুষ্ট এবং বিশ শতকের চল্লিশের দশকের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দ্বারা দৃঢ় হয়ে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক চেতনা সুস্পষ্ট রাজনৈতিক রূপ ধারণ করে। বঙ্গবিভাগ (১৯৪৭) দ্রুতিকরণে হিন্দু ভদ্রলোক রাজনীতিকগণ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সমাজের উচ্চশ্রেণির ক্ষেত্রে যেমন, সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও তেমনি সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে দীর্ঘদিন তাদের মনোভাব স্পষ্ট ছিল না। একদিকে সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, অপরদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক রেষারেষির রাজনীতির মধ্যে বিরাজ করছিল অব্যাহত উত্তেজনা। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে হিন্দু-মুসলমানগণ পরস্পরের সাথে কলকাতার রাস্তায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, আবার তারাই রাওলাট আইনের সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায়; ১৯৩০-এ ঢাকার জনগণ প্রথম দিকে যৌথভাবে  আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনা করলেও শেষ দিকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার জনগণ  আজাদ হিন্দ ফৌজএর বন্দিদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করার সময় ঐক্যবদ্ধ হয়, অথচ মাত্র পাঁচ মাস যেতে না যেতেই তারাই প্রচন্ডতম সাম্প্রদায়িক হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়।

১৯৪৬ সালের ভয়াবহ কলকাতা হত্যাকান্ড এবং নোয়াখালী-ত্রিপুরার চরম নিষ্ঠুরতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এতদসত্ত্বেও ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হিন্দু-মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তিতে আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পায়।  [সুরঞ্জন দাস]

গ্রন্থপঞ্জি  Rafiuddin Ahmed, The Bengal Muslims 1871-1906: A Quest for Identity,  Delhi, 1981; Bazlur Rahman Khan, Politics in Bengal 1927-1936, Asiatic Society Of Bangladesh, Dhaka, 1987; Suranjan Das, Communal Riots in Bengal 1905-1947, Delhi, 1993; Joya Chatterjee, Bengal Divided: Hindu Communalism and Partition 1932-1947, Cambridge, 1994; Pradip Dutta, Carving Block: Communal Ideology in early Twentieth-Century Bengal,  New Delhi, 1999.